মঈনউদ্দিন খান বাদলের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনে ভোটের মাঠে সর্বশক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে থাকলেও নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের।

এ আসনের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ এলাকায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমেদের অনুসারীদের সরব উপস্থিতি। এর বিপরীতে মাঠে দাঁড়াতেই পারেননি বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ানের অনুসারীরা।

সোমবার (১৩ জানুয়ারি) ভোটগ্রহণের সময় চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে মোছলেমের অনুসারীদের একচেটিয়া বিচরণ। সংসদীয় এলাকার নেতাকর্মী তো ছিলই, দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও আসা নেতাকর্মীদের মোছলেমের পক্ষে সরব দেখা গেছে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের সামনে।

কর্ণফুলী নদীর পাড়ের এই আসনটির একাংশ গ্রাম, আরেক অংশ শহর। নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুর মাধ্যমে নগর ও গ্রামের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী চট্টগ্রাম-৮ আসন বোয়ালখালী উপজেলা এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পাঁচটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। বোয়ালখালীতে আছে একটি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন।

নগরীর বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে সকাল থেকে নৌকার সমর্থকদের পাশাপাশি ধানের শীষের সমর্থকদেরও সরব উপস্থিতি ছিল। কিন্তু বোয়ালখালী উপজেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে ধানের শীষের সমর্থকদের কেন্দ্রে পাওয়া যায়নি। দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সরব উপস্থিতি থাকায় নগরীর কয়েকটি কেন্দ্রে ভোটের সময় উত্তাপও ছড়িয়েছিল। আর উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের অভাবে ভোটের চিত্রও দেখা গেছে অনেকটা একতরফা। তবে বিএনপির প্রার্থী আবু সুফিয়ান এবং তার অনুসারীদের অভিযোগ- সকাল থেকে নৌকার সমর্থকরা অনেক কেন্দ্রে এজেন্টদের মেরে বের করে দিয়েছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে ও হুমকি দিয়ে ধানের শীষের সমর্থকদের কেন্দ্রে আসতে দেওয়া হয়নি।

নগরীর রাবেয়া-বশর ইনস্টিটিউটের সামনে গিয়ে দেখা যায়, নৌকা এবং ধানের শীষের সমর্থকদের পৃথক জটলা। দুপক্ষ কেন্দ্রের দুইদিকে অবস্থান নিয়েছে। ধানের শীষের এজেন্ট পরিচয়ে সালাহউদ্দিন শাহেদ নামে এক যুবক অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মারধর করে তাদের এজেন্ট বের করে দিয়েছে। ভোটগ্রহণ শুরুর আগে সেখানে ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলেও জানালেন এলাকার কয়েকজন।

একই এলাকার মধ্যে চান্দগাঁও এনএমসি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, নৌকা ও ধানের শীষের সমর্থক এবং পুলিশের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার দৃশ্য। এই কেন্দ্রে সরব দেখা যায়, উভয় প্রার্থীর অনুসারীদের, যাদের সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। নগরীর বহদ্দারহাটে এখলাসুর রহমান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও সকাল থেকে ধানের শীষের সমর্থকদের উপস্থিতি দেখা গেছে। ভোট শুরুর আগে এর অদূরে কয়েক দফা ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।

চান্দগাঁও মোহরা এলাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে মোছলেমের পক্ষে দায়িত্ব পালন করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। তিনি বলেন, ‘প্রবীণ ও ত্যাগী নেতা মোছলেম ভাই প্রার্থী হওয়ায় আমাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস আছে। প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে শুরু থেকেই। সে জন্য নেতাকর্মীরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে আছেন। বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে তার দলের নেতাকর্মীরাও নেই। তিনি শিবির ক্যাডারদের ভোটকেন্দ্রে নামিয়ে দিয়েছিলেন। তবে জনগণ তা গ্রহণ করেনি।’

কালুরঘাট সেতু পার হয়ে বোয়ালখালী পৌরসভা এলাকায় গোমদণ্ডী সরকারী আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের সামনে সড়কে দেখা গেছে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর জটলা। বোয়ালখালীর পাশের উপজেলা পটিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম শামসুজ্জামানকেও দেখা গেছে সেই জটলায়। চোখে পড়েনি ধানের শীষের পক্ষের কাউকে। ভোট দিয়ে বের হওয়ার সময় রুমা আক্তার নামে এক নারী বলেন, ‘আমরা ঠিকমতো ভোট দিয়েছি। কেউ কোনো সমস্যা করেনি।’

আমুচিয়া ইউনিয়নের পূর্ণ চন্দ্র সেন সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের মাঠসহ আশপাশে কমপক্ষে ২০০ তরুণ-যুবক গলায় নৌকার কার্ড লাগিয়ে ঘোরাফেরা করছেন। এলাকাটি বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেখানেও দেখা যায়নি ধানের শীষের পক্ষে তেমন কাউকে। কথা হয় ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফুদ্দিন নামে ধানের শীষের এক সমর্থকের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘এখানে জামায়াত নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন করছে। আমাদের এলাকার মূল সমস্যা হচ্ছে কালুরঘাট সেতু। মোছলেম উদ্দিনের এক বছরের মধ্যে সেতুর কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছে। অনেকে নৌকার সমর্থক না হলেও মনে করছেন, ধানের শীষ জিতলেও তো সরকার বদলাবে না। তার চেয়ে সেতুটা হওয়া বেশি প্রয়োজন। আবার বোয়ালখালীতে বিএনপির মধ্যে বিভক্তি আছে। একপক্ষ আবু সুফিয়ানকে সমর্থন দেয়নি।’

সারোয়াতলী, শাকপুরা, কধুরখীল, পোপাদিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ঘুরেও দেখা মেলেনি ধানের শীষের পক্ষের লোকজনকে। সাধারণ ভোটারদের কয়েকজনের মন্তব্য এমন, ‘বিএনপির লোকজন ভাবছেন, যেভাবেই ভোট হোক, মোছলেম উদ্দিনই জিতবেন। যেহেতু গ্রামে থাকতে হবে, শুধু শুধু ধানের শীষের জন্য কেন্দ্রে গিয়ে বিরোধে জড়ানোর কোনো অর্থ নেই।’

সারোয়াতলী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে সুষ্ঠু ভোট। কিন্তু আসলে আমাদের দাঁড়াতেই দেওয়া হয়নি। সকাল থেকেই আওয়ামী লীগের লোকজন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের নেতাকর্মীরা সেখানে যেতেই পারছে না।’

নগরীতে শুরুতে আবু সুফিয়ান যেমন কেন্দ্রে কেন্দ্রে গিয়েছেন, সঙ্গে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল। কিন্তু দুপুরে প্রথম দফায় সাংবাদিকদের কাছে এসে আবু সুফিয়ান পুনঃনির্বাচনের দাবি তোলার পর পরাজয় নিশ্চিতের আশঙ্কায় ভোটকেন্দ্র ছেড়ে যান তার নেতাকর্মীরা, এমনটাই বলছেন বিভিন্ন এলাকার সাধারণ ভোটারেরা। আর বোয়ালখালী উপজেলায় আবু সুফিয়ান নিজেও ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে যাননি, নেতাকর্মীরাও ছিলেন না।

আবু সুফিয়ান বলেন, ‘চট্টগ্রাম-৮ আসনের অধিকাংশ কেন্দ্রে বহিরাগত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে কেন্দ্র দখলে নিয়েছে, বিএনপির এজেন্টদের বের করে দিয়েছে। গোপন বুথে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীরা জোরপূর্বক ভোট দিয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছি ভোট স্থগিত করে, পুনারয় নির্বাচন দিতে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম-৮ আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘উনারা সকালে কয়েকটি কেন্দ্রের বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন সেগুলোর জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। যখন যেখানে তারা বলেছেন সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট ও বিজিবি পাঠিয়েছি। অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্ট বের করে দেয়ার বিষয়টি উনারা যেভাবে বলছেন সেভাবে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।’

আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোছলেম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে জেতার জন্য আসেনি। তারা এসেছে আন্দোলনের ইস্যু খুঁজতে। একের পর এক অভিযোগ তুলেছে, যেগুলো অসত্য। নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here