শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য আজকের দিনটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সকল পূর্ণিমা তিথিই কোনো না কোনো কারণে বৌদ্ধদের জন্য শুভদিন। প্রবারণা শব্দটি দিয়ে ‘আশার তৃপ্তি’, ‘অভিলাষ পূরণ’, ‘ধ্যান বা শিক্ষা সমাপ্তি’ বোঝানো হয়। এটা আত্মশুদ্ধি বা আত্মসমালোচনাকেও বোঝায়। আজকের দিনে ভিক্ষুরা হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে চারিত্রিক শুদ্ধির জন্য একে অন্যকে করজোড়ে বলেন, ‘বন্ধু, যদি আমার কোনোরূপ দোষত্রুটি দেখো বা কারও থেকে শুনে থাকো এবং এ কারণে যদি আমার ওপর সন্দেহ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে বলো, আমি তার প্রতিকার করব।’ বিনয় পিটকের পরিভাষায় একেই বলে ‘প্রবারণা’।
এ শুভতিথিতে ভগবান বুদ্ধ দেবলোক থেকে সাংকশ্য নগরে অবতরণ করেছিলেন। ভিক্ষুদের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রতাদি সম্পন্ন হলো আজকের দিনে। এ কারণে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধদের পরম পবিত্র দিন। আগামীকাল থেকে মাসব্যাপী প্রতিটি বৌদ্ধ গ্রামে পালাক্রমে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় শুরু হচ্ছে দানশ্রেষ্ঠ ‘কঠিনচীবর দান’। প্রবারণার কার্যসূচি শুরু হয় ভোর রাতে বিশ্বশান্তি কামনায় বিশেষ সূত্রপাঠের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি বৌদ্ধ বিহারে এ নিয়ম পালিত হয়। সকাল সাতটায় বিহার প্রাঙ্গণে উত্তোলন করা হয় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিহার প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে শিশু-কিশোরের কলকাকলিতে। সকাল ৯টা-১০টার মধ্যে শুরু হয়ে যায় বুদ্ধপূজা, উপাসক-উপাসিকা, দায়ক-দায়িকারা পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে কেউ কেউ অষ্টশীল গ্রহণ করবেন।
দিনের প্রথমভাগের কার্যসূচি শেষ হয় বেলা বারোটায়। দুপুর দুইটায় আজকের দিনের তাৎপর্য তুলে ধরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে স্ব-স্ব বিহারের অধ্যক্ষের সভাপতিত্বে। ভিক্ষুসংঘের পাশাপাশি গৃহীরাও ধর্মীয় আলোচনায় অংশ নেবেন। সন্ধ্যায় আলো ঝলমলে বাতি দ্বারা বিহারে করা হবে আলোকসজ্জা। তখন এক অনুপম দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রদীপ পূজার পাশাপাশি সকালের মতো প্রার্থনা সভাও অনুষ্ঠিত হবে। ছেলেমেয়েদের বাজি ফুটানো, ফানুস ওড়ানো ও বুদ্ধ কীর্তনে আনন্দে উল্লাস ধ্বনিতে দিনের কার্যসূচির সমাপ্তি ঘটবে। এখানে উল্লেখ্য, আজকের দিন থেকে ভগবান বুদ্ধের আদেশে আদিষ্ট ভিক্ষুসংঘ বুদ্ধবাণী প্রচার করে আসছে সাধারণ জনগণের হিতের ও সুখের জন্য।
এবার দানোত্তম ‘কঠিনচীবর দান’-এর বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করছি।
মাসব্যাপী শুরু হওয়া এ দানকে বৌদ্ধ সম্প্রদায় খুবই গুরুত্ব সহকারে পালন করবে। আশ্বিনী পূর্ণিমার পরদিন থেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত এক মাসের মধ্যে এ দান সম্পন্ন করার বিধান রয়েছে। অন্যান্য দানের সঙ্গে এ দানের তারতম্য এই যে, এ দান একটা বিহারে বছরে মাত্র একবার করতে পারে। উক্ত নির্ধারিত সময় ছাড়া অন্য সময়ে এ দান করতে পারে না। যে বিহারে ভিক্ষু প্রথম বর্ষা যাপন করেন সেখানেই তিনি এ দান গ্রহণ করতে পারবেন।
ভিক্ষুরা এক সঙ্গে তিনটি চীবর ব্যবহার করতে পারেন। সেগুলো হলো : উত্তরাসঙ্গ, সংঘাটি ও অন্তরবাস। উল্লিখিত এগুলোর যে কোনো একটা দিয়ে ‘কঠিনচীবর দান’ করা যায়। কঠিনচীবর দানের দিন অরুণোদয় থেকে পরদিন অরুণোদয় পর্যন্ত সময়ে সুতা কাটা, কাপড় বোনা, কাপড় কাটা (কর্তন), সেলাই ও রং করা প্রভৃতি কাজ উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে দান করতে হয়। বাংলাদেশের একমাত্র রাঙ্গামাটির রাজবন বিহার ছাড়া অন্য কোনোখানে এ নিয়মে কঠিনচীবর দান করা হয় না। রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারের সুযোগ্য অধ্যক্ষ প্রয়াত সাধনানন্দ মহাথেরোর (প্রকাশ বনভান্তে) একক প্রচেষ্টায় এবং সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের পূর্ণ সহযোগিতায় এখনো এ নিয়ম পালন অব্যাহত রয়েছে।
ইদানীং বাজার থেকে কাপড় ক্রয় করে কঠিনচীবর দান করা হয়। তবে এতে কায়িক, বাচনিক ও মানসিক অতিরিক্ত পুণ্য সঞ্চয় না-ও হতে পারে। এটাই কঠিনচীবর দানের বিশেষত্ব। তাই এ দানকে ‘দানশ্রেষ্ঠ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
চীবর তৈরি হলে ত্রিশরণসহ পঞ্চশীল গ্রহণ করে নিম্নোক্তভাবে তিনবার বলে ভিক্ষুসংঘকে চীবর দান করতে হয় : ‘ইমং কঠিন চীবরং ভিক্খুসঙ্ঘস্স দেমং, কঠিন অত্থরিতুং’। ভিক্ষুসংঘ উক্ত চীবর সীমায় নিয়ে বিনয় বিধান মতে বিহারবাসী ভিক্ষুকে প্রদান করেন। সেই বিহারে প্রথম বর্ষাবাসী অন্য ভিক্ষু থাকলে তা অনুমোদন করে কঠিনচীবরের পঞ্চফল লাভ করতে পারেন। তবে বর্ষাব্রত ভঙ্গকারী ভিক্ষু তা অনুমোদন ও পঞ্চফল লাভ করতে পারে না।
কঠিনচীবর দান প্রদানকারী এবং দান গ্রহণকারী উভয়ের ফল পুণ্যময়। কঠিনচীবর লাভের ভিক্ষুর পঞ্চফল এবং তিনি পাঁচটি দোষমুক্ত হন। কঠিনচীবরলাভী পঞ্চফলগুলো নিম্নরূপ :
ক. পূর্বাহ্নের জন্য নিমন্ত্রিত ভিক্ষুদাতার বাড়ি থেকে সহপাঠীর অপরাপর ভিক্ষুকে না বলে অন্যগৃহে গমন করতে পারে।
খ. যেই বিহারে কঠিনচীবর প্রাপ্ত হয় তা সমস্তই কঠিনচীবরলাভী ভিক্ষুরই অধিকার থাকবে।
গ. অধিষ্ঠিত ত্রিচীবর নিজের হস্তপাশে না রেখে অরুণোদয় পর্যন্ত থাকতে পারবে।
ঘ. অতিরিক্ত ইচ্ছানুরূপ অধিষ্ঠান কিংবা বেনামায় নিজের কাছে রাখতে পারবে ও
ঙ. চারজনের একাধিক ভিক্ষু নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে ভোজন করতে পারবেন। বিহারস্থ ভিক্ষুরা কঠিনচীবর অনুমোদনের পর আগন্তুক ভিক্ষুরা অনুমোদন করতে পারেন। মহাকারুণিক বুদ্ধ পাথ্যেয়কবাসী ত্রিশজন ভিক্ষুকে উপলক্ষ করে দানোত্তম কঠিনচীবর দানের প্রবর্তন করেছিলেন। বুদ্ধ এক সময় পঞ্চশত ষড়ভিজ্ঞ অরহত ভিক্ষুসহ আকাশপথে হিমালয়ে গিয়ে ‘অনবতপ্ত হ্রদ’ নামক মহাসরোবরে উপস্থিত হন।
সহস্র দল পদ্মে উপবিষ্ট হয়ে বুদ্ধ বললেন, ‘হে ভিক্ষুরা, নাগিত স্থবিরের মুখে কঠিনচীবর দানের মাহাত্ম্য শোনো’। অতঃপর নাগিত স্থবির বলতে লাগলেন আমি শিখি বুদ্ধের সময়ে বহুবিধ পুণ্যকর্মসহ উত্তম পুণ্যশ্রেষ্ঠ সংঘমধ্যে কঠিনচীবর দান দিয়ে এই কল্প থেকে বিগত ত্রিশকল্প পর্যন্ত দুর্গতি অনুভূতি করিনি। আঠারকল্প দেবলোকে দিব্যসুখ ভোগ করেছি। চৌত্রিশবার ইন্দ্র হয়ে দেবকুলে রাজত্ব করেছি। অজস্রবার ঐশ্বর্যশালী ব্রহ্মা হয়েছি। কোথাও আমার ভোগসম্পদের অভাব হয়নি। যেখানে জন্মগ্রহণ করি না কেন সেখানে সম্পত্তিলাভের কোনো কমতি থাকত না। যে ফলগুলোর কথা বললাম সবগুলোই একমাত্র কঠিনচীবর দানের ফল।
নাগিত স্থবিরের ভাষণ শেষ হলে ভগবান বুদ্ধ পুনঃ কঠিনচীবর দানের ফল ব্যাখ্যা করেন ‘হে ভিক্ষুরা শিখিবুদ্ধের সময় সনজয় ব্রাহ্মণ হয়ে কঠিনচীবর দান করেছিলাম। তার মহাফল বুদ্ধত্বপ্রাপ্তি পর্যন্ত ভোগ করেছি। অষ্ট পরিষ্কারাদি অন্যান্য যাবতীয় দানীয় সামগ্রী শত বছর ধরে দান দিলেও কঠিনচীবর দানের ষোলভাগের একভাগের সমান হবে না।’ বুদ্ধ, প্রত্যেক বুদ্ধ ও মহাশাবকরা কঠিনচীবর দানের ফলপ্রাপ্ত হয়ে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেছেন। যিনি শ্রদ্ধা সহকারে কঠিনচীবর দান করেন তার ফল তিনি প্রয়োজনে বিস্তৃত কনক বিমান, সহস্র অপসরা এবং মণিমুক্তা বৈদুর্য্য এবং কল্পকর্ম প্রভৃতি সম্পদ এবং দিব্যপুষ্করিণী লাভ করেন। এটার পঞ্চফল যুক্ত এবং পঞ্চ দোষ বিবর্জিত। এই কঠিনচীবর দানের কথা ভগবান দেশনায় বলেছেন, এটার ফল অসংখ্য ও অপ্রেময়। সুতরাং প্রত্যেকের জীবনে অন্তত একবার কঠিনচীবর দান করা একান্ত প্রয়োজন। এটা ভবিষ্যতে মহাফল দান করে।
শেষ কথা : এ মহাপুণ্যময় দিনে বুদ্ধবাণী স্মরণ ছাড়া আর কোনো অবস্থায় দেশ সংঘাতমুক্ত হতে পারে না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যে যার অবস্থানে থেকে দেশের মঙ্গলময় ভবিষ্যৎ রচিত করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলে মনে করি। কারণ ধর্ম মানে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন। সুশৃঙ্খল জীবনযাপনই পারে দেশের কল্যাণ বয়ে আনতে। এতে প্রয়োজন সচেতনতা। নিজের বিবেকবোধকে সৎপথে চালিত করে অন্যকেও এপথে আসার জন্য উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জোগাতে পারলে পরিচ্ছন্ন এবং পাপমুক্ত দেশ আমরা আগামী প্রজন্মকে উপহার দিতে পারব। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
-দেশ রূপান্তরের সৌজন্যে