বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার ছিলেন বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন এর বিশ্বস্থ সহযোগী। ১৯৩০ সালের জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের প্রস্তুতি চলাকালে বোমা তৈরী করতে গিয়ে বিস্ফোরণে তারকেশ্বর ও অর্ধেন্দু দস্তিদার গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তারকেশ্বর দস্তিদারের শরীর এতটাই পুড়ে গিয়েছিল তিনি যন্ত্রনায় তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সঙ্গীয় বিপ্লবীরা গ্রামের বাড়ি নিয়ে গিয়ে দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় সুস্থ করে তুলেছিলেন আহত থাকার কারণেই তিনি চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে অংশ নিতে পারেননি। তবে সামান্য সুস্থ হলেই ফিরে আসেন ব্রিটিশদের আঘাত করার জন্য। মাস্টারদা সূর্যসেন গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি দলের দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরিকল্পনা করেছিলেন কিভাবে জেল থেকে মাস্টারদাকে মুক্ত করবেন। কিন্তু ব্রিটিশরা বিষয়টি আঁচ করতে পারল। হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল এই বিপ্লবীকে। তাই করণীয় ঠিক করতে গহিরা গ্রামে পূর্ণ তালুকদারের বাড়িতে গোপন মিটিং এ এসেছিলেন তারকেশ্বর। সাথে ছিলেন মনোরঞ্জন দাস, কল্পনা দত্ত সহ আরো অনেক ফেরারী বিপ্লবী। খবর পেয়ে পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে হাজির ব্রিটিশ পুলিশ। অস্ত্রের সামর্থ্যের পার্থক্যে টিকতে না পেরে মনোরঞ্জন আর গৃহস্বামী পূর্ণ ও তার ভাই নিশি তালুকদার শহীদ হলেন। গ্রেফতার হলেন তারকেশ্বর, কল্পনা সহ আরো কয়েকজন বিপ্লবী। ড. রমন নামে তাঁর লেখা বোমা তৈরীর একটি ফর্মুলা সহ খাতা পুলিশের কাছে জব্দ হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে বিচারের সময় উপস্থাপন করা হয়েছিলো।
তৎকালীন, ভারতীয় দন্ডবিধি ,১২১, ১২১(এ) – ৩০২/৩৪, ৩০২/১০৯ এবং ৩০৭ ধারা, ভারতীয় অস্ত্র আইন ১৯ (এফ) ধারা এবং ভারতীয় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের ৪ ও ৬ ধারায় সাজা প্রাপ্ত হন, মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদার । চট্টগ্রাম জেলা কারাগারেই তাঁরা মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামী হিসেবে ছিলেন। সারাদিন ধরে চললো তাঁদের উপর নির্যাতন। ব্রিটিশ সেনারা নির্মমভাবে হাতুড়ী দিয়ে হাত, পা, মুখমন্ডল সহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গে আঘাত করা হয়েছিল। হাতের পায়ের নখ তুলে ফেলা হয়েছিলো। তারকেশ্বর দস্তিদার জ্বরে আক্রান্ত হলেও জেলকোড বা বিধি না মেনে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিলো। নির্যাতন এতটাই ভয়াবহ ছিলো, তারা জ্ঞান হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলেন। যারা নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে দাবী করে এবং বিশ্বব্যাপী গনতন্ত্র শেখায়, আমাদের প্রজম্মকে জানাতে হবে এরাই সেদিন বিশ্বের সকল আইনকে অমান্য করে, জেল কোড ভঙ্গ করে মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের উপর অমানবিক নির্যাতন করে ফাঁসি পূর্বে।
১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারী রোজ শুক্রবার তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে রাত বারটা’য় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত, ফাঁসির মঞ্চে ঝুলে পড়লেন সূর্যসেন এবং তারকেশ্বর। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে বা পরে পরিবারের কারো সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি বা জানানো হয়নি পরিবারকে। তাঁদের মৃতদেহ দুটি সৎকারের জন্য পরিবারের কাছে না দিয়ে খুব ভোরে জেলখানা হতে ট্রাকে করে ৪ নম্বর স্টিমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষমান ব্রিটিশ জাহাজ “দি রিনাউন” এ তুলে বুকের সাথে বেঁধে দেওয়া হয়, বড় লোহার টুকরো। তাঁদের নিয়ে জাহাজটি বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর সংলগ্ন এলাকায় সাগরের গভীরে ভাসিয়ে দেয়। তাঁদের দেখানো পথ ধরেই আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। ২০১২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে (পূর্বের চট্টগ্রাম জেলা কারাগার) মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির মঞ্চ মাস্টারদা সূর্যসেন এর ম্যুরাল ও সংক্ষিপ্ত জীবনী লিখে সংরক্ষণ করেন। তখন থেকে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, শিক্ষক, সাংবাদিক , পেশাজীবি ও সুশীল সমাজ বিভিন্নভাবে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের ম্যুরাল মাস্টারদা সূর্যসেন এর পাশে স্থাপন করে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সংরক্ষণ করার দাবী জানিয়ে আসছে। এক্ষেত্রে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী সিঞ্চন ভৌমিকের অগ্রণী নেতৃত্বে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার পরিষদের এর আবেদনে জেলা প্রশাসক জনাব আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান এর সহযোগিতায় গত ৭ই আগস্ট ২০২৩ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনায়, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন নাম ও ম্যুরাল এর পাশে বিপ্লবী নেতা তারকেশ্বর দস্তিদার নাম ও ম্যুরাল স্থাপণের অনুমোদন দিয়ে পরিপত্র জারি করেন। যা প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার এর ম্যূরাল গতকাল স্থাপিত হয়েছে ও সংক্ষিপ্ত জীবনী স্থাপন প্রক্রিয়াধীন।
তারকেশ্বর দস্তিদার। চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার বিপ্লবতীর্থ সারোয়াতলী গ্রামে জম্মে ছিলেন তারকেশ্বর দস্তিদার ওরফে ফুটু দাদা, শহরের ফিরিঙ্গীবাজার এলাকার তাঁদের বাসস্থান ছিল। তবে তারঁ জীবনের বেশীরভাগ সময় গ্রামেই কাটিয়ে ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী দলে জড়িয়ে পড়েন। সারোতলীতেই ম্যাট্রিকুলেশান করে মেধাবী ছাত্র হিসেবে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর শিক্ষক বেণীমাধক দাশের আদর্শে এবং সতীর্থদের সংস্পর্শে নিজের অজান্তেই বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here