বৈশ্বিক অতিমারী করোনার অভিঘাতের মধ্যেই নগরীর নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত ঐতিহ্যের আধার সিআরবিতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে হাসপাতাল কাম মেডিকেল কলেজ নির্মাণের খবরে চট্টগ্রামবাসীর ‘মাথায় বাজ পড়ে’। নগরীর ফুসফুসখ্যাত সিআরবি’র পরিবেশ ও প্রকৃতি বিনাশ করে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পের খবরে সঙ্গত কারণেই প্রতিবাদ ও ক্ষোভের ঝড় ওঠে। গড়ে ওঠে সিআরবি রক্ষার লাগাতার আন্দোলন। এই ইস্যুতে চট্টগ্রামের সকল মতাদর্শের নেতৃত্বাস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ একই ছাতার নিচে শামিল হয়ে আন্দোলনে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেন। সিআরবি রক্ষায় তারা কঠিন সংকল্পবদ্ধ হন। জনস্বার্থের এই আন্দোলন অবশেষে সাফল্যের মুখ দেখতে সক্ষম হয়।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, রাজনৈতিক কিংবা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, সিআরবি রক্ষার স্বার্থেই সব মত ও আদর্শের মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়েছে আপন তাগিদে। শহরের কোনো বিষয়-সঙ্কট নিয়ে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে সব শ্রেণির মানুষের এমন সরব হয়ে ওঠার নজির চট্টগ্রামে বিরল। জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হওয়ার কারণে এটি নাগরিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। কয়েক মাস ধরে করোনাকালের দুঃসহ সময়ে মানুষ সবকিছু ভুলে সিআরবির ঐতিহ্যকে রক্ষার আন্দোলনে প্রতিদিন কোনো না কোনো কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। সিআরবির ঐতিহ্য রক্ষা মানে এর পরিবেশকে রক্ষা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অটুট রাখা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে লালন করা। বৃটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে ইতিহাসের নানা ঘটনার সামান্য স্মৃতিচিহ্ন সিআরবিকে আঁকড়ে ধরার অংশ হিসেবে এই নাগরিক আন্দোলন। আজ শনিবার অনুষ্ঠেয় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে এই নাগরিক আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।
সিআরবি রক্ষা নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, আজকের মহাসমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। বিশেষ অতিথি থাকবেন তথ্য ও স¤প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। তারাই তাদের বক্তব্যে কীভাবে এই নাগরিক আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটছে তা ব্যাখা করে বলবেন। সিআরবি রক্ষায় টানা চারশ’ ৮০ দিনের দৈনিক কর্মসূচিও আজকের মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
নাগরিক সমাজের কো-চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা কোনো মতেই হাসপাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে নই। সিআরবি ছাড়া অন্যত্র তা হতেই পারে। আমরা শুধু চাই ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত গেজেটের মধ্যে সিআরবিকে যে ‘হেরিটেজ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, সে হিসেবে সিআরবিকে রক্ষা করতে। ওই গেজেটে সিআরবিকে সংরক্ষণে আটটি শর্তও দেয়া হয়েছিল। গেজেট মোতাবেক এখানে প্রজাপতি পার্ক, পাখির অভয়ারণ্য, জাদুঘর, পর্যটক আকর্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। আমরা সিআরবিকে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জাতীয় উদ্যান’ করার দাবি জানাচ্ছি। এখানে একাত্তরের বীর শহীদদের কবর আছে। অবশ্যই এসব কবর সংরক্ষণ করতে হবে এবং শহীদদের তথ্য থাকতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থান থেকে সঠিক ইতিহাস জানতে পারে।
জানা গেছে, সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনার সর্বপ্রথম প্রতিবাদ শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ওখানে হাসপাতাল হলে পরিবেশ ও ঐতিহ্যের কী হতে পারে, তা নিয়ে লিখেছেন অনেকে। সেগুলোর শেয়ার হয়েছে অসংখ্য। অনেকে পোস্টার করেছেন, শ্লোগান লিখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সিআরবি নিয়ে নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষের মতামত প্রতিবিম্বিত হয়েছে ভার্চুয়াল জগতেই। কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততায় শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলন ভার্চুয়াল জগৎ ছাড়িয়ে সিআরবির মাটিতে নেমেছে। প্রথমে কেউ কেউ এককভাবে, দল বেঁধে, বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ শুরু হয়। এমনও দেখা গেছে, একই সময়ে একাধিক কর্মসূচি পালিত হয়েছে। যে যেভাবে পারে, নানা ক্ষেত্র থেকে নানাভাবে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। অতঃপর সেই আন্দোলন নাগরিক সমাজের কাঠামোর রূপ পরিগ্রহ করে।
এর আগে ২০২০ সালের ১৮ মার্চ নগরীর ‘ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ঐতিহ্যবাহী সিআরবিতে পিপিপি প্রকল্পের আওতায় পাঁচশ’ শয্যার হাসপাতাল ও একশ’ আসনের মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সাথে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের জুলাই মাসে প্রকল্প এলাকার জমি হাসপাতাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য সাইনবোর্ড টাঙানো হলে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু হয়। টানা ১৫ মাস ধরে নাগরিক সমাজের সেই আন্দোলন চলছে। সিআরবিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) এই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ১২ বছর। প্রকল্পের আওতায় ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণেরও প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রস্তাবনা অনুসারে, এতে প্রায় চারশ’ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। ৫০ বছর পর প্রকল্পের মালিকানা রেলওয়ের হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।