মোহাম্মদ মুকিম নামে চট্টগ্রামে দুজন কবি ছিলেন। তাঁদের দুজনেরই কাব্যনিদর্শন পাওয়া গেছে।
মোহাম্মদ মুকিম (১) এর একটা কবিতা-
প্রেমরস কাব্য কথা সুগন্ধি শীতল।
কালাকাম ভাংগি কৈলু পয়ার নিমল।।
মৃগাবতী নামে আর পরীর নন্দিনী।
মিত্র জনে শুনে সেই অপূর্ব কাহিনী।।
মোরে আজ্ঞা দিলা পীর রচিতে পয়ার।
দেশী ভাবে রঙ্গ কথা লোকে বুঝিবার।।
মোহাম্মদ মুকিম(২) এর কবিতার ভাষাও কাছাকাছি। তিনি লিখেছেন–
বড় শাদা এনাত দুহান দশ সুত।
বল বির্জ ধষ্ট যুবা সর্বগুণে যুত।।
বড় সাদার মৈক্ষ পুত্র মোহাম্মদ আফজাল।
রূপ গুণে অস্ত্রে শস্ত্রে কার্জেত কুশল।।
চট্টগ্রামের প্রাচীন কবি মোহাম্মদ আলীর চারটি কাব্য এবং তিনটি পদাবলী আবিষ্কৃত হয়েছে। তাঁর প্রথম রচিত কাব্যগ্রন্থ “হায়রাতুল ফেকাহ” থেকে কয়েকটি চরণ তুলে ধরছি–
চাটিগ্রাম শুদ্ধ স্থান
ইসলাম আবাদ বুলি কহে।
তাহার উত্তর দেশ কি কহিব সবিশেষ
আজিমনগর নাম হএ।।
আর এক আছে নাম ইদিলপুর অনুপাম
শুদ্ধ পবিত্র সেই।
সে সূচি রুচি দেশে বহুল আলিম বৈশে
বহু অলি অলিয়ার স্থান।
ফটিকছড়ির কবি আজগর আলী “চিনলেস্পতি” কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন–
বসন্তেরি রিত ধরি দক্ষিণ পবন।
নানা পুষ্প কেরিকের মদনে যাতন।।
দাদুরি কোকিল নাদ দারুনি সিখিনি।
মদনে হানয় বান পতী বিরহিণী।।
মোজাম্মিল নামে এক কবি সে সময়ে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি তাঁর নীতিশাস্ত্রবার্তা কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন–
আরবী ভাষায় লোকেঁ ন বুঝে কারণ।
সভানে বুঝিতে কৈলুঁ পয়ার রচন।।
যে বলে বলৌক লোকে করিলুঁ লিখন।
ভালে ভাল মন্দে মন্দন যাএ খণ্ডন।।
রচিলেক মোজাম্মিলে পঞ্চালি সুছন্দ।
দেশি ভাষে রচিলুং মাঝে মৃদু মন্দ।।
সাতকানিয়ার কবি আফজল আলী কাব্যের নিদর্শন পাই এ রকম–
চাটিগ্রাম মধ্যে ছিল ক্ষুদ্র এক গ্রাম।
মিলুয়া করিয়া আছে সে গ্রামের নাম।।
সেই গ্রামে হৈল এক ফকির আল্লার।
এ চারি মঞ্জিল ভেদ দিল করতার।।
সীতাকুণ্ডের কবি মোহাম্মদ কবীরও এসময় কবিতা লিখে খ্যাতি পান। তাঁর কবিতার নিদর্শন —
মনোহর মালতীয় অকুল পিরীত।
গাহিব সকল লোক মন হরষিত।।
এহি সে সুন্দর কিচ্ছা হিন্দীতে আছিল।
দেশি ভাষায় মুঞি পঞ্চালি ভনিল।
চট্টগ্রামের আরেক কবি শাহ মোহাম্মদ ছগির “ইউসুফ জোলেখা” লিখে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করেছেন। তাঁর এ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এ গ্রন্থের কাব্যভাষার নমুনা—
পিপিড়ার ভয়ে মাও ন থুইলা মাটিত।
কোল দিলা বুক দিআ জগতে বিদিত।।
অশক্য আছিলুঁ মুই দুধক ছাবাল।
তান দয়া হন্তে হৈল এ ধর বিশাল।।
ন খাই খাওয়ায় পিতা ন পরি পরাএ।
কত দুক্ষে এক এক বছর গোঞাএ।।
আলাওল ছিলেন মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত এবং খ্যাতিসম্পন্ন। তাঁর জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বেশির ভাগ বিদগ্ধজনই তাঁকে চট্টগ্রামের কবি হিসেবেই মানেন। তাঁর “পদ্মাবতী” কাব্যগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। যদিও এটি অনুবাদগ্রন্থ তবুও এতে আলাওলে স্বকীয় প্রতিভার ছাপ পাওয়া যায়। “পদ্মাবতী” কাব্যের ভাষা বেশ পরিশীলিত। যেমন-
প্রেম বিনে ভাব নাহি, ভাব বিনে রস।
ত্রিভূবনে যত দেখ প্রেম হস্তে বশ।।
যার হৃদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর।
মুক্তিপথ পাইল সে সবার ঠাকুর।।
প্রেম হন্তে জনমে বিরহ তিনাক্ষর।
পঞ্চাক্ষরে বিরহিনী লক্ষ্য পঞ্চশর।।
যার ঘটে বিরহের জ্যোতিঃ প্রকাশিল।
সুখ মোক্ষ প্রাপ্তি তার আপদ তরিল।।
চট্টগ্রামের স্থানে স্থানে এসময় কাব্যচর্চা হয়েছে বেশ গৌরবজনকভাবে। ছিলিমপুরের কবি আবদুল নবী লিখেছিলেন “আমীর হামজা” নামক কাব্যগ্রন্থ। এটাও একটা অনুবাদ কাব্য।কবি লিখেছেন–
আমির হামজার কিচ্চা পারসী কিতাব।
ন বুজিআ লোকের মনেত পাই তাব।।
বঙ্গেত ফারসী ন জানএ সব লোকে।
কেহ কেহ বুজি কেহ ভাবে জেলা সোঁকে।।
এহি হেতু সেই কথা মুঞি রচিবার।
নিজ বুদ্ধি চিন্তি মনে কৈলুম অঙ্গীকার।।
চট্টগ্রামের আরেকজন কবি ছিলেন মরদন।
তাঁর “নসিরা-ছবির-নামা” কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখেছেন-
ভুবন বিখ্যাত আছে রোসাঙ্গ নগর,
শ্রী সুধর্ম-রাজ হয় তথাতে ঈশ্বর।
ছত্র ও ধবল গজ লোক অধিপতি
ধনঞ্জয় সমতুল বলবন্ত অতি।
বৃহস্পতি-সম বুদ্ধি, দানে কর্ণসম,
রণে মহাবীর সে যে বিশাল বিক্রম।
মধ্যযুগের কবিদের কথা বলতে গেলে আরেকজন কবির কথা বলতেই হয়। নোয়াখালীতে তাঁর জন্ম হলেও সাহিত্যচর্চা চট্টগ্রামেই। তিনি হলেন কবি আবদুল হাকিম। তাঁর নূরনামা কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি চরণ তো অমরবাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চরণগুলো হলো–
যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়
নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশে না যায়।
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে দৌলত কাজীর নাম বেশ পরিচিত। তিনিও চট্টগ্রামের কবি। তাঁর “সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী” অতি জনপ্রিয় গ্রন্থ। দৌলত কাজীর কাব্যভাষা অত্যন্ত সরল ও সাবলীল। যেমন,
পঞ্চশত হস্তী যাঁর বহয় আদেশ,
অরুণ যোগান কালা মাতঙ্গ বিশেষ।
সংসারের লোক কেহ নাহিক দুঃখিত,
মহারাজা প্রসাদে সকলে আনন্দিত।
মহামত্ত ঐরাবত দেখি কীর্তি যশ
শ্বেতরূপে সুধর্মের হৈল পদবশ।
ভাবতে অবাক লাগে সেই মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে যখন সারা অখণ্ড বাংলা খুঁজেও তেমন উল্লেখ্যযোগ্য কবি পাওয়া যায় না, তখন চট্টগ্রামের কবিরা একের পর এক কাব্যগ্রন্থ রচনা করে গেছেন। চক্রশালার ছৈয়দ ছুলতানও তেমনই এক উল্লেখযোগ্য কবি।
তাঁর কাব্যভাষার উদাহরণ–
গ্রহ শত রস যোগে অব্দ গোঙাইল।
দেশী ভাষে এহি কথা কেহ ন কহিল।।
আরবী ফার্ছি ভাষে কিতাব বহুত।
আলিমানে বুঝে ন বুঝে মূর্খসুত।।
দুক্ষ ভাবি মনে মনে করিলুং ঠিক।
রছুলের কথা যথ কহিমু অধিক।।
চট্টগ্রামের আরেক কবি ছৈয়দ ছুলতানের শিষ্য মুহম্মদ খান রচনা করেন কিয়ামৎনামা। এ কাব্যের ভাষা–
তান আজ্ঞা শিরে ধরি মনেত আকলি।
চারি আছবার কথা কৈলু পদাবলী।।
দুই ভাই বিবরণ সমাপ্ত করিয়া।
প্রলয়ের কথা সব দিলু প্রচারিয়া।।
অন্তে তবে বিরচিলু প্রভু দরশন।
ইহা হোন্তে ধিক কথা নাহি কদাচন।।
“গোরক্ষ বিজয়ে” এর কবি শেখ ফয়েজুল্লাও চট্টগ্রামের কবি। তাঁর কাব্যভাষা–
নাথে বোলে এই রাজ্য বড় হএ ভালা।
চারি কড়া কড়ি বিকাএ চন্দনের তোলা।।
লোকের পিঁধন দেখে পাটের পাছড়া।
প্রতি ঘর চালে দেখে সোনার কোমড়া।।
কার পখরির পানি কেহ নাহি খাএ।
মণি মাণিক্য তারা রৌদ্রেত শুকাএ।।
যে রাজ্যের বর্ণনা কবি দিলেন তা যে একটি সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল তা,কবির বর্ণনাতেই স্পষ্ট।
এসময়ে কোনো কোনো মুসলিম কবি বৈষ্ণব পদাবলীও লিখেছেন। যেমন, মোহাম্মদ নাসিম লিখেছেন–
রূপ দেখি কেবা জাইব ঘরে।
চিত্য কাড়া কালার বাঁশী লাগিছে অন্তরে।।
কিবা দিনে কিবা খেনে বন্ধুর সনে দেখা।
যেবা ছিল জাতি কুল ন জাইবে রাখা।।
সে সে জানে কালার বাঁশী লাগিয়াছে যারে।
ছাড়িব জগত মায়া ডরাইবে কারে।।
আবার ছৈঅদ মর্ত্তুজা লিখেছেন–
মুঞি কেনে পিরীতি রে কৈলুং নিঠুর কালার সনে
নিঠুর কালার প্রেমমালা ন সহে পরাণে।।
ঘরেতে বসিআ শুনি মথুরা বাজে বাঁশী।
সুতিলে স্বপনে দেখি জাগিলে উদাসী।।
১৮৭৬ সালে চট্টগ্রাম নোয়াখালী অঞ্চলের ওপর দিয়ে ভয়ানক তুফান বয়ে যায়। সেই তুফানের নিখুঁত বর্ণনা পাই আমরা সে সময়ের চট্টগ্রামের কবি আহমদ আলী মিঞার কবিতায়–
শুন শুন গুণীগণ কবিতা বচন
কবিতা শুনতে চমৎকার।
আটতিরিশ মঘীর কার্ত্তিক মাসে
হৈল বড় বয়ার।
মঙ্গলবার দিবাগতে নিশি শান্তে চলিল পবন।
নর জন্তু পশু পক্ষী হৈল জাগন।
ভয়ে চমৎকার জলান্তর জল পশুগণ,
জাগিলেক মৃগ ব্যাঘ্র পর্বত কানন।
যদিও এসময় চট্টগ্রামের মুসলিম নারীরা কঠোর রক্ষণশীল প্রথায় আবদ্ধ ছিল,কিন্তু তার মধ্যেও আমরা একজন মুসলিম মহিলা কবিকে পাই।তিনি হলেন শ্রীমতী রহিমন্নিসা। শ্রীমতী শব্দটি তিনিই ব্যবহার করেছেন। তাঁর বাবার বাড়ি চট্টগ্রাম শহরের শুলকবহর এলাকায়,আর শ্বশুরবাড়ি ছিল হাটহাজারি। তিনিও ভাষা ব্যবহারে অন্যান্য পুরুষ কবিদের অনুসরণ করেছেন। তাঁর কাব্যভাষার নমুনা–
মুই অতি খিনমতি দুক্ষিত তাপিত।
বংশ গ্রাম কহি কিছু শুনহনি নিচিত।।
ছিরিমতি ক্ষুদ্র অতি রহিমন্নিচা নাম।
শুলকবহর নামে গ্রাম অনুপাম।।
পীতায়তি শুদ্ধমতি আবদুল কাদের।
ছুপি খান্দানে তাই আছিল শুধির।।
এভাবে যুগে যুগে চট্টগ্রামের কবিরা বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, আজও সে ধারা অব্যাহত। স্বল্প পরিসরহেতু আজ শুধু মধ্যযুগের কয়েকজন কবির কবিতা তুলে ধরা হলো। বাংলা ছড়াসাহিত্য এবং শিশুসাহিত্যেও চট্টগ্রাম বরাবরই অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে। চট্টগ্রামের ছড়াশিল্পী এবং শিশুসাহিত্যিকরা জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রেখেছেন। কথাসাহিত্যেও চট্টগ্রামের সাহিত্যিকরা গুরুত্বপূর্ণ আসন দখল করে আছেন। আশা রাখি ভবিষ্যতেও চট্টগ্রামের কবি সাহিত্যিকরা তাঁদের স্বীয় প্রতিভা দ্বারা বাংলাসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্থান করে নেবেন।
সহায়কগ্রন্থ : চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য -ওহীদুল আলম, মুসলিম বাংলাসাহিত্য– ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, চট্টগ্রামের ইতিহাস-প্রসঙ্গ-আবদুল হক চৌধুরী, এনামুল হক বক্তৃতামালা
সূত্র- দৈনিক আজাদী