কুন্তুলা দাস

বড় দিদি সেদিন একটা সুন্দর লেখা লিখেছে নিজের ডায়রিতে, “এবাড়ি ওবাড়ি সেবাড়ি” নাম দিয়ে। সেটা পড়ে থেকেই ভাবছিলাম আমার ছোটবেলার দাসপাড়ার ভাড়া বাড়িটাকে নিয়েও কিছু একটা লিখলে হয়। সে বাড়িটাকে অবশ্য এবাড়ি, ওবাড়ি বা সেবাড়ি বলতামনা আমি। সেটা ছিল শুধুই আমার বাড়ি।
দেড়শ-দুশ বছরের বিরাট বাড়িটায় থাকার ঘর কিন্তু ছিল মাত্র তিনটে। একটা দাদুর ঘর, একটা আমাদের “সেই ঘর” আর একটা ঠাকুরঘর। এ ছাড়া একটা রান্নাঘর, একটা ভাঁড়ার ঘর, একটা বাথরুম আর একটা গুদোম ঘরও ছিল বটে, কিন্তু সেগুলোকে তো আর ঘর বলে ধরা যায়না, যতই আমার এখনকার লিভিং রুম বা বেডরুম এর থেকে বড় হোক না কেন। তাই আমরা তিনটে ঘরই গুনতাম।
রাস্তা থেকে ছোট লোহার গেট খুলে ঢুকলে বাগান, সে বাগানের বাঁ দিকে বাড়িটা আর ডান দিকে পাঁচিলের ওপারেই বিরাট পুকুর, যে পুকুরে খোলামকুচি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ব্যাঙবাজি করতাম আমি বাগান থেকেই। বাগানে নারকোল, সুপুরি, আর রকমারি ফুলগাছ। তারপর বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রকান্ড লম্বা বারান্দা, যার অর্ধেকটা কালো আর বাকি অর্ধেকটা কটা রঙের মেঝে। এই বারান্দাটা ছিল আমাদের ক্রিকেট খেলার পিচ। বারান্দার ডান দিকে উঠোন, যেখানে বিশাল বিশাল টবে রকমারি গাছ ছিল, মানুষ-সমান ক্যাকটাস থেকে শুরু করে এক পাশে দোতলা সমান উঁচু একটা শিউলি গাছ পর্যন্ত। আর ছিল একটা জলের চৌবাচ্চা, একটা পাতকুয়ো আর একটা হ্যান্ডপাম্প, যেটাকে আমরা বলতাম টিউব ওয়েল। এই উঠোন আর তার চারিদিক ঘিরেই ছিল আমার ছোটবেলার খেলার জায়গা। ওই কটা গাছের টব আর একটা টিউব ওয়েল নিয়ে দিনের পর দিন কি করে কাটাতাম কে জানে। এখন তো একটা স্মার্টফোন আর একটা ল্যাপটপ সঙ্গে থাকলেও যদি ইন্টারনেট কানেকশনটা না থাকে তাহলে “বোর” লাগে।
অবশ্য শুধু উঠোনে খেলতাম বললে ভুল হবে, কারণ খেলতাম আমি সারা বাড়িতেই। দাদুর ঘরের জানালায়, সেই ঘরের বিছানায়, ঠাকুর ঘরের খাটে, তার সামনের দালানটায় পড়ে থাকা রাশি রাশি ভাঙ্গা আসবাবপত্রের মধ্যে। আমার খেলার সঙ্গী ছিল ওপরের বুবানদাদা, আর কখনও কখনও আমার পিসতুতো দাদা আনন্দ। দোতলার ছাদেও খেলতে যেতাম আমরা। কুমির-ডাঙ্গা, দোকান-দোকান, জাহাজ-জাহাজ, এইসব খেলা। এখনকার বাচ্চারা শুনলে হেসেই খুন হয়ে যাবে। ও বাড়ির দেওয়াল গুলো ছিল বেজায় মোটা, জানালাগুলো খুললে পাল্লাগুলো দেওয়াল  ছাড়িয়ে বাইরে আসতনা। শিক দেওয়া একতলার জানালাগুলো উচ্চতায় ছিল রাস্তায় দাঁড়ানো লোকের মাথার ওপর। দাদুর ঘরে পুকুরের দিকের জানালাটা দিয়ে হাওয়া এসে জানালায় ঝোলানো উইন্ড চাইম টাতে মিষ্টি টুং টাং আওয়াজ করত। তখন এরকম ফেং শুই এর হিড়িক ছিলনা, উইন্ড চাইমও ছিলনা ঘরে ঘরে। ওটা দাদুর এক ছাত্র এনে দিয়েছিল বিদেশ থেকে।
দাদুর ঘরটা ছিল দাদুর পড়ানোর ঘর, শোবার ঘরও। সকালে দাদু গঙ্গার ধার থেকে ফেরার পর থেকেই দলে দলে ছাত্র-ছাত্রী আসা শুরু হত। তার ফাঁকে ফাঁকে অন্য লোকও। আমি তাদের মাঝেও খেলা করতাম, বেশি শোরগোল না করে। দাদুর পড়ানো মোটেই কড়া মাস্টারমশায়ের ক্লাসের মত ছিলনা, সেখানে ছাত্ররা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করত। খেলা থাকলে টিভি চলত। প্রথম দিকে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট , পরের দিকে কালার। রবিবার সকালে সদর দরজার ওপর টাঙানো বড় দম দেওয়া ঘড়িতে ঢং ঢং করে নটা বাজার একটু পরেই একজন দুজন করে পাড়ার লোক আসা শুরু হত কালার টিভিতে রামায়ন দেখার জন্য।
আমাদের, মানে আমার, বাবার আর মায়ের শোবার ঘর ছিল “সেই ঘর”, যেটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি। সারাক্ষণ লোকের ভিড় থাকতনা, কিন্তু এ ঘরের শোকেসেই থাকত আমার সব খেলনা, আর নানান রকমের ইন্টারেষ্টিং জিনিস, যেগুলো দেখে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম। এই এত্ত বড় প্রবালের ঝাড়, নানা মাপের ঝিনুক, মাটির প্যাঁচা, রং করা মাটির পশুপাখি, ডোকরার কাজ করা পেতলের হাতি, আসল আর পোড়ামাটির নকল শাঁখ, যার দুটোই বাজানো যায়, শোলার বর কনে, ফোলানো স্পঞ্জের ফ্রক পরা পুতুল, দম দেওয়া গুবরেপোকা, রুবিক্স কিউব, আরও কত কি। তুলনামূলক ভাবে ঠাকুরঘরে তেমন কিছু থাকতনা। কিন্তু ঠাকুরঘরটাই সবথেকে নিরিবিলি বলে পরে ও ঘরটা আমার গল্পের বই পড়ার জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। বইয়ের তো অভাব ছিলনা সারা বাড়িতে, অনেক বইয়ের দোকানেও অত বই থাকেনা।
বয়েসের ছাপ পড়েছিল বাড়িটার সারা গায়ে। দেওয়ালে নোনা ধরে দাগ হয়েছিল, ছাদের প্লাস্টার খসে গিয়ে আবার সারানো হয়েছিল, কড়ি বর্গায় উইপোকার আঁকিবুকি। আমি তার মধ্যেই পরিচিত ছবি, দেশ-বিদেশের ম্যাপ খুঁজে নিতাম। দাদুর ঘরের কালো মেঝের তলা থেকে বুদবুদ উঠে মেঝের ওপর একটা ঢিপি মতন তৈরী হয়, আমি সেইটার ওপর বসে খেতাম, টিভি দেখতাম। আমরা সে বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়িতে চলে আসার পরে দেখেছি রংচং করে বিয়েবাড়ির জন্য ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিছুদিন পাগলাগারদও হয়েছিল নাকি। বাকি সময়টা বন্ধই পড়ে থাকত বিশাল বাড়িটা।
এবারে এসে জগুদাসপাড়ায় ঢুকে চমকে গেলাম। কোথায় আমাদের বাড়ি? সে জায়গায় একটা খালি জমি, যেটাকে “মাঠ” বলা চলে স্বচ্ছন্দে। সেখানে হাল ফ্যাশনের ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরী হচ্ছে, তাতে পুকুরের দিকে ক্যাপসুল লিফট বসবে, আর প্রতি ফ্ল্যাটে এল ই ডি টিভি। অবশ্য সে টিভি দেখতে পাড়ার লোক ভিড় জমাবেনা। দেখলাম ও পাড়ায় আর আসে-পাশের পাড়াতেও চতুর্দিকে কেটে ফেলা নারকোল গাছের গোড়া, আর ভিত খুঁড়ে বের করা মাটির স্তুপ। যে বাড়িটার সঙ্গে আমার, এবং আমার বাবার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িত, সে বাড়িটার আর স্মৃতির বাইরে কোনও অস্তিত্বই নেই। আছে শুধু কয়েকটা পুরনো ফটো, যেগুলো ইচ্ছে হলেই ধুলো ঝেড়ে দেখা যাবে, আর আছে কিছু স্বপ্ন, যেগুলো ইচ্ছে অনিচ্ছের ধার ধারেনা।
কারণ দাসপাড়ার বাড়িটা ছেড়ে নতুন বাড়িতে আসার ২১ বছর পরেও আমার বাবা মা স্বপ্নে বাড়ি দেখলে ওই বাড়িটাই দেখে শুধু, নতুন বাড়িটা নয়।
লেখাটি: ই-মেইল-এ প্রাপ্ত, এবি/টিআর ৪/৬/২০১৯
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here