বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্মৃতিকাতর হয়ে কেঁদেছেন প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

শুক্রবার (৩০ আগস্ট) বিকেলে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ (উত্তর ও দক্ষিণ) আয়োজিত আলোচনা সভায় এ নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

বক্তব্যে বারবার শেখ হাসিনাকে আবেগাপ্লুত হয়ে কাঁদতে এবং চোখের জল মুছতে দেখা যায়। আবেগাপ্লুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত অনেককে কাঁদতেও দেখা যায় ওই সময়।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে অতীতেও বিভিন্ন সময় ১৫ আগস্টের নিষ্ঠুরতা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে কাঁদতে দেখা গেছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সুবেহ সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে ঘাতকের বুলেট বৃষ্টিতে নির্মমভাবে শহীদ হন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন দেশের বাইরে থাকায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা এবং আরেক কন্যা শেখ রেহানা।

বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ১৫ আগস্টে ঘাতকদের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, এসবি অফিসার সিদ্দিকুর রহমান, কর্নেল জামিল, সেনা সদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হক।

প্রায় একই সময়ে ঘাতকেরা হামলা চালায় বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির বাসায়। এতে শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াতের বাসায় হামলা করে সেরনিয়াবাত ও তার কন্যা বেবী, ছেলে আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় বেন্টু খানও নিহত হন।

পরিবারের সদস্যদের হারানোর দিনটির নির্মমতার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে কলঙ্কময় একটি দিন, ১৫ আগস্ট কালিমালিপ্ত একটি দিন।

এ সময় কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘৩২ নম্বরের ওই বাড়িতে কোনো জীবিত সদস্য ছিল না। সবাইকেই নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আর রাসেলকে সবার শেষে, বাবা-মা সবার লাশের পাশে নিয়ে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করেছিল।’

‘আমার ছোট্ট ভাইটি মাত্র ১০ বছরের। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। পরের দিন আমার মাসহ অন্যদের লাশ বনানী কবরস্থানে মাটি দেওয়া হয়। তাদের কোনো কাফন-দাফন ও জানাজা হতে দেওয়া হয়নি।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আব্বার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গীপাড়ায়। টুঙ্গীপাড়া তখন দুর্গম পথ, ঢাকা থেকে নৌ পথ ছাড়া যাওয়া যেত না। ২২/২৪ ঘণ্টা লাগতো, নৌপথে টুঙ্গীপাড়া যেতে। খুনিরা ভেবেছিল আর কখনও সেখানে কেউ পৌঁছাতে পারবে না। শুধু সেখানে নিয়েই যায় না, ওই বাড়িটাও তারা দীর্ঘদিন সিল করে দেয় এবং দখল করে রাখে।’

‘টুঙ্গীপাড়ায়, সেখানে যিনি মসজিদের ইমাম ছিলেন, কয়েকজন মুরব্বি। সেখানে কারফিউ জারি করা হয়, কাউকে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি। সেখানে কয়েকজন ছিলেন, আমাদের ঘরের কাছে মসজিদ। ওরা খুব তাড়াহুড়ো করছিল। তাদেরই কথায় তারা খুব অল্প সময় দেয়। যে তাকে (বঙ্গবন্ধু) গোসল করিয়ে দাফন করা যাবে।’

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘সে সময় কাফনের কাপড় পাওয়া যায়নি। দোকানপাট তেমন ছিল না। কারফিউ জারি করার কারণে সবই বন্ধ। রেডক্রসের একটি হাসপাতাল ছিল, রিলিফের কাপড় দেওয়া হতো সেখান থেকে। আমার বাবা বঙ্গবন্ধুই রিলিফের কাপড় সবকিছু রেডক্রসের মাধ্যমে সেখানে রেখেছিলেন। সেখান থেকে কয়েকখানা রিলিফের কাপড় নিয়ে এসে কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে সেই কাপড় দিয়ে তাকে দাফন করা হয়।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু) কিছু নিয়ে যাননি। বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে কিছু-ই নেননি। তার গরিব মানুষ, দুঃখী মানুষ; তাদের তিনি যা দিতে পারতেন। সেই কাপড় দিয়েই তার কাফন হয় এবং সেটা আর কিছু না।’

‘আর বনানী কবরস্থানে কোনোমতে বাকিদের মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কর্নেল জামিলের লাশটা নিয়ে যাওয়া হয় সামরিক গোরস্থানে। ওইটুকুন তারা বদান্যতা দেখিয়েছিল! যিনি (বঙ্গবন্ধু) এই দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেলেন, যিনি এই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজের জীবনের সব কিছু ত্যাগ করলেন। জীবনের সব সুখ, আহ্লাদ ত্যাগ করেছিলেন।’

‘১৫ আগস্ট সেই তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করলো কারা? এই বাংলাদেশের কিছু মানুষ। যেটা কোনোদিন বিশ্বাস করতে চাননি তিনি। অনেকেই বলেছেন কিন্তু কোনোদিন এটা গ্রহণ করতে পারেননি যে, এই দেশের মানুষ তাকে কখনও এভাবে হত্যা করতে পারে।’

ঘাতক ও ষড়যন্ত্রকারীদের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭৫ এর এই ঘটনার পর সবচেয়ে দুর্ভাগ্য হলো আমাদের আওয়ামী লীগের কেবিনেট মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক অবৈধভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয়। সে রাষ্ট্রপতি হয়। আর সে লাশ পড়ে থাকে ৩২ নম্বরে।’

‘আরও অবাক লাগে যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা প্রতিনিয়ত আমাদের বাড়িতে আসতো। এদের ভেতরে এই চক্রান্ত ছিল, এই ষড়যন্ত্র ছিল এটা কখনও তিনি (বঙ্গবন্ধু) স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। আমরাও চিন্তা করতে পারিনি যে, এতবড় বেঈমানি, মোনাফেকি কোনো মানুষ করতে পারে!,’ যোগ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক বিশ্বনেতা, অনেক সময় তাকে (বঙ্গবন্ধু)  বলেছেন, তাদের অভিজ্ঞতার অনেক কথা। ফিদেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন। একটা কথাই তিনি বলেছিলেন যে, এরা তো আমার সন্তান। আমার দেশের এরা কেন আমাকে মারবে! বিশ্বাস করতে পারেননি। ’

‘এই হত্যাকাণ্ড যে শুধুমাত্র একটা পরিবারকে হত্যা, তা নয়। এই হত্যার মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের ইতিহাস একেবারে মুছে ফেলে। এদেশের স্বাধীনতা, এদেশের ভাষা আন্দোলন, এদেশের প্রতিটি সংগ্রামে জাতির পিতার যে অবদান সেটা মুছে ফেলা হয়েছিল। তার নামটা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কোথাও তার নামটা নেওয়া যেত না। ওই ৭ই মার্চের ভাষণ বাজানো যেত না।’

১৫ আগস্টের নির্মমতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনারা যদি একটু চিন্তা করে দেখেন, যেভাবে নারী হত্যা, শিশু হত্যা- ঠিক ’৭১ এর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল ঠিক মনে হল সেই ঘটনাই। কারবালার ময়দানের যে ঘটনা, মনে হল সেই কারবালার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো ৩২ নম্বরে।’’

‘‘কী দুর্ভাগ্য আমাদের, আমাদের দু’টি বোনের, মাত্র ১৫ দিন আগে আমরা বিদেশে চলে যাই। তখন তো ভাবতেও পারিনি, এই রকমভাবে এই বাংলাদেশের মানুষ- এমন একজন মানুষকে হত্যা করলো, যে তাদের পরিচয় দিয়ে গেল, একটা দেশ দিয়ে গেল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাচ্ছিল আর তাকেই হত্যা করেছে। যে জাতি ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ বিজয় অর্জন করে বিশ্বব্যাপী বিজয়ী জাতি হিসেবে সম্মান পেয়েছিল, সে জাতি খুনি জাতি হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত হলো।’’

বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে দেশে ফিরে আসতে বাঁধা দেওয়ার কথাও জানান জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা।

অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির শীর্ষ ও মহানগর নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here