পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, গত বৃহস্পতিবার রাতে ‘ভিআইপি’ আসার অপেক্ষায় তিন ঘণ্টা ঘাটেই বসে ছিল ফেরিটি। পুলিশ, বিআইডব্লিউটিএ- কাউকে অনুরোধ করে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি সরকারি জরুরি সেবার ফোন নম্বর ৯৯৯ এ ফোন করা হলেও ফেরি ছাড়েনি।

সরকারের এটুআই প্রকল্পে দায়িত্বরত যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলের গাড়ি রাত ১১টার দিকে ঘাটে পৌঁছানোর পর ফেরি ‘কুমিল্লা’ রওনা হয়। কিন্তু মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষ (১১)।

এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছেন মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম।

নড়াইলের কালিয়া পৌর এলাকার তাপস ঘোষের ছেলে তিতাস কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ত। বৃহস্পতিবার বিকালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলে তাকে প্রথমে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়।

কিন্তু আঘাত গুরুতর হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে আইসিইউ সংবলিত একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তিতাসকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়েছিলেন স্বজনরা।

তিতাসের বড় বোন তন্নীসা ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অ্যাম্বুলেন্সটি কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে পৌঁছায় রাত ৮টার দিকে। কুমিল্লা নামে একটি ফেরি তখন ওই ঘাটেই ছিল। ফেরি ছাড়তে দেরি দেখে তারা ঘাট কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সাহায্য চান। কিন্তু ফেরি ছাড়েনি।

শেষ পর্যন্ত রাত পৌনে ১১টার দিকে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস ফেরিতে উঠলে ছাড়া হয় ফেরি। ফেরি ছাড়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই মাঝ নদীতে মারা যায় তিতাস।

তন্নীসা বলেন, “আমার ভাইয়ের জীবন কেড়ে নিল ভিআইপি।এ দেশে জীবনের দাম বেশি না, ভিআইপিদের দাম বেশি?”

তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ বলেন, “আমার বোন ফেরির লোকদের পায়ে ধরে মাটিতে পড়ে কেঁদেছে। তবু ওরা ফেরি ছাড়েনি। উল্টো বলেছে ফেরি ছাড়লে নাকি তাদের চাকরি থাকবে না।… তারা বলেছে ভিআইপি আসবে। আর আমাদের রোগী যে মরে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো নজর নেই। কোনো সহযোগিতা না পেয়ে দিলাম ৯৯৯ এ কল। কিন্তু সেখানেও কোনো কাজ হলো না।”

কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে বিআইডব্লিউটিসির কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তিতাসের স্বজনরা অনুরোধ করলেও মাদারীপুরের জেলা প্রশাসকের ‘জরুরি বার্তা’ পাওয়ায় ঘাট কর্তৃপক্ষ ফেরি ছাড়তে পারেনি।

ঘাটের ব্যবস্থাপক মো. সালাম হোসেন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিসি স্যার আমাকে জানান, ভিআইপি যাবেন। ফেরি যেন আগে না ছেড়ে যায়। তবে আমি তখন ঘাটে ছিলাম না। আমাদের স্টাফকে বলে দিই ভিআইপি আসার কথা। পরে সেখানে কী হয়, তা আমার জানা নেই।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নদীতে স্রোত বেশি থাকায় ফেরি পারাপারে এখন দ্বিগুণ সময় লাগে। তাছাড়া রাতে তেমন একটা ফেরি চলে না। তাই ঘাটে যানজট কমবেশি থাকেই। তবে আমরা অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি যাত্রীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পারাপারের ব্যবস্থা করে দিই।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল পিরোজপুর থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। তিনি কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়ার আগে আমার কাছে ফেরিতে যাওয়ার বিষয়টি জানান। পরে আমি ঘাটের ব্যবস্থাপক সালামকে জানাই।

“কিন্তু ওই ঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে একজন গুরুতর আহত রোগী আছে, তা আমি জানতাম না। ঘাটের ম্যানেজার এ বিষয় আমাকে কিছু জানাননি। পরে রোববার বিষয়টি জানতে পারলাম।”

সরকারি কর্মকর্তা বা ভিআইপিদের জন্য ফেরি বিলম্বিত করার কোনো নিয়ম আছে কি না জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, “তিনি (আবদুল সবুর মণ্ডল) চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া তিনি যুগ্ম সচিব। তাই তাকে ভিআইপি বলা যায়। এই ধরনের কর্মকর্তারা এই নৌপথে এলে তাদের বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।”

তিতাসের মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়ে যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এ বিষয়টি নিয়ে আমি বিব্রত এবং একই সাথে হতবাক। আমি যে কী পরিমাণ অস্বস্তির মধ্যে আছি, তা বলে বোঝাতে পারব না।

“আমি ফেরি আটকে রাখতে বলিনি। আমি শুধু বলেছি আমি যাব- একটা ব্যবস্থা করতে। আমার কাছে কোনো সিদ্ধান্তও জানতে চাওয়া হয়নি।”

অন্যদিকে নড়াইলে তিতাসের মা সোনামণি ঘোষের কান্না থামছেই না। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “বাবা তোমাগো কাছে বললে কী আমার পোলারে পামু? ওরা আমার পোলারে মেরে ফেলছে। আমি পায়ে ধরছি, তবু ওরা ফেরি ছাড়ে নাই। ফেরি ঠিক মতন গেলে হয়ত পোলাডা বাঁইচা যাইতো।”

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, ফেরীর বিলম্বের কারণে তিতাসের মৃত্যুর অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শহীদুল হক পাটোয়ারিকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে দিয়েছেন তিনি। ওই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

কমিটির বাকি তিন সদস্য হলেন- শিবচরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান, এএসপি সার্কেল মো. আবীর হোসেন এবং বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের এজিএম (মেরিন বিভাগ) এ কে এম শাজাহান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here