নিজস্ব প্রতিবেদক :: ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকহানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে, তখন এর প্রভাব মুর্হুতেই ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে গঞ্জেও। ভয়কে তুচ্ছ করে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের জ্যৈষ্টপুরা গ্রামের দেবেন্দ্র লাল সেনের পরিবার।
শতশত মানুষ প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেয় সেন বাড়িতে। একই সাথে মুক্তিযোদ্ধারাও সশস্ত্র অবস্থান নেয়। পাহাড় বেষ্টিত নির্জন নিরাপদ মনে করে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার হতো বাড়িটি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ৪৮ বছর ধরে ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে দেবেন্দ্র লাল সেনের পিতা রাজ কুমার সেনের আমলে গড়া ১শত ১০ ফুট দৈর্ঘের বিশালকার দোতলা ১০ কক্ষ বিশিষ্ট টিনের ছাউনি দেয়া মাটির সেই বাড়িটি ছিল ১৯৭১ সালে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম ঘাঁটি। কালের স্বাক্ষী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলছে আজো। বাড়ি আছে তবে আগের মতো জৌলুস নেই।
দেবেন্দ্র লাল সেন যুদ্ধের এক বছর আগে মারা যান। দেবেন্দ্র সেনের পিতা রাজ কুমার সেন ছিলেন ব্রিটিশ আমলের রায় বাহাদুর। বৃদ্ধা ছবি রানী সেন হচ্ছেন দেবেন্দ্র লাল সেনের পুত্রবধু।
ছবি রাণী সেন জানান, ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের শুরুতেই গ্রামের সবার মাঝে কানা ঘুষা চলছে। তখনো বুঝতে পারছিলাম না, ওরা কি নিয়ে এত ফিসফিস করছে।’ পুরুষদের জিজ্ঞেস করলে বলতো,‘ তোমাদের ওসব জানার দরকার নেই।’ ‘মনে শঙ্কার ঝড়, প্রকৃতিও যেন থমথমে হয়ে উঠেছে। বাড়িতে চলছিলো পারিবারিক বাসন্তী পূজার আয়োজন। পূজোর আমেজ ছিল, তবে তা মলিন হয়ে উঠেছে অজানা শঙ্কায়। সেবার ঢাক ঢোল না বাজিয়ে অনাড়ম্বর করে রাতের বেলা পূজো সারতে হয়েছিল।’
বোয়ালখালী উপজেলার জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধা ছবি সেন এসব কথা জানান। বর্তমানে বয়সের ভারে ন্যূজ এ বৃদ্ধা সাধারণ কেউ নন। মুক্তিযোদ্ধাদের রেঁধে বেড়ে খাইয়েছেন দীর্ঘ ৯ মাস। যুদ্ধের সময় দেবেন্দ্র সেনের দুই ছেলের মধ্যে রণজিৎ সেন, ছোট ছেলে সুখেন্দু সেন ও মেয়ে মুক্তকেশী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা অমিতা সেন বাড়িতেই ছিলেন।
এছাড়া রণজিৎ সেনের ছেলে সত্যজিৎ, সুখেন্দু সেনের তিন ছেলে দেবাশীষ, সুভাশীষ, শিবাশীষ, দুই মেয়ে রূপা, কুমকুম সাথে ছিল। তখন তারা খুবই ছোট ছিল বলে জানান রণজিৎ সেন। তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর এ বাড়ির খবর আর কেউই নেয়নি। এ পরিবারও পায়নি কোনো সম্মাননা। তবে বাসন্তী পূজো হয় প্রতি বছর।
দেবেন্দ্র লাল সেনের এ বাড়ির প্রতিটি ধুলিকণায় রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ৭১ এর স্মৃতি। ৭ মার্চ এর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে শোনার পরে ছবি রাণীর কাছে পরিস্কার হয়ে যায় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
ছবি রাণী সেন বলেন, ‘মার্চ মাসেই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে অবস্থান শুরু করে। এক দল আসে তো আরেক দল যায়। পুরো ঘর তাদের জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছিল। ভোরে খেঁচুড়ি রান্না করে সবাই মিলে পাহাড়ে চলে যেতাম আর সন্ধ্যা নামলে ফিরতাম ঘরে। কিভাবে যে দিন কেটেছিল তা বর্ণনাতীত। একেকটা মূর্হুতছিল যেন বছর। সময় যেন ফুরোতেই চায় না। এভাবেই কেটেছিল দীর্ঘ নয় মাস। যেদিন রেডিওতে দেশ স্বাধীনের খবর পায়। সে কি আনন্দ, বুকের উপর থেকে যেন কয়েক মণ ওজনের পাথর নেমে গেছে। সূর্য উঠলেও তার আলো দেখতে পায়নি যেন। মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ির উঠোনে বাজি ফাটিয়ে উল্লাসে মেতেছিল।’
তিনি আরো বলেন,২৫ মার্চ রাতে যখন পাকবাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে সে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল এ গ্রামে। শহর নগর থেকে মানুষ ছুটে আসে জ্যৈষ্টপুরা পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের বাঁশকল, লিচু বাগান ও রাবার বাগানে দিনের বেলায় আশ্রয় নিতে হত সবাইকে। সন্ধ্যা নামলে খাবারের খোঁজে ছুটে আসত লোকালয়ে।
তিনি বলেন, জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামের মাধব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ও এ বাড়ির উঠোনে চলত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। পাশ্ববর্তী উপজেলা, শহর নগর ও ভারত থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা যোগ দিত এ বাড়িতে।
দেবেন্দ্র লাল সেনের পুরো বাড়ি, বৈঠকখানা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছিল উন্মুক্ত। চার পুকুরের মাছ, গোলার ধান আর ক্ষেতের ফসল দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করত মুক্তিযোদ্ধাসহ আশ্রয় নেয়া শত শত মানুষ। তাতে কয় দিনইবা চলে। বছরের খাদ্য ৫ মাসেই ফুরিয়ে যায়। আশে পাশের মানুষজনের বাড়ি থেকেও খাবার আসত। এ নিয়ে অর্ধহারে অনাহারে দিন কেটেছিল বলে জানান তিনি।
আরো পড়ুন: http://১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর, বোয়ালখালীতে পতাকা উত্তোলনের ইতিকথা
যুদ্ধকালিন কোম্পানি কমান্ডার আবুল বশর জানান,পটিয়া উপজেলার ধলঘাট হয়ে, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া থেকে নদী এবং পাহাড়ি পথে জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামে যোগাযোগ হত মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ মান্নান, মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার সোলেমান, রাঙ্গুনিয়ার আবদুল করিম, বাঁশখালীর সার্জেন্ট মহি আলমসহ ২৪৫ জন ইপিআর সদস্য এ বাড়িতে থেকে যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিল পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, এ বাড়িতে মূলত গেরিলা প্রশিক্ষণ হত। এখান থেকে যেতে হত অপারেশনে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে রাজাকারদের সহায়তায় এ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে পারে পাকবাহিনী। তারা এ গ্রামের বেশ কিছু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তখন আমরা পাহাড়ে ছিলাম।
সন্ধ্যায় এসে দেখি বাড়িটি জ্বালায়নি। তখনও এ বাড়িতে প্রচুর যুদ্ধের রসদ ছিল। ভেবেছিলাম রাতে হয়ত আক্রমণ করতে পারে তাই প্রস্তুতি ছিল বড় ধরণের অপারেশনের। কিন্ত তা আর হয়ে উঠেনি। রাস্তা ঘাট দূর্গম থাকায় হয়ত তারা আক্রমণের সাহস পায়নি। তবে পাহাড় লক্ষ্য করে একাধিক মর্টার সেল নিক্ষেপ করেছিল বলে জানান কমান্ডার আবুল বশর।
স্থানীয় চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোকারম জানায়,মুক্তিযুদ্ধের সময় ছোট ছিলাম, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে আমার এলাকার এ বাড়ির অবদানের কথা শুনেছি। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার। মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে যেভাবে ভুমিকা রেখে যাচ্ছে, পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহ স্থানগুলোকে মুল্যায়ন করবে ।
৭১এর সে সব দিনের কথা শাশুড়ীর মুখে শুনতে পান বলে হাসিমুখে জানায় পুত্রবধুরা। পুত্রবধু প্রিয়াংকা সেন, তন্দ্রা সেন ও পূর্ণা সেন বলেন, শুনতে ভালোই লাগে। সে সব কথা শুনতে গিয়ে গা শিউরে উঠে। অবসরে সবাই মিলে একাত্তরের গল্প শোনেন বৃদ্ধা ছবি সেনের কাছে।
তারা জানান, পিসি শ্বাশুড়ি শিক্ষিকা অমিতা সেন অবিবাহিতা অবস্থায় ২০০১ সালে মারা যান আর শ্বশুড় ১৯৮৪ সালে মারা যান। তবে তাদের আক্ষেপ, সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা এ বাড়ির পরিবারকে আদৌ করা হয়নি বলে।
সুখেন্দু সেনের ছোট ছেলে শিবাশীষ সেন শঙ্খু জানান, বাড়িটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। সবাই এ বাড়ির কথা বলে। এ বাড়ির মানুষগুলো কেমন আছে তার খবরটি কেউ নেয় না। সরকারি – বেসরকারি ভাবে কোনো সুযোগ সুবিধা পায়নি এ পরিবারটি।