মো. তাজুল ইসলাম রাজু :

পটভুমি- ষষ্ঠ শতকে পটিয়াসহ চট্টগ্রাম সমতট রাজ্যভুক্ত হয়। সপ্তম শতক অবধি সমতটের খড়ুগ রাজবংশের রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়। অষ্টম শতকে ধর্মপালের রাজত্বকালে তা পাল সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। নবম শতকে পটিয়াসহ চট্টগ্রাম আবার হরিকেল রাজ্যভুক্ত হয়। দশম শতক থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ ১৬৬৬ সন পর্যন্ত সাময়িক বিরতি থাকলেও চট্টগ্রামের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল আরাকান রাজ্যভুক্ত ছিল। বৌদ্ধযুগে চট্টগ্রাম চক্রশালা নামে বহির্বিশ্বে পরিচিত ছিল। এ চক্রশালা পটিয়া সদর থেকে দুই মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। আরাকান শাসকরা চক্রশালায় তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা মেং ফালোং (সেকান্দার শাহ) এর শাসনকালে (১৫৭১-১৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) চক্রশালা রাজধানী ছিল যেখানে চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ ও কক্সবাজার তার দখলে ছিল। পটিয়াসহ পুরো চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় সম্রাট আকবরের বাংলা বিজয়ের আরো নব্বই বছর পর ১৬৬৬ সনে তার প্রপৌত্র সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে। ব্রিটিশ শাসনের আগে এতদঞ্চল আরাকান আমলে চক্রশালা, মোগল আমলে চক্রশালা পরগণা এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে চাকলা নামে পরিচিত ছিল। ব্রিটিশ সরকার দক্ষিণ চট্টগ্রামের কেন্দ্র পটিয়ায় ১৯১০ সালে ৫ জন মুন্সেফ নিয়ে মহকুমা মুন্সেফ কোর্ট স্থাপন করেন এবং তদানিন্তন পাঁচ থানার প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার জন্য একজন সার্কেল অফিসার (ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট) নিয়োগ করেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে পটিয়া ও রাউজানের কিছু অংশ নিয়ে রাঙ্গুনিয়া থানা গঠিত হয়। পরবর্তীতে পটিয়াকে ভেঙে ১৮৯৮ সালে আনোয়ারা, ১৯১০ সালে বোয়ালখালী ও ১৯৭৬ সালে চন্দনাইশ থানা গঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান আমলে পটিয়া মহকুমা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পটিয়া উপজেলা হিসাবে স্বীকৃতি পায়।

ইতিহাস : পাহাড়, নদী, সমভূমি প্রকৃতির এ অপরূপ সৃষ্টি বোয়ালখালী নামক অঞ্চলটির জন্ম কখন? সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনে আজীবন সাধনারত সাধকরা এখনও একমত হতে পারেনি এর সৃষ্টি রহস্য আদৌ কি ? তবে ভূমির গঠন, রূপ নির্দ্ধিধায় বলে দেয় সে পৌরানিক প্রাগৈতিহাসিক কালে বোয়ালখালী নামক অঞ্চলটির জন্ম। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের “মার্কণ্ডেয় পুরাণ” গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ আছে এতদ অঞ্চলের কথা।

হযরত শাহসূফি বুঁ- আলী কালান্দর (রহ:) খিষ্ট্রিয় ৯ম ১০ম শতাব্দীতে বোয়ালখালী দ্বীনি ইসলাম প্রচার করার জন্য আসেন। হাজার বছরের বোয়ালখালী এটাতেও প্রমাণ মেলে। সরকারি নতি মোতাবেক বোয়ালখালীর সৃষ্টি হযরত বুঁ- আলী কালান্দর শাহ (রহ:) এর নামানুসারে। থানা সৃষ্টি হয় ২৯ আগষ্ট ১৯১০ খ্রি:। এর পূর্বে এটি পটিয়া মহকুমার অন্তর্গত ছিল।

তবে লোকেমুখে এটিও প্রচার আছে যে, বোয়ালখালী নামক খাল (কর্ণফুলির উপনদী) থেকে “বোয়ালখালী” শব্দটির উৎপত্তি । তবে একথা সত্য যে, বোয়ালখালীর ইতিহাস অন্যান্য যে কোন উপজেলা থেকে সমৃদ্ধ এবং হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রকৃতি এবং মানবীয় গুণাবলীর বর্তমান বিশেষণে বিশেষিত “ রত্মগর্ভা বোয়ালখালী।”

নামকরণ : সরকারি স্বীকৃত মতে দরবেশ, সূফীসাধক, সৈয়দ মোহাম্মদ বুঁ আলী কালান্দর শাহ (রহ:) এর নামানুসারে বোয়ালখালীর নামকরণ করা হয়েছে।

থানার মর্যাদা লাভ : পূর্বেই বলা হয়েছে বোয়ালখালী পটিয়া মহকুমার অধীনে ছিল। বর্তমান শাকপুরা ইউনিয়নের বোয়ালখালী খালের তীরে ঘোষখিল গ্রামে পটিয়া থানার অধীনে একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। ১৯১০ সালের ২৯ আগষ্ট ঐ পুলিশ ফাঁড়িকে নামকরণ করা হয় “ বোয়ালখালী” হিসেবে। ১৯৮৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঘোষখিল গ্রাম থেকে অস্থায়ী থানাকে পূর্ব গোমদন্ডী ইউনিয়নে নিজস্ব স্থায়ী ভবনে থানাকে স্থানান্তর করা হয়।

উপজেলার মর্যাদা লাভ: উপজেলা ব্যবস্থায় এরশাদ সরকারের একটি অন্যতম জনপ্রিয় স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা। কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণে উপজেলা পদ্ধতির ধারণা সাধারণ জনগণের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল। অন্যান্য থানার মত ১৯৮৩ সালের ২ জুলাই বোয়ালখালী থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়।

পৌরসভার মর্যাদা লাভ: ৪ অক্টোবর ২০১২ স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বোয়ালখালী পৌরসভার গেজেট প্রকাশ করে। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ রয়েছে ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯ (২০০৯ সনের ৫৮ নম্বর আইন) এর ধারা ৪ এর উপ-ধারা (২) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলাধীন নিম্ন তফসিলে বর্ণিত শহর এলাকা সমন্বয়ে বোয়ালখালী পৌরসভা নামে পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করল এবং উক্ত পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত এলাকা পৌর এলাকা হিসেবে অভিহিত হবে।’ পৌরসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে পূর্ব গোমদণ্ডী ইউনিয়ন, পশ্চিম গোমদন্ডী ইউনিয়নের ছয় ওয়ার্ড ও কধুরখীল ইউনিয়নের তিন ওয়ার্ড (পশ্চিম কধুরখীল)।

বোয়ালখালীর পশ্চিমে দেশের একমাত্র বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রাম, পূর্বে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় করলডেঙ্গা পাহাড়, দক্ষিণে বৃহত্তর পটিয়া, উত্তর পূর্বে বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্যসেনের জম্মভুমি রাউজান, রাঙ্গুনিয়া এবং বান্দরবান পার্বত্য অঞ্চল।

বোয়ালখালী উপজেলাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম বৃটিশ আমলে কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত রেল ও সড়ক সংযুক্ত কালুরঘাট সেতু। একদিকে চলাচল করা এ কালুরঘাট সেতুটি যেমন যাতায়াত ব্যবস্থা করেছে সহজতর অপরদিকে এ উপজেলাকে করেছে আরও আকর্ষনীয় ও সৌন্দর্যমন্ডিত। বর্তমানে এই কালুরঘাট সেতুটি জরাজির্ণ অবস্থায়। মেয়াদ শেষ হয়েছে আরো ১০বছর আগে। এই সেতুর কারণে বর্তমানে বোয়ালখালীর বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়নে একমাত্র অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে।

এই বোয়ালখালীর বাসিন্দাদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যুব বিদ্রোহ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অনেক অবদান রয়েছে। জন্ম হয়েছে জগদ্ধিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবীদ, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সংস্কৃতি সমীক্ষক, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, খ্যাতনামা চিকিৎসক, সাংবাদিক, জজ-ব্যরিষ্টার-উকিল ও ব্যবসায়ী। জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এমন প্রখ্যাত জনের সংখ্যাও একাধিক।

চট্টগ্রাম সিটি কপোররেশন জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বোয়ালখালী। ১৩৭.২৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এ উপজেলায় প্রায় তিন লক্ষ মানুষের আবাস।

-মো. তাজুল ইসলাম রাজু- সম্পাদক, আলোকিত বোয়ালখালী

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here