সৈয়দ মৌলানা মুফতি সাজেদুল্লাহ আজিজী
মাজার জেয়ারত নিয়ে জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা, যাতে উপলব্ধি আর শিক্ষণীয় কিছু বিষয় রয়েছে
দুই হাজার চার সালের একটি স্বপ্ন।
আমি তখন বেশ কিছু দিন যাবত অসুস্থ ছিলাম।যার ফলে প্রায়সঃ রাতে চিন্তিত মনে আনমনা হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম।হঠাৎ এক রাতে একটি দীর্ঘ সময় ধরে আমি স্বপ্নে বিভোর ছিলাম ।
দেখতে পেলাম, আমার মনে ভেসে উঠল মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের হযরত শাহ্ আহমদুল্লাহ্ মাইজ ভান্ডারী রহ.এর কথা। আমি তখনো স্বপ্নে। আমার মনের মধ্যে কে যেন বলছেন একটি গরু নিয়ে মাইজ ভান্ডার শরীফে যাও।
পরে দেখি সেই স্বপ্নের মধ্যেই আমি বোয়ালখালী উপজেলার মুরাদ মুন্সীর হাটে গিয়ে উপস্থিত হলাম এবং সেখান থেকে একটি মাঝারি সাইজের লাল গরু কিনে মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফে নিয়ে গিয়ে তা জবাই করে রান্নার পর গউসুল আজম হযরত শাহ আহমদুল্লাহ্ মাইজ ভান্ডারী রহ.এর মাজার শরীফের বারান্দায় বসে রান্না করা মাংস ফাতেহা দিয়ে মাজারের ভিতর উপস্থিত জেয়ারত রত সকলকে নিজ হাতে তাবার্রুক বিতরণ করছি।
এর কিছুক্ষণ পর আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
পরদিন সকাল থেকে আমি গভীর চিন্তায় পড়ে যাই।এটা কি দেখলাম?এবং কেন দেখলাম?
এ কথাগুলো আমার মাথায় সারাক্ষণ ঘুরপাক খেতে লাগল।
প্রতি দিন বার বার মনে আসে,গরু নিয়ে মাইজভাণ্ডার শরীফে যাওয়া হবে কি হবে না।
আবার মনে মনে ভাবতে থাকি, ‘আমরাতো অন্য তরীকার বা অন্য সিলসিলার অনুসারী, সেক্ষেত্রে আমার এ
স্বপ্নের বাস্তবে রূপ দিতে গেলে অন্যেরা সমালোচনা শুরু করবে হয়তো।অথবা সেই দরবারে গিয়ে আমার স্বপ্নের বিষয়টি সমাধা করতে দেওয়া হবে কি হবে না,ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক রকমের প্রশ্ন আমার অন্তরে দোল খেতে থাকল।
এভাবে এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেল।অন্যদিকে আমার স্বপ্ন কিন্তু স্বপ্নই রয়ে গেল।
এক বছর পর একদিন হঠাৎ আমার মাথায় আসলো,আমি কেন বসে আছি?আমি আমার স্বপ্ন টি পূরণ করবই।
একদিন আমার একান্ত আপনজনের মধ্যে একজন যিনি পরবর্তীতে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ইলেক্শন রান করা ব্যক্তিত্ব মোঃ এয়াকুব চৌধুরী, অপরজন জনাব আবদুল মাবুদ চৌধুরী নামীয় ব্যক্তিদ্বয়ের সাথে পরামর্শ করার পর উনারা খুবই খুশি হয়ে
অনেকটা সাহস যোগালেন।উনাদের সমর্থন পেয়ে তখন এক পর্যায়ে টাকা পয়সা জোগাড় করলাম।
পরদিন ঠিক সেই মুরাদ মুন্সীর হাটের গরু ছাগল বিক্রির এরিয়ায় প্রবেশ করতেই কি আশ্চর্য! প্রথমেই আমার চোখে পড়লো সেই রকমের এবং সেই সাইজের একটি লাল গরু যেমনটি আমি এক বছর আগে স্বপ্নে দেখেছিলাম।
তারপর গরুটির কাছে গিয়ে মালিকের নিকট দর দাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলে উঠলেন,হুজুর গরুটি হাটে এনেছি অনেকক্ষণ,কিন্তু কেউ গরুটি দেখেনি বা দরদামও করেনি ।আপনি আমার প্রথম কাস্টমার।একথা বলার পর উনি গরুটির এমন ভাবে এক কথায় একটি দাম চাইলেন যা আমার চাহিদা এবং ক্রয়ক্ষমতা উভয়ের সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়।ফলে আমি কোন প্রশ্ন উত্তর ছাড়াই গরুটি কিনে নেই।গরু ক্রয়ের সময় সহযোগিতার জন্য আমার সাথে জনাব আবদুল মাবুদ চৌধুরী সহ আমার মাদরাসার আবদুল মতিন নামক একজন স্টাফও ছিল।আমরা খুশি মনে গরুটি নিয়ে নিজ বাড়ি চলে আসলাম।
এখন অন্যান্য প্রস্তুতির পালা।বেংগুরা গ্রামের স্বনামধন্য সফ্দার আলি মুন্সীর বাড়ির আবদুল মালেক চৌধুরী নামের এক ভদ্রলোকের বেংগুরা লাইনের একটি বাস ছিল।একটি নির্দিষ্ট তারিখ ঠিক করে মাইজভাণ্ডার শরীফ যাওয়ার জন্য উনার বাসটি ভাড়া করলাম।গরু জবাই করার জন্য একজন হুজুরসহ রান্না করার জন্য বেংগুরা নয়াবাড়ির বালি বাবুর্চি নামক খুব ভাল পাক করতো এমন এক বাবুর্চিকে ঠিক করলাম।
এর পর উনার দেওয়া হিসাব মত চাউলপাত সহ তৈল মসলা,ডেক্সি, বালতি, লাকড়ি, তলই, কলার বরগ,দা-ছুরি ইত্যাদির সব কিছু প্রস্তুত করে নির্দিষ্ট তারিখে আমার খুব আপনজন জনাব মোঃ এয়াকুব চৌধুরী আর মোঃ আবদুল মাবুদ চৌধুরী, আর আমার পরিবারের সকল সদস্য, আমার আপন বোনদের সকল , আমার শ্বশুর বাড়ির পক্ষীয় লোকজনের মধ্যে আমার শ্বাশুরি, সম্বন্ধি আর ছোট বোনদের নিয়ে সব মিলে ত্রিশ-বত্রিশ জনের একটি কাফেলা হয়ে গেলাম।
যে দিন রওয়ানা দেব ঠিক সেদিন ভোর বেলায় সব কিছু প্রস্তুত।গরুটিকে কুড়া-ভুষি খাওয়ানোর পর বাসের মাঝখানের খালি জায়গায় কিছু বালির উপর শুকনা খড় বিছিয়ে দিয়ে গরুটিকে গাড়িতে উঠানো হলো।
তখন লক্ষ্য করলাম, গাড়ি স্টার্ট দেয়ার আগ মূহুর্তে নিজে নিজে গরুটি বাসের মেঝেতে বসে পড়লো।
বেংগুরা থেকে রওনা দিয়ে মাইজভাণ্ডার শরীফ পৌঁছানো পর্যন্ত গরুটি খুব শান্ত এবং চুপচাপ তথায় বসা অবস্থায় ছিল।এমনকি পুরা দীর্ঘ যাত্রা পথে গরুটি গাড়িতে মল ত্যাগ করাতো দূরে একটু প্রস্রাব পর্যন্তও করলো না।
যা হোক আমরা সুন্দর মত নিশ্চিন্তে দরবার শরীফে পৌঁছে গেলাম এবং পুরা বাসটি সহ আমরা হযরত শাহ্ আহমদুল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারি রহ.এর মাজার শরীফের সামনা সামনি ভিতরের মাঠে প্রবেশ করলাম।সকলে তখনো বাসের মধ্যে অবস্থান করছে ।শুধু জনাব এয়াকুব চৌধুরী, জনাব আবদুল মাবুদ চৌধুরী আর আমি সহ আমরা তিন জন গাড়ি থেকে নামলাম।
পরে উনারা দুই জন শাহ্ আহমদুল্লাহ্ মঞ্জিল নামক খানকা সংলগ্ন অফিসে প্রবেশ করে আমার স্বপ্নে দেখার অনুরূপ গরুটি জবাই করে আমরা নিজেরা ফাতেহা দিয়ে তা মাজার শরীফে অবস্থান রত জেয়ারত কারীদের কাছে বিতরণের অনুমতি চাইলেন।অনেক ভাবে বুঝিয়ে বলার পরও কিন্তু ম্যানেজার সাহেব গরু জবাই এর অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন,এ ধরণের বহিরাগত কেউ এসে জবাই করা বা ফাতেহা দেওয়ার কোন অনুমতি নেই।
অতঃপর উনারা দু’জন হতাস হয়ে ফেরৎ আসলেন। এ দেখে আমি কি করব? আর কি বলবো? ভেবে পাচ্ছিলাম না।
হঠাৎ আমার মনে কে যেন সাহস যুগিয়ে দিল !আমি তখন আবার বলে পাঠালাম, আপনারা আবার গিয়ে উনাদেরকে বলুন,গরুসহ যা কিছূ সাথে এনেছি সব আমার নিজের টাকায় কেনা। এতে কারো কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া একটি কানা কড়িও নেই।আমি মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের সিলসিলার সাথে সম্পৃক্ত নই। আমার আব্বাজানও একজন হক্কানী পীর। তবে দরবার শরীফকে আমি অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করি।আমাকে আমার স্বপ্নে দেখা অনুসারে আমার একীন পূর্ণ করতে হবে।না হয় আমার মনে শান্তি পাব না।
এত কিছুর পরেও যদি তাঁরা আমাদের কে জবাই করে ফাতেহা দেওয়া পর্যন্ত সুযোগ না দেন তাহলে আমরা সব কিছু নিয়ে পিছু হটে যাব,এবং মাইজ ভান্ডার এলাকার অন্য যে কোন একটি স্থানে সেই জায়গার মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে আমাদের যা যা করার তা করে নিয়ত আদায় করে চলে যাব।
হযরত শাহ্ আহমদুল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারি রহ.এর দয়া আর নজর ও করম আমার উপর না থাকলে আমি এই ধরণের স্বপ্ন কেন দেখলাম?
এর পর ম্যানেজার সাহেব উনার অফিস থেকে বের হয়ে আসলেন,এবং আমাকে বললেন,হুজুর এখানে মানুষ নানা রকম ফন্দি ফিকির করে চাঁদা তুলে এনে দরবারের নাম দিয়ে আত্মসাত করার সুযোগ নেবে বলে মানুষেরা নিজেরা জবাই দিয়ে ফাতেহা করা দরবারের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ হয়েছে।
তবে আপনি যখন এত করে বলছেন,আপনাকে আমরা সুযোগ টি দিতে চাই।যেহেতু ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাই আপনারা জবাই ও রান্না বান্না নিয়ে কষ্ট পাবেন। কাজেই জবাই আপনারাই করবেন, ফাতেহা আপনিই দিবেন।শুধু আপনাদের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে বলা ,আমাদের বাবুর্চির জন্য কিছু খরচ দিলে তারা সব রান্না করে দেবে,এবং ফাতেহা দেওয়ার জন্য আপনার হাতে ডেক সহ দিয়ে দেওয়া হবে।পরে আপনি নিজে ফাতেহা দিয়ে নিজ হাতে তবর্রুক বিতরণ করতে পারবেন।
কথাটি শুনে মনে বড় শান্তি পেলাম এবং সবাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আর আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করলাম।
এখন জবাই করার প্রস্তুতি চলছে। গরুটি জবাই করার জন্য তাদের পাঁচ জন লোক আমাদের সাথে দেওয়া হলো।
এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই, একটি কথা অনেক ভাবে শুনেছিলাম, আর তা হলো ‘মাইজভাণ্ডারি দরবার শরীফে আল্লাহর নামে নাকি জবাই করা হয় না।বরং সেই অলির নাম নিয়েই নাকি জবাই হয়।’
এ কথাটি আমার মনে মনে ছিল।কাউকে বলিনি।যার কারণে জবাই করার জন্য সঙ্গে করে একজন হুজুরও নিয়ে গিয়েছিলাম।
আমরা জবাই স্থান পর্যন্ত পৌঁছলাম।আমার সাথে নিয়ে যাওয়া হুজুর ধারালো ছুরি হাতে নিয়ে প্রস্তুত। ঐ পাঁচ জন লোক গরুটিকে বেঁধে জবাই এর জন্য প্রস্তুত করলেন। আমার নিয়ে যাওয়া হুজুর এখন জবাই শুরু করবেন।এখনো হুজুর বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর বলেন নি। ঠিক তার আগ মুহূর্তে জবাই করার জন্য দরবারের পক্ষ থেকে যোগ হওয়া লোকজন চিৎকার করে তকবীর আল্লাহু আকবর, বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর এ ভাবে বার বার উচ্চারণ করতে থাকলেন। আর এরই মধ্যে হুজুর আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই আরম্ভ করলেন।
এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো,আমার মনের কথা মনেই ছিল,কেন আমি সাথে করে জবাই করার হুজুর নিয়ে গিয়েছিলাম? কিন্তু আমার উত্তরটি আমি পেয়ে গেলাম। দরবার শরীফে জবাই করার সময় শুধু আল্লাহর নামই উচ্চারণ করা হয়। জবাই করার সময় অলির নাম নেওয়া হয় না। এই বাস্তবতা আমার স্বচক্ষে দেখা।
পরে বাবুর্চিরা রান্নার কাজে লেগে পড়লেন।আর আমরা সবাই মিলে ঘুরে ফিরে সব মাজারগুলো জেয়ারত করে নিলাম। অবশেষে জোহরের আজান হলো। আমরা তথায় মসজিদের নামাজ শেষ করলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের কে ডাকা হলো। ডেক ভরা তাবার্রুক আমাদের কাছে দিয়ে দেওয়া হলো। আমার লোকজন সকলে মিলে গউসুল আজম হযরত শাহ্ আহমদুল্লাহ্ মাইজভাণ্ডারি রহ.এর মাজার শরীফের অভ্যন্তরে বসে জেয়ারত শেষে মিলাদ কেয়াম আদায় করে ফাতেহা শেষ করে নিজ হাতে উপস্থিত অন্যান্য সকল জেয়ারত কারীর হাতে তবর্রুক তুলে দিলাম।
পরে ম্যানেজার সাহেব আমাদেরকে সকলকে মেহমান খানায় নিয়ে গিয়ে খুব যত্নের সাথে খানা আর তবর্রুক পরিবেশন করলেন।
সব শেষে আবারও শেষ বারের মতো বিদায় জেয়ারতে অংশ নিলাম,এবং আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করতে ফেরৎ আসার পথে ইমামে আহলে সুন্নত হযরত শেরে বাংলা রহ.এর জেয়ারত করতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করলাম।
এত বছর পরও ঘটনাটি এখনো আমার নখ দর্পণে।
পরিশেষে একটি কথায় বলছি, সুন্নী ওলামায়ে কেরাম আল্লাহর অলিদের জেয়ারত করে,পূজা করে না।যারা সুন্নী আলেমদের কে মাজার পূজারী বলে আল্লাহ্ একদিন তাদের বিচার করবে।
জেয়ারত করার জন্য রসূল সাঃ এর নির্দেশ রয়েছে।
তিনি বলেছেন,
قد كنت نهيتكم عن زيارة القبور الا فزوروها،
উচ্চারণ:-
ক্বদ্ কুন্তু নাহীতুকুম ‘আন্ যিয়ারতিল্ ক্বুবূরি, আলা– ফাযূরূহা–।
অর্থাৎ হে আমার উম্মতেরা,আমি তোমাদের (ইসলামেল প্রারম্ভিক সময়ে জেয়ারত করতে নিষেধ করতাম।জেনে রাখো,এখন থেকে জেয়ারত কর।
কেননা-
“لانها تزهدك فى الدنيا وتذكرك الاخرة ”
উচ্চারণ:-‘কেন না এই জেয়ারত তোমাকে দুনিয়ার মধ্যে পরহেজগার বানিয়ে দেবে এবং পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।’
আরো একটি হাদিসে এসেছে-
“زار النبى صلى الله عليه وسلم قبر امه فبكى وابكى ما حوله،”
উচ্চারণ:-
রসূল সাঃ তাঁর মায়ের কবর জেয়ারত করেছেন।অতঃপর এমন ভাবে ক্রন্দন করেছেন যে কান্নায় তাঁর চতুর্দিকে যা কিছু ছিল সব কিছুকেই ক্রন্দন করিয়ে ছেড়েছেন।
দেখুন, জেয়ারতের কত বড় ফজিলত আর মর্তবা।অথচ এক শ্রেণির লোক শুধু জেয়ারতের নিন্দায় পঞ্চমুখ।তাদের ভদ বিচার ছাড়া মাজার মানে পূজার স্থান,আর মাজার জেয়ারতকারী মানে মাজার পূজারী।
নাউযু বিল্লাহ।
লেখক- অধ্যক্ষ; বেঙ্গুরা সিনিয়র মাদ্রাসা