আলোকিত ডেক্স :
ড. অনুপম সেন (জন্ম: আগস্ট ৫, ১৯৪০) একজন বাংলাদেশি সমাজবিজ্ঞানী। বর্তমানে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়েরউপাচার্যের দায়িত্বে থাকা এই সমাজবিজ্ঞানী ২০১৪ সাল শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য একুশে পদকে ভূষিত হন।
জন্ম
অনুপম সেন ১৯৪০ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত ধলঘাট গ্রামে। তাঁর পিতা বীরেন্দ্রলাল সেন ছিলেন একজন আইনজীবী এবং তার মাতার নাম স্নেহলতা সেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনামলেই ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
শৈশব
অনুপম সেনের জন্মের কিছুদিন পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ চলাকালীন জাপানীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছুটা এবং বার্মা দখল করে নেয়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তারা বোমা নিক্ষেপ করে। জাপানীদের এই আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁর পরিবার তাঁদের গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। গ্রামেই অনুপমের শৈশবের কয়েক বছর কেটে যায়। যুদ্ধ শেষে তাঁরা আবার নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে আসেন। মাত্র আট বছর বয়সে পিতা বীরেন্দ্রলাল সেন এর মৃত্যুর পর মায়ের সাথেই তার শৈশব অতিবাহিত হয়।
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৬৬ সালে ড.অনুপম, শ্রীমতি উমা সেনগুপ্তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। শ্রীমতি উমা একজন গৃহিনী। তাদের একমাত্র মেয়ে ইন্দ্রানী সেন গুহ।
শিক্ষাজীবন
প্রাথমিক শিক্ষা
চট্টগ্রাম মহানগরীতে জন্ম নিলেও অনুপমের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের বাড়ি ধলঘাটে। ধলঘাট ইংলিশ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। ১৯৪৭ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে গ্রাম থেকে ফিরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে তাঁর মা তাঁকে তাঁর বোনসহ কলকাতায় তার মামার কাছে পাঠিয়ে দেন। কলকাতার সেন্ট ক্যাথিড্র্যাল মিশনারী স্কুলে ভর্তি হয়ে তিনি তাঁর পড়াশোনা চালিয়ে যান। চট্টগ্রামের পরিবেশ শান্ত হলে কলকাতা থেকে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল এইচ ই স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন।
উচ্চতর শিক্ষা
উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের মানসে মেট্রিক পাসের পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। আই.এ. পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েভর্তি হন। ১৯৬২ সালে তিনি সমাজতত্ত্বে স্নাতক ডিগ্রী এবং ১৯৬৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৫ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সমাজতত্ত্বে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিএইচ.ডি-এর বিষয় ছিল ‘দি স্টেট, ইনডাস্ট্রিলাইজেশন এন্ড ক্লাস ফরমেশনস ইন ইন্ডিয়া। এই গ্রন্থটি ১৯৮২ সালে যুক্তরাজ্যের প্রসিদ্ধ প্রকাশক ‘রাউটলেজ’ কর্তৃক প্রকাশিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নে দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা ডেভেলাপমেন্ট স্টাডিজ ইত্যাদি বিষয়ের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
কর্মজীবন
১৯৬৫ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে অনুপম সেনের কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৬৫ সালের মার্চে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বুয়েটে) সমাজতত্ত্ব ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষা সহায়ক (টি.এ.) ও টিউটরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে পুনরায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৮৪ সালের জুন থেকে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে কর্মরত ছিলেন। ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর তিনি চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেসরকারী) উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন এবং অদ্যাবধি সেখানে কর্মরত আছেন।
ড. সেনের তত্ত্বাবধানে বা সুপারভিশনে সাতজন গবেষক বিভিন্ন বিষয়ে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি পি.এইচ.ডি গবেষণা কর্মের পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনও তাঁর তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু গবেষণাকর্ম পরিচালিত হচ্ছে।
ড.অনুপম সেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হন। তিনি ১৯৮৪-৮৫ এবং ২০০০-২০০১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং ১৯৮৪-৮৫ সালে বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিভূ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি-ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ ও গবেষণাকর্ম
অধ্যাপক অনুপম সেন সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও বাংলা সাহিত্য-বিষয়ে পনেরোটির বেশি গ্রন্থ ও অনেক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত প্রকাশক Routledgeতাঁর The State, Industrialization and Class Formations in India গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। তার রচিত কিছু গ্রন্থের তালিকা নিম্নে দেয়া হল।
- দি পলিটিক্যাল ইথিকস অব পাকিস্তান : দেয়্যার রুল ইন পাকিস্তানস ডিসইন্টিগ্রেশন, (The Political Elites of Pakistan: Their Role in Pakistan’s Disintegration) (১৯৮২)
- বাংলাদেশ : রাষ্ট্র ও সমাজ; ঢাকা: অবসর (১৯৮৮/১৯৯৯)
- ব্যক্তি ও রাষ্ট্র : সমাজ-বিন্যাস ও সমাজ-দর্শনের আলোকে; ঢাকা: অবসর (২০০৭/২০০৮)
- আদি-অন্ত বাঙালি : বাঙালি সত্তার ভূত-ভবিষ্যৎ; ঢাকা: অবসর (২০১১)
- বাংলাদেশ : ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও মুক্তির স্বপ্ন; ঢাকা: অবসর (২০১১)
- কবি-সমালোচক শশাঙ্ক মোহন সেন; ঢাকা: অবসর (২০১৩)
- বাংলাদেশ : ভাবাদর্শগত ভিত্তি ও মুক্তির স্বপ্ন;
- বিলসিত শব্দগুচ্ছ (প্রতীচী ও প্রাচ্যের কয়েকটি কালজয়ী কবিতার অনুবাদ); ঢাকা: অবসর (২০০২)
- জীবনের পথে প্রান্তরে; চট্টগ্রাম: বলাকা (২০১১)
- সুন্দরের বিচার সভাতে; ঢাকা: অবসর (২০০৮)
- ইতিহাসে অবিনশ্বর; চট্টগ্রাম: বলাকা (২০১৬)
- বাংলাদেশ ও বাঙালি : রেনেসাঁস, স্বাধীনতা-চিন্তা ও আত্মানুসন্ধান; ঢাকা: অবসর (২০০২, ২০১১)
- বাঙালি-মনন, বাঙালি-সংস্কৃতি : সাতটি বক্তৃতা; ঢাকা: প্রতীক(২০১৪)
- বিচিত ভাবনা; চট্টগ্রাম: বলাকা (২০০৭, ২০১৭)
সম্মাননা
ড.অনুপম সেন বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদান রাখায় বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন; শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক ২০১৪ এ ভূষিত হন।
- একুশে পদক ’২০১৪
- রাহে ভান্ডার এনোবল এওয়ার্ড ২০১৬ (শিক্ষাবিদ হিসেবে)।
- আলোকিত বোয়ালখালীর বর্ষপূর্তি সংবর্ধনা ২০০৭
- অবসর সাহিত্য পুরস্কার ২০০৭
- একুশে মেলা পরিষদ-চট্টগ্রাম এর একুশে পদক-২০০৭
- বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন পদক ২০০৭
- গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সম্মাননা ২০০৬
- পটিয়া সমিতি-চট্টগ্রাম এর গুণীজন সংবর্ধনা ২০০৬
- ইউনাইটেড নেশনস ডে অ্যাওয়ার্ড ২০০২
- বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির চট্টগ্রাম সম্মিলন ২০০১
- চট্টগ্রামের প্রেসক্লাবের গুণীজন সংবর্ধনা ১৯৯৯
- জাহানারা ইমাম স্মারক পদক ২০১০
- উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সংবর্ধনা ১৯৯৫
- চট্টগ্রাম পরিষদ-কলকাতার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সম্মাননা
- ধ্রুব পরিষদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্মাননা
- শাপলা সংঘের গুণীজন সংবর্ধনাসহ আরো বহু সম্মাননা তিনি পেয়েছেন।