অনলাইন ডেস্ক

ইদ্রিস: যিনি মুসলমানদের নিকট হযরত ইদ্রিস (আঃ) নামে পরিচিত, ইসলামী ইতিহাস অনুসারে মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত তৃতীয় নবী। মুসলমানদের বিশ্বাস অনুসারে তিনি ইসলামের প্রথম নবী আদমের পর স্রষ্টার নিকট হতে নবীত্ব লাভ করেন। তার জন্মস্থান নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো মতে তিনি ইরাকের বাবেলে জন্মগ্রহণ করেন। আবার কারো মতে তিনি মিশরে জন্মগ্রহণ করেন। ধারণা করা হয়, বাইবেলে উল্লেখিত হনোক (Enoch) ব্যক্তিটি তিনিই।হযরত আদম আলাই সালাম এর পরের তৃতীয় নবী হযরত ইদ্রিস আলাইহিস সালাম ।

ইসলামি ভাষ্যমতে ইসলামের নবী মুহাম্মাদ মিরাজের রাতে চতুর্থ আসমানে ইদ্রিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ধারণা করা হয়, তিনিই সর্বপ্রথম কলম এবং কাপড় সেলাই করার বিদ্যা আবিষ্কার করেন। বলা হয়, জ্যোতির্বিজ্ঞান,অঙ্কশাস্ত্র এবং অস্ত্রের ব্যবহারও তিনিই সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন।

নাম ও বংশপরিচিতি

ইদ্রীস এর নাম ও বংশ নিয়ে ঐতিহাসিক ও ধর্ম বিষেষজ্ঞদের মাঝে বিরাট মতভেদ আছে। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে ইসহাকের মতে, তিনি হলেন ইসলামের নবী নূহ এর দাদা। তার আসল নাম হলো ইনোখ।

 ইদ্রীস তার উপাধি। কিংবা আরবি ভাষায় তার নাম ইদ্রীস আর হিব্রু ও সুরইয়ানী ভাষায় তার নাম হলো ইনোখ। ইবনে ইসহাক তার বংশধারা বর্ণনা করেনঃ আখনূখ (ইদ্রীস) ইবনে ইয়ারুদ ইবনে মাহলাইল। এভাবে তার বংশধারা আদম এর পুত্র শীষ এর সাথে মিলিত হয়। আরেকদল ঐতিহাসিকের মতে, ইদ্রীস ইসরাইল বংশীয় নবী। আর ইদ্রীস ও ইলয়াস একই ব্যক্তির নাম ও উপাধি।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

তার জীবন সম্পর্কে যতোটুকু জানা যায়, তা হলো- ছোটবয়সে তিনি দ্বিতীয় নবি শীষ – এর ছাত্র(বাইবেল অনুসারে) ছিলেন। বড় হওয়ার পর আল্লাহ তাকেঁ নুবুওয়্যত দান করেন। তখন তিনি আদম এর ওপরে অবতীর্ণ শরীয়ত ত্যাগ করতে মন্দলোকদের নিষেধ করেন। অল্পকিছু লোক তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সৎপথে ফিরে আসলো। আর অধিকাংশ মানুষই তার বিরোধিতা করলো। তাই তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে দেশ ছেড়ে যেতে মনস্থ করলেন। কিন্তু তার অনুসারীরা মাতৃভূমি ছাড়তে গড়িমসি করে বললো, বাবেলের মতো দেশ ছেড়ে গেলে এমন দেশ আর কোথায় পাব? উত্তরে তিনি বললেন, যদি আমরা আল্লহর জন্য হিজরত করি তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে এরচে’ উত্তম প্রতিদান দেবেন। এরপর তিনি নিজের অনুসারীদেরসহ দেশ ছেড়ে রওয়ানা হলেন এবং একসময় মিশরের নীলনদের তীরে এসে পৌঁছলেন। এ জায়গা দেখে তারা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন এবং এখানেই বসবাস করতে লাগলেন। তিনি সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে নিষেধে ব্রতি হন। কথিত আছে, তার যুগে ৭২টি ভাষা ছিল এবং এর সবকটি ভাষাই পারতেন।

কুরআনে ইদ্রীস এর আলোচনা

কুরআনে শুধু দুই জায়গাতে ইদ্রীস এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা মারইয়াম এবং সূরা আম্বিয়াতে। এ সকল জায়গায় তার সম্পর্কে কুরআনের ভাষ্য হলোঃ

হাদিসে ইদ্রীস এর আলোচনা

বুখারী ও মুসলিম শরিফের মেরাজের হাদিসে ইদ্রীস সম্পর্কে শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, তিনি একজন নবী ছিলেন এবং মেরাজের রাতে মুহাম্মাদ এর সাথে চতুর্থ আসমানে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল।

মৃত্যু

ইদ্রীস এর বয়স সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী ইদ্রীস ৩৬৫ বছর জীবিত থাকেন। তবে আরেক বর্ণনানুযায়ী তিনি ৮২ বছর জীবিত থাকেন। তার মৃত্যুবরণ করা সম্পর্কেও মতভিন্নতা রয়েছে। কারো কারো মতে তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। বরং আল্লাহ তাকে চতুর্থ আসমানে তুলে নিয়েছেন।

একটি বর্ণনা

এক আগন্তুক ব্যক্তি তিনদিন পর্যন্ত হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর সহচর্যে থাকলেন। তার আচরণাদি লক্ষ্য করে হযরত ইদ্রিস (আঃ)-এর মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো যে, এ ব্যক্তি নিশ্চয় কোন মানুষ নয়। অতএব তিনি বললেন, আল্লাহর কসম আপনি আপনার প্রকৃত পরিচয়টা বলুন। আগন্তুক বলল, আমি কোন মানুষ নয়।

আমি একজন ফেরেশতা। আমার নাম মালাকুল-মওত আজরাঈল (আঃ)।

হযরত ইদ্রিস (আঃ) বললেন, আপনিই কি দুনিয়ার যাবতীয় প্রাণীর জান কবজ করিয়া থাকেন? মালাকুল-মওত বললেন, হ্যাঁ। হযরত ইদ্রিস (আঃ) তাকে আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, তবে মনে হয় আপনি আমার জান কবজ করতেই এসেছেন।

মালাকুল-মওত বললেন, না, আপনার সাথে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে এসেছি। আমার একান্ত বাসনা আপনিও আমার এ প্রস্তাবে রাজী হবেন’।

হযরত ইদ্রিস (আঃ) বললেন, আমি আপনার সাথে এক শর্তে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে রাজী যদি আপনি আমাকে একবার মৃত্যুর অবস্থাটা উপভোগ করান। যদি আপনি আমাকে এখনই একবার মৃত্যুর অবস্থাটা উপভোগ করান তাহলে আমার অনেক উপকার হতো। মৃত্যুর ভয়ে আমি বেশি করে আল্লাহর ইবাদত করতে পারতাম।

মালাকুল-মওত বললেন, আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আমি একাজ করতে পারিনা। আল্লাহ এখনো আপনার জান কবজ করার হুকুম আমাকে দেননি। হযরত ইদ্রিস (আঃ) বললেন, আপনি আল্লাহর নিকট হতে অনুমতি চেয়ে নিন।

মালাকুল-মওত আল্লাহর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাঁকে অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে মালাকুল-মওত হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর জান কবজ করলেন। জান কবজ করার পর মালাকুল-মওত আজরাঈল (আঃ) পুনঃরায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর জান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন।

অতঃপর ফেরেশতা আজরাঈল (আঃ) হযরত ইদ্রিস (আঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই ইদ্রিস! জান কবজ করার সময় আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল? হযরত ইদ্রিস (আঃ) বললেন, কোন জীবিত প্রাণীর শরীরের চামড়া মাথা হতে পা পর্যন্ত খসে তুলে ফেললে প্রাণীটির যে রূপ কষ্ট হয় আমারও তেমনই কষ্ট হয়েছে।

মালাকুল-মওত বললেন, ভাই ইদ্রিস! আমি আজ পর্যন্ত যত জান কবজ করেছি এত সহজে কারো জান কবজ করিনি।

কৌশলে বেহেশতে গমন: হযরত ইদ্রিস (আঃ) হযরত আজরাঈল (আঃ) কে বললেন, আমার মনে দোজখ দেখার খুব স্বাদ জেগেছে। যদি আপনি আমাকে দোজখ দেখাতেন তবে আমি দোজখের ভয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে আরও বেশি মনোযোগী হতে পারতাম।

মালাকুল-মওত তাঁকে দোজখ দেখাতে দোজখের দরজায় নিয়ে গেলেন। তিনি দোজখ দেখার পর বললেন, ভাই আজরাঈল! আমার মনে বেহেশত দেখার বড়ই স্বাদ জেগেছে। যদি আপনি আমার এই স্বাদটি পূর্ণ করতেন তাহলে আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকতাম।

মালাকুল-মওত বললেন, যদি আপনি আমাকে কথা দেন যে বেহেশত দেখেই আপনি আমার নিকট ফিরে আসবেন তাহলে আমি আপনাকে বেহেশত দেখাতে পারি।

হযরত ইদ্রিস (আঃ) তাতে রাজী হলে মালাকুল-মওত তাঁকে বেহেশত দেখাতে নিয়ে গেল। বেহেশতের দরজায় আসলে হযরত ইদ্রিস (আঃ) তাঁর পায়ের জুতা খুলে বেহেশতে প্রবেশ করলেন। তিনি কিছু সময় বেহেশতে ঘুরাফেরা করলেন। এরপর তিনি মালাকুল-মওতের কাছে ফিরে এসে নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। পরক্ষণেই তিনি এক দৌঁড়ে আবার বেহেশতে ঢুকে গেলেন। মালাকুল-মওত তাঁকে ডেকে বলল, ভাই ইদ্রিস! আপনি আবার বেহেশতে ঢুকলেন কেন? তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসুন। আমি আপনাকে আবার পৃথিবীতে পৌঁছে দেব।

হযরত ইদরিস (আঃ) বেহেশতের ভিতর থেকে জবাব দিলেন, ভাই আজরাঈল! আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেন – প্রত্যেক প্রাণীই একবার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এবং একবার দোজখ না দেখে কেউ বেহেশতে যেতে পারবেনা। আমি তো একবার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করলাম এবং দোজখও দেখলাম। তারপর বেহেশত হতে বের হয়ে আপনাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করলাম। অতএব এখন আমি আর বেহেশত হতে বের হবো না। আপনি আপনার কাজে চলে যেতে পারেন।

মালাকুল-মওত হযরত ইদ্রিস (আঃ) এর জবাব শুনে কর্তব্য স্থির করতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আল্লাহ তা’আলা তখন হযরত আজরাঈল (আঃ) কে লক্ষ্য করে বললেন, আজরাঈল! ইদ্রিসকে বেহেশতে থাকতে দাও। তাঁর ভাগ্যে আমি এরূপ ঘটনায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম। অতঃপর হযরত ইদ্রিস (আঃ) মহাসুখে বেহেশতে বসবাস করতে লাগলেন।

তথ্যসূত্র

  1.  Erder, Yoram, “Idrīs”, in: Encyclopaedia of the Qurʾān, General Editor: Jane Dammen McAuliffe, Georgetown University, Washington DC.
  2.  P. S. Alexander, “Jewish tradition in early Islam: The case of Enoch/Idrīs,” in G. R. Hawting, J. A. Mojaddedi and A. Samely (eds.), Studies in Islamic and Middle Eastern texts and traditions in memory of Norman Calder ( jss Supp. 12), Oxford 2000, 11-29
  3.  কুরআন ১৯:৫৬-৫৭
  4.  কুরআন ২১:৮৫-৮৬
  5.  টেমপ্লেট:Ihadis
  6.  টেমপ্লেট:Ihadis
  7.  Genesis 5:18–24
  8.  সুনান আত-তিরমিজী 3157

গ্রন্থপঞ্জি

  • কাছাছুল কোরআন। মাওলানা হিফজুর রহমান রচিত, মাওলানা নুরুর রহমান অনুবাদিত এবং এমদাদিয়া লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত। প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৭৮-৮৯।
  • ইবনে খালদুনমুকাদ্দিমা, অনু. রোসেনথ্যাল, i, ২২৯, ২৪০, n. ৩৭২; ii, ৩১৭, ৩২৮, ৩৬৭ff.; iii, ২১৩
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here