দেশের সড়ক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত বাঙালির বহু আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু। যার দ্বার খুলেছে এ বছরের ২৫ জুন। এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে বড় অবকাঠামো নির্মাণে সক্ষমতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। এ সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মোট ২১টি জেলাকে সড়কপথে সরাসরি সংযুক্ত করেছে। কংক্রিট আর ইস্পাতের কাঠামোয় পদ্মা নদীর দুই প্রান্তের সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগের সেতুবন্ধও তৈরি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার মাধ্যমে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সূত্রপাত। মূল কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের শেষের দিকে। শুরুর পর একদিনের জন্যও কাজ থেমে থাকেনি।
তবে এই সেতু শুধু একটি বড় অবকাঠামো নয়, এটি বিদেশি অর্থায়ন ছাড়া প্রথমবারের মতো বাস্তবায়িত বাংলাদেশের একটি ‘মেগা’ প্রকল্প। এটি প্রমত্তা পদ্মার বুকে কারিগরি নানান জটিলতা কাটিয়ে নির্মাণ করা সেতু। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষ ও ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসানও ঘটিয়েছে এই সেতু। বছর শেষে পেছন ফিরে তাকানোর আয়োজনে দেখে নেওয়া যাক পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ এই সেতুর আদ্যোপান্ত।
নকশা ও কর্ম পরিকল্পনা
পদ্মা সেতুর নকশার দায়িত্ব ছিল নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইসিওম। নকশা ও প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯০ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৯ সালে হংকংয়ে এই কোম্পানির নেতৃত্বে পদ্মা সেতুর নকশা তৈরির কাজ শুরু হয়। তবে তাদের সঙ্গে আরও ছিল অস্ট্রেলিয়ার এসমেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, কানাডার নর্থ ওয়েস্ট হাইড্রোলিক কনসালটেন্টস এবং বাংলাদেশি এসিই কনসালটেন্টস লিমিটেড।
পদ্মা সেতুর নকশায় এইসিওম টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম। লম্বা স্প্যানের নকশা প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ হিসাবে তার পরিচিত রয়েছে। নকশা প্রণয়নে ব্যবস্থাপক হিসেবে এসমেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের হয়ে কাজ করেন অস্ট্রেলিয়ার কেন হুইটলার। পদ্মা নদীর মতো খরস্রোতা নদীতে সেতুর মতো বিশাল অবকাঠামোর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেতুর নকশাই যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে নদী শাসনের নকশাও তৈরি করতে হয়।
আর নদী শাসনের নকশা তৈরি করেছিলেন কানাডার ব্রুস ওয়ালেস। তার সঙ্গে ছিলেন জার্মানি আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৌশলীরাও। বিশ্বে খরস্রোতা যতো নদী আছে তার একটি বাংলাদেশের পদ্মা নদী। এই নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা এবং তলদেশে মাটির ধরন- এসবের কারণে এর উপর সেতু নির্মাণ করা ছিল অসম্ভব রকমের কঠিন এক কাজ। পদ্মা নদী একটি অ্যালুভিয়াল নদী অর্থাৎ পলল-শিলার মধ্য দিয়ে এই নদী একে বেঁকে সাপের মতো প্রবাহিত হয়েছে।
ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দশক আগে ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ওই সময় দেশের বৃহত্তম সেতু বিদেশি দাতাসংস্থাগুলোর সহযোগিতায় নির্মাণ করা হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তখন শেখ হাসিনা সাহায্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য দাতা সংস্থাগুলোকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
তবে সেতু উদ্বোধনের বেশ কিছু দিন আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়া প্রথম পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বলে দাবি করেন।
কিন্তু সরকারি নথিপত্র, ফিল্ম আর্কাইভ এবং যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের স্মারক গ্রন্থ থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনাই ২০০১ সালের ৪ জুলাই মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে প্রথমবার পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এ প্রকল্পে জাপানিদের অর্থায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু তার কয়েক দিন পরই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এ কাজ আর এগোয়নি।
সেতুর অবকাঠামো
পদ্মা সেতুকে ভূমিকম্প সহনীয় করতে অনেক কাজ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় মাটির যে কম্পন, তার সবটা যেন সেতুর উপরিকাঠামোয় যেতে না পারে, তার জন্য ব্যবহার করা হয় ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং। এটি ব্যবহার করলে ভূমিকম্পের সময় সেতুর পাইলিং নড়াচড়া করলেও মূল সেতুর কাঠামোয় এটি কোনো প্রভাব ফেলবে না। নকশা অনুসারে, এটি প্রায় ১০ হাজার টন লোড সামলাতে সক্ষম।
পদ্মার মতো স্রোতস্বিনী নদীর পানির উচ্চতা বর্ষাকালে বেশ বাড়ে। তাই সেতুর নিচে নদীতে যেন নৌযানগুলো অনায়াসে চলাচল করতে পারে, সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হয়। পদ্মা নদীর ক্ষেত্রে এ জন্য প্রায় ৬০ ফুট ক্লিয়ারেন্স রাখতে হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে গাড়ির লেন রয়েছে একেক পাশে দুটো করে এবং একটি ব্রেকডাউন লেন। অর্থাৎ মোট ছয় লেনের সেতু এটি, যদিও একে বলা হচ্ছে ফোর লেনের ব্রিজ। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য (পানির অংশের) ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে ডাঙার অংশ ধরলে সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৯ কিলোমিটারের বেশি। দ্বিতল পদ্মা সেতুর এক অংশ মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায়, আরেক অংশ শরীয়তপুরের জাজিরায়। সেতুর ওপরে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। তবে রেল চলাচল করতে সময় লাগবে আরও।
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি।
বাধা-বিপত্তি
পদ্মা বহুমুখি সেতুর সবশেষ স্প্যানটি বসানো হয়েছে ১০ ডিসেম্বর। এর মাধ্যমে সেতুর অবয়ব দাঁড়ালেও পাড়ি দিতে হয়েছে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায়। ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়ে যাওয়ার পরও ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হঠাৎ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় বিশ্বব্যাংক। নানা চেষ্টায়ও শেষ পর্যন্ত আর ফেরানো যায়নি বিশ্বব্যাংককে পদ্মা প্রকল্পে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ানোর আগের বছর ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে ড. ইউনুসকে সরিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এটি দিয়েই বিশ্বব্যাংককে পদ্মা-বিমুখ করার পেছনে প্রভাবিত করা হয়েছে।
পদ্ম সেতু নির্মাণে পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে সরকারের তরফ থেকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকে দায়ী করা হয়। এক্ষেত্রে সব থেকে বেশি দোষারোপ করা হয়েছে দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্বকে। এ ছাড়া দেশীয় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে সরকারি দল থেকে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ এসেছে। বিশেষ করে শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসকে এ জন্য দায়ী করা হয়। আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল, অবৈধভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধানের পদে থাকতে না পেরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছেন।
পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করতে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিও নানা অপতৎপরতা চালায় বলে সরকারি দল বার বার অভিযোগ করে আসছে। তারা বিশ্বব্যাংকের এদেশীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঋণচুক্তি যাতে পুনর্বিবেচনা না হয় সেই তদবির করেছে বলে সরকারি দলের অভিযোগ রয়েছে। এখনও পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে বলে অভিযোগ সরকারি দলের। এখনও বিরোধীরা অপপ্রচারসহ নানা গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা অভিযোগ করেছেন।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কানাডার আদালতে তার কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি বিশ্বব্যাংক। গত ১০ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
প্রমত্তা পদ্মার বিরাগভাজন আচরণ
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ আগাগোড়াই চ্যালেঞ্জের ছিল। নির্মাণকাজের প্রতিটি পর্বেই কোনো না কোনো চ্যালেঞ্জ এসেছে। এখানে নদীশাসন যেমনটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, তেমনি নদীর তলদেশে পাথর না থাকায় পাইলিং করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু যখন হয়, তখন সেটির পাইলও ছিল বিশ্বে গভীরতম। এখন পদ্মা সেতু বিশ্বে গভীরতম ভিত্তির সেতু বলা যেতে পারে।
ভরা বর্ষায় পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে চার থেকে সাড়ে চার মিটার। সাধারণত পাহাড়ি নদীতে স্রোত বেশি থাকে। কিন্তু সমুদ্রে মিশে যাওয়ার আগের অবস্থানে এত স্রোত পদ্মার মতো অন্য কোথাও তেমন দেখা যায় না। এমন অবস্থা একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকার নদী আমাজনেই দেখা যায়।
ব্রহ্মপুত্র সিরাজগঞ্জে ১৪ কিলোমিটার চওড়া। রাজশাহীর দিকে পদ্মা ৬ কিলোমিটার। এ রকম দুটি মিলিত ধারা মাওয়ার কাছে ৩ কিলোমিটার চওড়া এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা সেতু যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেখানে ভরা বর্ষায় নদীর গভীরতা দাঁড়ায় প্রায় ৬০ মিটার। এ সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত বড় ক্রেন, বার্জ ও ড্রেজারকে থর থর করে কাঁপতে দেখা গেছে।
আ.লীগের রাজনৈতিক সাফল্য
বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে গিয়েছিল, তখন এর নির্মাণ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সমালোচনার মুখে যেমন পড়েছিল, একইসঙ্গে এই সেতু নির্মাণের প্রশ্নে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছিল।
তবে দাতাদের অর্থায়ন ছাড়াই পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার তা বাস্তবায়ন করেছে। সে কারণেই দেশের সবচেয়ে বড় এবং ব্যয়বহুল স্থাপনা পদ্মা সেতু রাজিনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই সেতু নির্মাণকে তাদের রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে তুলে ধরছে। সরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সেতু নির্মাণ করেছে। সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পেছনে দেশের ভেতরে এবং বাইরে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে আসছিল ক্ষমতাসীন দল।
পদ্মা সেতু দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা প্রতীক বলেও মনে করে দলটি। আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার সরকারের বিশাল এক রাজনৈতিক সাফল্য। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প বা বড় বড় প্রকল্প নেয়া হয়। নির্বাচনের আগের বছর সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু।
নিজস্ব অর্থায়ন
বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণসহায়তা নিয়ে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পদ্মা সেতু। এটির পুরো অর্থায়ন হয়েছে দেশের টাকায়। কোনো দেশের কাছ থেকে এ সেতুর জন্য ঋণ নেওয়া হয়নি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে এ প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই করে সরকার। কিন্তু নির্মাণকাজের তদারক করতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনে বিশ্বব্যাংক। এরপর সব অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান প্রতিশ্রুত অর্থায়ন স্থগিত ঘোষণা করে।
অর্থায়ন স্থগিত করার পর প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসে মালয়েশিয়ার সরকার। এ নিয়ে কিছুদিন আলোচনা চলার পর তা আর এগোয়নি। ২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ না নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় সরকার। সব সংশয় উড়িয়ে বাংলাদেশ এ সেতু নির্মাণে সক্ষম হয়েছে।
পদ্মা সেতুর টোল আদায়
বর্তমানে পদ্মা নদী পার হতে ফেরির তুলনায় অতি উচ্চ হারে সেতুর টোল হওয়ায় কিছুটা অসন্তোষও রয়েছে জনমনে। পদ্মা সেতু মাধ্যমে মানুষের যে আর্থিক সাশ্রয় পাওয়ার কথা ছিল, সেটা পুরোপুরি হচ্ছে না উচ্চ টোলের কারণে। সেতুকে সংযোগকারী জেলা থেকে দেশের অন্য প্রান্তে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন খরচ বাড়ায়, দক্ষিণের জেলায় উৎপাদিত কৃষিশিল্প পণ্য কিংবা সেবা দেশের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে মূল্য সক্ষমতায় পাল্লা দিতে পারছে না।
ঢাকা থেকে দক্ষিণের উপকূলীয় জেলা পর্যন্ত সড়কে রয়েছে আরও দুটি টোল সেতু। এতগুলো সেতু ও সড়কে উচ্চ হারে টোল দেওয়ায়, সেটা দক্ষিণাঞ্চলের কৃষিশিল্প পণ্য ও সেবার মূল্য বেশি হচ্ছে। এতে এই অঞ্চলের শিল্প বিকাশ বিঘ্নিত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। দিন শেষে দক্ষিণের মানুষের পকেট কাটার উপকরণ হয়ে উঠছে সড়ক ও সেতুর টোল।
অনেকের ধারণা, গতানুগতিক বেশি রাজস্ব আয়ের জন্যই তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতুর এই টোল হার। অর্থনৈতিক বিকাশে গতি আনার জন্য বুদ্ধিদীপ্ত কোনো চিন্তাতাড়িত নয়, বরং ঋণগ্রস্ত সরকারের বাড়তি অর্থ আয়ের যেনতেন কৌশল।
দক্ষিণাঞ্চলের সক্ষমতা এগিয়ে রাখাতে নতুন করে অর্থনীতিবান্ধব টোলব্যবস্থা সাজানো দরকার। যেখানে ভারী গাড়ি বেশি টোল দেবে, খালি কিংবা হালকা গাড়ি দেবে কম। পাশাপাশি কৃষিসেবা ও শিল্পের খাতভিত্তিক সাশ্রয়ী টোল হারের বিবেচনাও দরকার। পদ্মা সেতুর কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উপযোগিতা তৈরি করবে সাশ্রয়ী এবং বুদ্ধিদীপ্ত টোল হার।
সেতুকেন্দ্রিক শিল্পনগরীর পরিকল্পনা
বর্তমানে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ২১ জেলায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) ২১টি শিল্পনগরী রয়েছে। এর মধ্যে গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে আছে দুটি করে শিল্পনগরী। ২১ জেলার মধ্যে শিল্পনগরী নেই মাগুরা ও নড়াইল জেলায়। এই দুই জেলায় দুটিসহ মোট সাতটি নতুন শিল্পনগরী স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বিসিক।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ২ হাজার ৪০০ একর জায়গায় এ শিল্পনগরী করার পরিকল্পনা বিসিকের। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব শিল্পনগরী বাস্তবায়ন করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য প্রায় আট হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে বলেও জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আশা করছে, এর মাধ্যমে ১০ লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
প্রস্তাবিত নতুন শিল্পনগরীগুলো হচ্ছে ফরিদপুরের নগরকান্দা শিল্পপার্ক, যশোরের ফাউন্ড্রি, অটোমোবাইল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পপার্ক, মাদারীপুরের শিবচর শিল্পপার্ক, নড়াইল শিল্পপার্ক, মাগুরা শিল্পপার্ক, পিরোজপুর শিল্পপার্ক ও শরীয়তপুরের জাজিরা শিল্পপার্ক।
তবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিসিকের শিল্পনগরীতে শিল্পপ্লট খালি পড়ে আছে। আবার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার দিক থেকেও পিছিয়ে আছে অনেক বিসিকি শিল্পনগরী। ফলে নতুন করে এসব শিল্পনগরী গড়ে তোলা হলে সেখানে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য কতটা আগ্রহী হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই নতুন করে শিল্পনগরী গড়ে তোলার আগে এ বিষয়ে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।