স্বদেশ রায়
২৫ মার্চ ২০২১, ১০:০০
এখন বাস্তবতা এমনও যে, বাইরের থেকে যদি কেউ ভুল তথ্য দিয়ে একটি মতামত কলাম পাঠান, ওই তথ্য সঠিক করার মতো লোকটিও অনেক স্থানে নেই। তাই দেখা যায়, হরহামেশা ভুল তথ্যে ভরা মতামত কলাম ছাপা হয়। এমনি নানান কারণে আজ সংবাদপত্রের মতামত কলাম জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দুই-ই হারাচ্ছে

সম্প্রতি একজন সম্পাদক মারা গেলে সকাল থেকেই দেশের অনেক অনলাইন পোর্টাল, দৈনিকের পোর্টাল ভার্সন ও টেলিভিশনে তার মৃত্যুর খবর যাওয়ার পরেও অবিরাম দেশ ও বিদেশ থেকে ফোন আসতে থাকে। তাদের প্রশ্ন, ভদ্রলোক কীভাবে মারা গেলেন তা নয়। তাদের প্রথম প্রশ্ন, খবরটি কি সত্য? যেকোনো সাংবাদিকের জন্য এ শুধু বিব্রতকর নয়, অনেক কষ্টের। কারণ, সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর প্রকাশিত হওয়ার পরেও যখন পাঠক ফোন করে জানতে চায়, ঘটনাটি সত্য কি না? আর এমন প্রশ্নের মুখোমুখি এখন সাংবাদিকদের প্রায়ই হতে হচ্ছে। এবং এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, সংবাদমাধ্যম অনেকখানি এমনই প্রশ্নের মুখোমুখি।

কেন এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলো, এর উত্তর খোঁজা একটি দীর্ঘ গবেষণার বিষয়। তবে তারপরেও একজন সাংবাদিক হিসেবে সাধারণ চোখেও অনেক বিষয় দেখতে পাই, আজকের এ অবস্থার জন্য। কেন মানুষ এখন সংবাদমাধ্যমকে শতভাগ বিশ্বাস করে না। অথচ পাকিস্তান আমলেও কোনো কিছু ছাপার অক্ষরে দেখলে সেটাকে বাইবেলের শব্দের মতোই সত্য মনে করত। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া শুরু হয় স্বাধীনতার পর থেকে। স্বাধীনতার পর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সমর্থিত ‘হক কথা’ এবং জাসদ সমর্থিত ‘গণকণ্ঠ’ই প্রথমে ছাপার অক্ষরে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য প্রকাশ শুরু করে। আর বলা যেতে পারে, এর ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের সাংবাদিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু হয়। এর পরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সামরিক শাসকরা কিছু পত্রপত্রিকা বের করার জন্য নানান সরকারি এজেন্সি থেকে অর্থ দেয়। সেই অর্থে বের হওয়া পত্রপত্রিকাগুলোর কাজই ছিল বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও তাঁর শাসনামল নিয়ে নানান অপপ্রচারমূলক তথ্য প্রকাশ করা। এর পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা। এই কাজের ভেতর দিয়ে ‘হক কথা’ ও ‘গণকণ্ঠের’ সেই মিথ্যা তথ্য প্রকাশের ধারা চলতে থাকে। তবে তারপরেও মূলধারার পত্রপত্রিকাগুলোর সংবাদের ওপর তখনো মানুষের বিশ্বাস অটল ছিল। তবে বাংলাদেশের সামরিক শাসনামলে বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় বাংলাদেশ বেতার (যা তত দিনে রেডিও বাংলাদেশ হয়ে গেছে) এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। যে বিশ্বাসযোগ্যতা আর ফিরে আসেনি। গ্রামবাংলায় শুধু নয়, গোটা দেশ একসময়ে রেডিওর সংবাদ বিশ্বাস করত বিনা প্রশ্নে। কিন্তু সামরিক শাসনামলে সে বিশ্বাস নামতে নামতে এমন পর্যায়ে গেল, মানুষ আবহাওয়ার খবর অবধি বিশ্বাস করতে দ্বিধান্বিত হতো। মানুষের তখন একমাত্র আস্থায় ছিল সংবাদপত্রগুলো। সংবাদপত্রগুলোর ওপর তখন নানান ধরনের সেন্সরশিপ ছিল, কিন্তু তারপরেও নানান কৌশলে সাংবাদিকরা সেদিন সত্য ও নিশ্চিত তথ্য প্রকাশ করার চেষ্টা করতেন।

এই ধারা পাল্টাতে শুরু করল ১৯৯০-এর পর থেকে। এরশাদের পতনের পর থেকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্টে কিছু পরিবর্তন এনে পত্রিকা প্রকাশের অনুমতি নেয়া আরো সহজ করে দেন। যদিও আগের দুই সামরিক সরকারের আমল থেকে একটি অদ্ভুত বিষয় শুরু হয়েছিল, কোনোরূপ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ছাড়া নানান ধরনের আলু-পটলের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কন্ট্রাক্টররা সম্পাদক হিসেবে পত্রিকার ডিক্লারেশন পাওয়া শুরু করে। এবং তারা রাতারাতি সম্পাদক ও প্রকাশক বনে যান। আর তাদের হাত দিয়ে নষ্ট হতে শুরু করে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান বা এডিটরিয়াল ইনস্টিটিউট। সে সময়ে এই এডিটরিয়াল ইনস্টিটিউটকে রক্ষা করার জন্য সাংবাদিক সমাজ একটি দায়িত্বশীল আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের দাবি ছিল সরকারের কাছে- পনেরো বছরের সক্রিয় সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ সম্পাদক হতে পারবেন না। এবং সম্পাদককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।

সাংবাদিকদের এই আন্দোলন শেষ হয়ে যায় ১৯৯১-এর নির্বাচনের ভেতর দিয়ে জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসার পরে। জামায়াত-বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসার পরে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদার সক্রিয় সহযোগিতায় কিছু সুবিধাভোগী সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতা সাংবাদিকদের ইউনিয়নকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেন। তখন স্বাভাবিকই এক ভাগ আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাংবাদিক ইউনিয়ন হয়ে যায়, অন্য ভাগ বিএনপি-সমর্থিত সাংবাদিক ইউনিয়ন হয়ে যায়। বলা যেতে পারে, এখান থেকেই বাংলাদেশে সৎ রাজনৈতিক সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটে। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিএনপি-সমর্থিত সাংবাদিকদের বিএনপির কর্মীর মতো বিএনপি বা তাদের সহযোগীদের রিপোর্ট করা। আর আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগ কর্মীর মতো আওয়ামী লীগের ও তাদের সহযোগীদের রিপোর্ট করা। অন্যদিকে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়ায় এই ধারা বন্ধ করার কথাও কেউ মনে করেননি বা এ কাজের দিকে নজরও দেননি।

শুধু এখানেই শেষ নয়। যেকোনো সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান এ সত্য স্বীকার করে, তথ্য পবিত্র। তা পরিবর্তন, পরিমার্জন বা বিকৃত বা আংশিক প্রচারের অধিকার কারো নেই বা সেটা কখনো সম্পাদকীয় নীতি হতে পারে না। তবে মতামত সব সময়ই উন্মুক্ত। অর্থাৎ যেকোনো সংবাদপত্রে যে কেউ তার স্বাধীন মতামত লিখতে পারবে। তবে একটা কথা এখানেও সত্য, স্বাধীন মতামত কখনো আইনের বাইরে নয় এবং কোনো অসত্য ও বিকৃত মতামত প্রচার নয়। স্বাধীন মতামত কখনো দেশবিরোধী, দেশের ইতিহাস বিকৃতির পক্ষে, নারী উন্নয়ন, নিম্নবর্গীয় মানুষ, শিক্ষায় পশ্চাৎপদ মানুষের বিপক্ষে হতে পারে না। এখানে যে কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির সমর্থনে তার মতামত প্রকাশ করতে পারবেন। তবে কখনোই কোনো অসত্য, বিকৃত ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোনো মতামত মিডিয়ায় প্রকাশযোগ্য হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা গেল, মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে রাজনৈতিক মতামত কলামে একশ্রেণির লেখক তথ্যের বিকৃত করে তার মতকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বা করছেন। অথচ কখনোই কোনো মতামত কলামে কেউ অসত্য বা ভুল তথ্য প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে এটা হরহামেশাই ঘটতে থাকে। যার ফলে একসময়ের কলাম লেখকদের যেমন সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, সেটা কমে যায়। তার বদলে তারাও দলীয় রাজনীতিকরা যেমন নিজ নিজ দলের কর্মীর কাছে জনপ্রিয় থাকেন। এবং তাদের বক্তব্য শুনতে শুধু তাদের কর্মীরা জনসভায় আসেন। এই মতামত লেখকদেরও একই অবস্থা হয়। যিনি যে রাজনৈতিক দলের পক্ষের মতামত কলাম লেখেন, ওই দলের লোকেরাই শুধু সেটা পড়েন এবং তৃপ্তি পান। এই তৃপ্তি অনেকটা কুকুরের শুকনো হাড় চিবানোর মতো। অর্থাৎ কুকুর যখন শুকনো হাড় চিবায়, তখন তার নিজের দাঁতের গোড়া দিয়েই একধরনের রক্তরস বের হয়। সেটার স্বাদ পেয়েই কুকুর মনে করে সে একটা সুস্বাদু খাবার খাচ্ছে।

এ ছাড়া ’৯১-এর পর থেকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে মতামত কলামে আরেকটি পরিবর্তন আসে, যা মতামত কলামকে আরো দলীয় ও স্বার্থকেন্দ্রিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয়। বাস্তবে ’৯১-এর আগে পেশাদার সাংবাদিকরাই কলাম লিখতেন। তারা তাদের লেখায় সাংবাদিকতাকে ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। ’৯১ থেকে দলীয় লোক দিয়ে কলাম লেখানো শুরু হয়। আগে যেখানে এক্সপার্টদের দিয়ে বিশেষ সময়ে বিশেষ লেখা লেখানো হতো, সেখানে স্থান পায় দলীয় লোক বা কোনো না কোনো দল-সমর্থক অবসরপ্রাপ্ত সিভিল অথবা মিলিটারি আমলা। যার ফলে সংবাদপত্রের অপিনিয়ন বা মতামত ইনস্টিটিউটটিও ভেঙে পড়ে। আর এ সময়ে দুটি ঘটনা ঘটে। এক. প্রয়োজনীয় সাংবাদিক দেশে তৈরি হওয়ার আগেই প্রচুর পত্রপত্রিকা হয়ে যায়। যার ফলে পেশাদার মতামত লেখকও কমে যান। তা ছাড়া সংবাদপত্রগুলো কেন যেন এই প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে ফেলে। এমনকি সংবাদপত্রের ওয়েজ বোর্ডও এমনভাবে তৈরি হয়, তাতে একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির পক্ষে ওই বেতনে চাকরি করা সম্ভব হয় না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে বাধ্য হন। সংবাদপত্রের এই পেশাদার কলাম লেখকদের সাধারণভাবে সহকারী সম্পাদক পদটি দেয়া হতো। পঞ্চাশের দশকে ‘আজাদ’-এ একজন সহকারী সম্পাদক যে বেতন পেতেন, তার স্বর্ণমূল্য হিসাব করলে সে সময়ের বাজারে দশ ভরি সোনার মূল্যমান হতো। এখন একজন সহকারী সম্পাদক যা বেতন পান, তা স্বর্ণমূল্যে বর্তমান বাজারে দুই ভরি সোনার মূল্যমানও নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো কম। যার ফলে খুব উচ্চশিক্ষিতরা এখন আর এই পদে আসতে চান না। অথচ আগে সরকারি চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ত্যাগ করে প্রজ্ঞাবানরাই এ পদে চাকরি নিতেন। যার ফলে এখন বাস্তবতা এমনও যে, বাইরের থেকে যদি কেউ ভুল তথ্য দিয়ে একটি মতামত কলাম পাঠান, ওই তথ্য সঠিক করার মতো লোকটিও অনেক স্থানে নেই। তাই দেখা যায়, হরহামেশা ভুল তথ্যে ভরা মতামত কলাম ছাপা হয়। এমনি নানান কারণে আজ সংবাদপত্রের মতামত কলাম জনপ্রিয়তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দুই-ই হারাচ্ছে।

এই অপিনিয়ন প্রচার নব্বইয়ের দশকের পর থেকে শুরু হওয়া বেসরকারি টেলিভিশনে টক শোর নামে এসেছে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে, সঠিক তথ্য প্রচারের  বা অ্যাকাডেমিক আলোচনার থেকে দলীয় ঝগড়া রাজনৈতিক কর্মীরা বেশি পছন্দ করছে। আর ওই পছন্দের পেছনে ছুটতে গিয়ে এই মতামতের বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। কারণ সেখানে মূল তথ্যের থেকে দলীয় রাজনীতির তথ্য গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশক থেকে সংবাদপত্রের নতুন যুগ শুরু হলে সেখানে আগের ট্র্যাডিশনকে অনেক ক্ষেত্রে ভেঙে ফেলে এক ধরণের জনপ্রিয়তার দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ানো হয়। এই জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক গসিপ এবং নানান ধরনের হলুদ সাংবাদিকতাকে প্রশ্রয় দেয়া শুরু হয়। যেগুলো নব্বইয়ের দশকের আগে সামরিক সরকারের অর্থায়নে প্রকাশিত অনেক সাপ্তাহিক কাগজ করত, সেগুলো যেকোনো কারণে হোক না কেন দৈনিকে উঠে আসে। এই হলুদ সাংবাদিকতা এমন পর্যায়েও গিয়েছিল যে কোনো কোনো সংবাদপত্রের বিশেষ কোনো রিপোর্টকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে হলুদ সাংবাদিকতার নমুনা হিসেবে দেখানো হতো।

অন্যদিকে সাংবাদিকতায় আরেকটি বিষয় আছে, যা হলো সরকারের উন্নয়ন সংবাদ প্রকাশ ও বিরোধী সংবাদ বা ব্যর্থতার সংবাদ প্রকাশ। দুটিই নিউজ। দুটিই তথ্যনির্ভর হলে কোনো পাঠকের কোনো আপত্তি থাকে না। বরং পাঠক সেখান থেকে তথ্য পায়। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, পত্রিকা বা সামগ্রিক মিডিয়া দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক ভাগ উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশের নামে সরকারের প্রচারপত্রে বা প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়। আরেক ভাগ ব্যর্থতার রিপোর্ট প্রকাশের নামে সংবাদপত্রের ভূমিকা বাদ দিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে থাকে। সংবাদমাধ্যমের এই সরকারি প্রচারযন্ত্র ও বিরোধী দলের ভূমিকা নেয়াও মানুষের কাছে মিডিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এ ছাড়া আরো একটি বিষয় দাঁড়ায়, তা হলো সাংবাদিককে সাংবাদিকতায় দক্ষ করে তোলা। পাকিস্তান আমলে এমনকি নব্বইয়ের আগে যেমন দৈনিক বাংলা স্কুল, সংবাদ স্কুল, ইত্তেফাক স্কুলও অবজারভার স্কুল এমনি কয়েকটি ধারা ছিল। সেখানে অভিজ্ঞদের অধীনে ধীরে ধীরে একজন সাংবাদিক হয়ে উঠতেন। ’৯০-এর পরে এই অবস্থাটি বদলে যায়। এ বিষয়ে ড. আনিসুজ্জামানের  ভিন্ন বিষয় নিয়ে দেয়া একটি বক্তব্য এখানে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি দেশে শত শত নিম্নমানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠা ও সেখান থেকে নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট বের হওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘দেশে প্রয়োজনীয় শিক্ষক সৃষ্টি হওয়ার আগেই অনেক বেশি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে।’ যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতরা কর্মক্ষেত্রে এসে শিক্ষিত হিসেবে পরিচয় রাখতে পারছে না। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। বাস্তবে শিক্ষাজীবন শেষে কমপক্ষে দশ বছর অভিজ্ঞ সাংবাদিকের অধীনে সাংবাদিকতা না করলে কোনোমতে টিকে থাকার মতো একজন সাংবাদিক হওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে দশ বছর সাংবাদিকতা করার আগেই এডিটরিয়াল সিদ্ধান্ত নেয়ার পদে চলে যেতে হচ্ছে বা চলে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন অনেকেই। এসব মিলে সাংবাদিকতা শতভাগ দায়িত্বের ভেতর দিয়ে আসার সুযোগ কমে যাচ্ছে।

এর পরে আছে বর্তমানের জনপ্রিয়তার দৌড়ে আগে সংবাদ পরিবেশনের বা নিউজ ব্রেক করার তাগিদ। অবশ্যই সাংবাদিককে দ্রুতই নিউজ ব্রেক করতে হবে। তবে সে নিউজ শতভাগ সত্য হতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেসরকারি অনেক টেলিভিশন ও নিউজ পোর্টাল অনেক সময় মৃতের নিউজের মতো সেনসেটিভ নিউজ নিয়েও প্রতিযোগিতায় নেমে প্রথমে মৃতের সংখ্যা পাঁচ দেখিয়ে পরে তিনে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়। আর এ কারণেই কোনো একজনের মৃত্যুর সংবাদ এখন মিডিয়ায় দেখলে মানুষ ফোন করে জানতে চায়, আসলে নিউজটি সত্য কি না? এমনকি নব্বইয়ের দশকের পরে এই ঢাকা শহরে মার্কেটে আগুন লাগলে সেখানে কোনো লোক মারা না গেলেও কোনো কোনো সংবাদপত্র মৃতের সংখ্যাসহ খবর প্রকাশ করে। এসব ঘটনা ধীরে ধীরে মিডিয়াকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে।

কোনো দেশের মিডিয়ার ওপর নির্ভরতা ও আস্থা কমে যাওয়া ওই দেশের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। বাস্তবে জাতীয় সংসদ, মিডিয়া এগুলোর ওপর যখন আস্থা কমে যায়, তখন ওই জাতি বা দেশকে অনেক গুরুত্ব দিতে হয় এসব বিষয়ের ওপর। এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হয়, কীভাবে এই আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়। খুঁজে বের করতে হবে সার্বিক সমস্যাগুলো। ওপরে খুবই কম পরিসরে কিছু সমস্যা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এছাড়া আরো অনেক সমস্যা আছে, যা লিখতে গেলে এ লেখার আকার অনেক বড় হয়ে যাবে। তারপরেও বর্তমানে সরকারের আইসিটি আইনের কিছু অংশ সংশোধনের দাবি আছে সাংবাদিকদের। সেটা অবশ্যই সাংবাদিকতায় সত্য প্রকাশের ও মতপ্রকাশের স্বার্থে বাস্তবায়ন করতে হবে। সারা দেশের বিশেষ করে মফস্বলে যাতে সাংবাদিকরা সত্য তুলে ধরতে পারে, তার জন্য তাদের যেমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় তাদের যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ভূঁইয়াদের অধীনে বাস করতে হয়, এ অবস্থারও অবসান ঘটাতে হবে। প্রশাসনের একচ্ছত্র আধিপত্যও সাংবাদিকতাকে সংকুচিত করতে করতে খুবই খারাপ জায়গায় নিয়ে যাবে। এ বিষয়েও এখনই সাংবাদিক সমাজসহ গোটা সমাজকে সজাগ হতে হবে। না হলে এখনো হয়তো আমাদের সাংবাদিকদের কাছে ফোন করেন অনেকে, বিষয়টি সত্য কি না? পরে এই ফোনটিও হয়তো করবেন না কেউ।

লেখক: সম্পাদক, সারাক্ষণ; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here