রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী
চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার কড়লডেঙ্গা পাহাড়ের পাদদেশে জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ঐ গ্রামের ‘সেন বাড়ী’তে বসে আকাশবাণীর খবরে জানতে পারলাম ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ এ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্র বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পরাজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করবে। অর্থ্যাৎ আক্ষরিক অর্থে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিপাগল ৭ কোটি বাঙ্গালীর দীর্ঘ ২৫ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম সর্বশেষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সফল সমাপ্তি। যার জন্য ৫২’র ভাষা আন্দোলনে সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে বাবুল, শাহজাহান, ৬৪’র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রুখতে গিয়ে পুরনো ঢাকার আওয়ামী লীগ নেতা আমীর হোসেন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আদমজীর শ্রমিক মনু মিঞা, ৬৮/৬৯ এর অভূতপূর্ব ছাত্র গণ আন্দোলনে আসাদ, রুস্তম, মতিযুর, আনোয়ারা বেগম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জ্জোহা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হকসহ অসংখ্য ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষকের আত্মদান ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
সর্বশেষ ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙ্গালী শহীদ ও ৩ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম লুট হয়েছে। অতএব আকাশবানী ও বিবিসি’র খবর শোনার পর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিপাগল বাঙ্গালীর অনুভূতি কি ছিল তা এত দীর্ঘ সময় পর ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। সেদিন যারা যুদ্ধক্ষেত্রে ছিল হয়তো তারা কিছুটা অনুভব করতে পারে। তবে তাকেও আজকের এই বার্ধক্য ছেড়ে প্রায় ৪৯ বছর আগের যৌবনে ফিরে যেতে হবে। ৬২ থেকে স্বপ্ন দেখতাম একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মাতৃভূমির একটি পতাকা, একটি দেশের মানচিত্র। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ মাত্র একটি রাত শেষে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে। তারপরই সেই স্বপ্নের সফল বাস্তবরূপ।
যা হোক, এখন মূল কথায় ফিওে যাই। বোয়ালখালী থানা সদর গোমদন্ডীতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা উত্তোলনের কাহিনী। আকাশবানী ও বিবিসি’র খবর শোনার পর জাতীয় পতাকা তৈরীর কাজে লেগে গেলাম। গাঢ় সবুজ কাপড়ের মাঝখানে টকটকে লাল বৃত্তের উপর সোনালী মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরী অনেকটা কঠিন ছিল। পতাকার কাপড় কিভাবে যোগাড় করবো তা চিন্তায় পড়ে গেলাম। পাঞ্জাবী সৈন্য আর তাদের এদেশীয় দোসর আলবদর/রাজাকারেরা দোকান-পাট সব জ্বালিয়ে পড়িয়ে ছারখার কওে দিয়েছে। দু’একটা যা ছিল তাও আবার বন্ধ। শেষ পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে রাউজান থানার লাম্বুরহাট থেকে অনেক কষ্টে বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম ইসহাক চৌধুরী কাপড় যোগাড় করে আনে।
এস.এম ইসহাক চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় কিছু যুবকদের নিয়ে একটি গ্রুপ গঠন করে তার নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে। কাপড় আনার পর এবার বাংলাদেশের মানচিত্র কিভাবে হলুদ কাপড় দিয়ে তৈরী করা যাবে লোক খুঁজতে থাকি। তাও পেয়ে গেলাম। প্রভাষ পালিত ও চিত্তরঞ্জন পালিত পতাকা অংকন করতে পারে। তাদের বাড়ী পোপাদিয়া গ্রামে। লোক পাঠিয়ে তাদের ডেকে আনা হল। তারা খুশী মনে মানচিত্র অংকন করলেন প্রথমে কাগজে। সেই কাগজ হলুদ কাপড়ের উপর বসিয়ে মানচিত্রের কাঠামো কাটা হল। আমাদের আশ্রয়স্থলের সন্নিকটে একটি দর্জির দোকান ছিল। তার নাম শশাংক। বাড়ী জ্যৈষ্টপুরা গ্রামে। গাঢ় সবুজ কাপড়ের মাঝখানে লাল বৃত্তের উপর সোনালী হলুদ কাপড়ের মানচিত্র সেলাই করে শশাংক বাবু স্বপ্নের পতাকা বানালেন। আমার বাহিনীর সকলকে নির্দেশ দেওয়া হলো পরদিন (১৬ ডিসেম্বর’ ৭১) ভোরে উঠে সবাই প্রস্তুত হয়ে নিতে।
পতাকা হাতে রোডমার্চ করে থানা হেড কোয়ার্টারে গিয়ে পতাকা উত্তোলন করতে হবে। পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য বাশেঁর খুটি যোগাড় করে রাখা হলো। কথামত পরদিন সকালে সবাই তৈরী হয়ে নিলাম। আমার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা হলো সেকেন্ড ইন কমান্ড (২সি) মোঃ ফিরোজ, সদস্য মৃদুল দাশ, অনিল সিংহ, শরৎ চন্দ্র বড়ুয়া, মাস্টার ছগির আহমদ, সুনীল বড়ুয়া, জানে আলম ও রফিকুল আলম। ঠিক সকাল ৭টায় গাঢ় সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝখানে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা বাশেঁর মাথায় তুলে ধরে সবাই ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে প্রায় শ’খানেক জনতাকে সাথে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দীর্ঘ ৯ মাসের ঠিকানা ঐতিহাসিক ‘সেন বাড়ী’ থেকে রওয়ানা হলাম বোয়ালখালী থানা সদর সি.ও অফিসের দিকে। সেন বাড়ী থেকে সি.ও অফিসের দুরত্ব প্রায় ৮/৯ কিলোমিটার।
শ’খানেক মুক্তিপাগল লোক নিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম তা ততই এগুতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে। সকাল ১১টা নাগাদ আমরা যখন থানা হেডকোয়ার্টারে পৌঁছি তখন আমাদের পেছনে দেখি ৬/৭ হাজার মুক্তিপাগল জনতা। সি.ও অফিসের সামনের মাঠে আগে থেকেই ২/৩ হাজার লোকে জড়ো হয়েছে। আমাদের বিজয় মিছিল সি.ও অফিসের গেইট দিয়ে যখন প্রবেশ করছিল তখন আগে থেকেই উপস্থিত জনতা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানের মাধ্যমে আমাদের অভিনন্দন জানায়। শ্লোগানে শ্লোগানে সমস্ত আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। আমরা অস্ত্র উঁচিয়ে জনতার অভিবাদনের জবাব দিচ্ছিলাম।
আমার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে থানা হেডকোয়ার্টারে সি.ও সাহেবের কার্যালয়ের সম্মুখস্থ দোতলায় ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডের সামনে জাতীয় পতাকা হাতে আমরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই। দীর্ঘ ৯ মাস পর জনতার উদ্দেশ্যে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখি। তারপর ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ জাতীয় সংগীতের মধ্যে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডে আমি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি। বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড (২সি) মোঃ ফিরোজের নেতৃত্বে পতাকা উত্তোলনে বিএলএফ’র সদস্যরা ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। এসময় উপস্থিত ৭/৮ হাজার জনতা ‘জয় বাংলা শ্লোগানের মাধ্যমে পতাকার উদ্দেশ্যে অভিবাদন জানায়। তখন থানা হেডকোয়ার্টারে এফ.এফ’র কোম্পানী কমান্ডার মোঃ আবুল বশর, প্লাটুন কমান্ডার মাহাবুবুল আলম চৌধুরী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম ইসহাক চৌধুরীসহ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারবৃন্দ ও বহু মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলেন।
শুধু তাই নয়, ৩১ জানুয়ারী ১৯৭২ ইংরেজি মুজিব বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণ (বঙ্গবন্ধুর হাতে) না করা পর্যন্ত থানা হেডকোয়ার্টারে মুজিব বাহিনীর কার্যালয়ের সম্মুখে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রতিদিন জাতীয় সংগীত ও গার্ড অব অনারের মাধ্যমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও সূর্যাস্তে একই নিয়মে পতাকা নামানো হতো। আজ ৪৯ বছর পর সেদিনের উপস্থিত সাথীদের অনেককে হারিয়েছি। সেদিন উপস্থিত জনতার অধিকাংশই আজ আর নেই।
২০২০ সালের ডিসেম্বর এই বিজয়ের মাসে তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং তাঁদের আত্মার সদগতি কামনা করছি। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আবেদন জানাচ্ছি তারা যেন ৭১’র মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের স্মরণে রাখে কথায় ও কাজে। ১৬ ডিসেম্বর ৭১’ উড্ডীয়মান জাতীয় পতাকার সম্মান তারা অক্ষুন্ন রাখবে। ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘজীবি হউক, বিজয় দিবস দীর্ঘজীবি হউক।
লেখক– রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী, মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বি.এল.এফ-এর বোয়ালখালী থানা প্রধান, মুক্তিযুদ্ধপূর্ব জয়বাংলা বাহিনীর বোয়ালখালী থানা প্রধান, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বোয়ালখালী থানা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, স্যার আশুতোষ কলেজ ছাত্রলীগ আহবায়ক কমিটির আহবায়ক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ৬৮-৬৯’র ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বোয়ালখালী থানা শাখার আহবায়ক এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারস’৭১ ফোরাম’র বোয়ালখালী উপজেলার আহবায়ক।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here