মো. তাজুল ইসলাম রাজু

কারবালার হৃদয় বিদারক ও মর্মস্পশী ঘটনা ঘটেছিল ৬১ হিজরী মােতাবেক ৬৮০ খ্রীস্টাব্দের ১০ মুহররম শুক্রবার আশুরার দিনে। মূলত এই যুদ্ধ ছিল একটি চাপিয়ে দেয়া অসম যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কলিজার টুকরাে কন্যা হযরত ফাতিমা রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহা এবং তাঁর সম্মানিত স্বামী আসাদুল্লাহিল গালিব হযরত আলী মুরতাযা রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহুর দ্বিতীয় পুত্র ইমাম হুসাইন রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু সত্য, ন্যায় এবং মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শহীদ হন। তাঁর সঙ্গে তাঁর শিশুপুত্র হযরত আলী আসগরসহ পরিবার ও বিশ্বস্ত সহচরদের বেশ কয়েকজন সদস্যও শহীদ হন। হযরত ইমাম হুসাইন রাদিরাদিআল্লাহু তা’আলা আনহুর এই শাহাদতের মধ্য দিয়ে মূলত ইসলামের ইতিহাসে সত্যের জন্য আপসহীন সংগ্রামে আত্মনিয়ােগ করার এবং প্রয়ােজনে জান কোরবান করার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, যা বিশ্ব বিবেককে বিশেষ করে বিশ্ব মুসলিমকে যুগ যুগ ধরে প্রেরণা জুগিয়ে আসছে।

উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পথিকৃৎ মওলানা মুহম্মদ আলী জওহরের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছেঃ

`কত্ লে হুসাইন আসল মে মরগে ইয়াযিদ হ্যায়,

ইসলাম যিন্দা হােতা হ্যায় হর,

কারবালা কে বাদ।

‘ হুসাইন (রা) এর কতল প্রকৃত অর্থে ইয়াযিদের মৃত্যু এনেছে। ইসলাম যিন্দা হয় প্রতি কারবালার পর।

জওহরের এই উক্তি থেকে একটা সত্য বের হয়ে এসেছে যে, ইমাম হুসাইন (রা.) শহীদ হয়ে প্রমাণ করেছেন, ইসলামের জন্য জান কোরবান করার মধ্য দিয়েই ইসলামের চিরন্তন সৌকর্যকে মহীয়ান গরীয়ান করা সম্ভবপর হয়। | হযরত ইমাম হুসাইনের পূর্ব পুরুষ হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য হাসিল করার জন্য নিজ পুত্র ইসমাইল (আ) কে কোরবানি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন আর পুত্র ইসমাঈল (আ) নিজেকে কোরবান করতে ছুরির তলে মাথা পেতে দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছে ছিল অন্য রকম। এ ছিল হযরত ইবরাহীম (আ) এর জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন হযরত ইবরাহীম আলায়হিস সালাম আর পুত্র ইসমাঈল (আ) যবীহুল্লাহ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীম (আ) একটি জান্নাতী দুম্বা জবেহ করে কোরবানির আদর্শ বুলন্দ করেন, যা আজও পালিত হয়।

এই কোরবানির ঘটনা ঘটেছিল হাজার হাজার পূর্বে মক্কা মুকাররমার মিনা প্রান্তরে এক ১০ জিলহজ তারিখে। হাজার হাজার বছর পর সেই হযরত ইসমাঈল আলায়হিস সালামেরই উত্তর পুরুষ ইমাম হুসাইন আলায়হিসসালাম শহীদ হলেন ঠিক সেই জিলহজ মাসের ১০ তারিখের পরে মুহররমের ১০ তারিখ আশুরাতে। হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস সালাম মূর্তি ভাঙ্গার অপরাধে নমরূদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েও আপােস করেননি। আল্লাহ অগ্নিকুণ্ডকে ফুল শয্যায় পরিণত করে তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন এক আশুরাতেই।

সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই যুগে যুগে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী আশুরা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে কারবালার ঘটনার মধ্য দিয়ে, যা বিশ্ব মুসলিম মননে শহীদী চেতনা জাগ্রত করে।

একজন খাঁটি মুসলিমের জীবন তো আল্লাহতে নিবেদিত ও সমর্পিত। আল্লাহ জাল্লা শানহু নির্দেশ দিয়েছেনঃ বলল আমার সালাত ও কোরবানি এবং আমার জীবন ও মরণ আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের জন্য। যে কারণে মর্দে মু’মিন সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয় এবং নিজের জীবনকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দেয়ার জন্য সর্বাবস্থায় প্রস্তুত থাকে, অন্যায়ের সাথে আপােস না করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে শরীক হয়।

কারবালার যুদ্ধে সেই আদর্শ সমুন্নত করেছেন ইমাম হুসাইন (রা)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলতেন ? হুসাইন আমার থেকে, আমি হুসাইন থেকে। যে হুসাইনকে ভালবাসে, সে আমাকে ভালবাসে।

হযরত ইমাম হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর নানাজীর সরওয়ারে কায়েনাত তাজেদারে মদিনা সরকারের দোআলম প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসারী ছিলেন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের, জিহাদ করার প্রয়ােজনে কিতালে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। জিহাদ হচ্ছে সর্বাত্মক চেষ্টা করা আর কিতাল হচ্ছে সশস্ত্র লড়াই করা।

৬৮০ খ্রীস্টাব্দের সেই আশুরার শুক্রবারে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হুসাইন (রাযি) এবং তাঁর সঙ্গীসহচর, পুত্র সন্তান ও নিকট আত্মীয়সহ প্রায় ৭২জন শহীদ হয়ে সত্যের, সুন্দরের, স্বাধীনতার তথা ইসলামের পতাকা সমুন্নত করে যান, যা আজও উদ্দীপ্ত করে মু’মিন হৃদয়কে, সেই ঘটনাকে স্মরণ করে আমরা কাঁদি।

আজকের বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ যে ভীষণ সংকট ও হুমকির মধ্য দিয়ে দিন গুজরান করছে তা সর্বজনবিদিত। যারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের উম্মত, যে উম্মতকে আল্লাহ্ জাল্লা শানহু অভিহিত করেছেন সর্বোত্তম উম্মত অভিধায়, যে উম্মত বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে সর্বাধিক অবদান রেখেছে, শান্তির দুনিয়া গড়ে তুলে যে উম্মত ইতিহাসে সােনালী অধ্যায় সৃষ্টি করেছে, যে উম্মত প্রায় দেড়শ বছর ধরে (১০৯৫-১২৪৪) সম্মিলিত নাসারা ঘােষিত ক্রুসেড মােকাবিলা করে বিজয় পতাকা উড্ডীন রেখেছে, যে উম্মতের ঐক্য ও সংহতির ফলে ক্রুসেডাররা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে মুসলিম ভূখণ্ড থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, সেই উম্মত আজও আছে। প্রায় দেড়শ’ কোটি উম্মতে মুহম্মদ শহীদী চেতনা লালন করে বটে, কিন্তু যে চেতনায় ইমাম হুসাইন (রাযি) ইয়াযিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়েছিলেন, যে চেতনায় তিনি যুদ্ধ করে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান শহীদী দরজা লাভ করেছিলেন, সে চেতনা আজকের মুসলিম উম্মাহকে কি নাড়া দেয়? তারা কি সেই চেতনায় অবগাহন করে সেই চেতনায় উজ্জীবি হয়ে নিজেদেদেরকে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহতে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়েছে?

কারবালার যুদ্ধ কি শুধু ইতিহাসের একটি হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পশী ঘটনা মাত্র। এখানে ঐতিহাসিক গীবনের খ্রীস্টানদের সেই ক্রুসেড সম্পর্কে একটি মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেছেন, অর্বাচিন, বর্বর ও অসভ্য লােকেরাই ক্রুসেডে যােগদান করে।

শ্রেষ্ঠ উম্মত, মর্দে মুমিন আর মর্দে মুজাহিদে আজকে কি বর্বর অর্বাচিনদের বিষদাঁত ভেঙ্গে দিতে পারে না?

কারবালার চেতনা বুকে ধারণ করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানাের কি আর সময় আছে? সেই কারবালা আজ সেই অর্বাচিন, বর্বরদের জবরদখলে, রিচার্ডের প্রেতাত্মারা সেই কারবালার দেশে লম্ফঝম্ফ করছে। যে রিচার্ড জেরুজালেম অবরােধ করেও জেরুজালেম দখল করতে ব্যর্থ হয়ে গাজী সালাহুদ্দীনের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে জান নিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল, সেই রিচার্ডের দশার কি পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে না?

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহকি এখন আপ্তবাক্য আওড়িয়ে ইতিহাসের গৌরব বর্ণনা করে আত্মতৃপ্তি পাবে, নাকি জিহাদী চেতনায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে-আজকে এ প্রশ্ন বার বার, প্রতিবার দেখা দিচ্ছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে কথা বলেছেন, তা কি আমরা একটি মস্তিষ্কতন্ত্রীতে নিয়ে অনুধাবন করার চেষ্টা করব না? কবি বলেন,

ফিরে এল আজ সেই মুহরম মাহিনা

ত্যাগ চাই মসিয়া ক্রন্দন চানিহা।…

হযরত ইমাম হুসাইন (রাযি) কারবালা প্রান্তরে সত্য সুন্দর প্রতিষ্ঠা করার জন্য আত্মত্যাগের যে অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন, সেই ত্যাগের আদর্শ গ্রহণের মধ্যে কারবালার চেতনা নিহিত রয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলামের ভাষাতে বলতে হয়ঃ

জাগাে, ওঠো মুসলিম হাঁকো হায়দারী হাঁক

শহীদের খুনে সব লালে লাল হয়ে যাক।”

কিংবা ফররুখ আহমদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয় ঃ

উতারাে সামান,

দেখ সম্মুখে কারবালা মাঠ ঘােড়সােয়ার….।”

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here