আবীর চক্রবর্তি
কালাচাঁদ ঠাকুর শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী চতুর্ভুজ বিষ্ণুমুর্তি। সনাতন ধর্মমতে, ভগবানের অসংখ্য রূপ। নারায়ণ বা বিষ্ণু অথবা কালাচাঁদ একই নামের সমার্থক। কালাচাঁদ দেখতে ঘনকালো বর্ণের বলেই বিগ্রহকে কালাচাঁদ ঠাকুর নামে অভিহিত করা হয়। এই দেববিগ্রহের সঙ্গে আছে শঙ্খ, সুদর্শন চক্র, গদা এবং পদযুগলের নিচে পদ্মফুল। দুই হস্তে শ্রীকৃষ্ণের বংশী। মুখমণ্ডল চন্দন শোভিত এবং কপালে তিলক। মস্তকে স্বর্ণের তাজ এবং গলায় শোভা পায় বাহারী ফুলের মালা।
কালাচাঁদ ঠাকুরকে প্রাপ্তির ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩’শ বছর পূর্বে চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদ গ্রাম (বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত কুলগাঁও) ছিল ঝরঝড়িয়া বটতল নামে পরিচিত। এখন এটি চসিকের ২ নং জালালাবাদ ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। শহর থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী সড়কের ডান পাশে অবস্থিত জে-বটতলী উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ। এই প্রতিষ্ঠানের সম্মুখে রাস্তার বাম পাশে ছিল ঐতিহাসিক কালার দিঘী। স্থানীয় ভক্ত বৈষ্ণব কালাচাঁদ সেই দিঘীতেই পেয়েছিলেন আজকের আরাধ্য বিগ্রহ কালাচাঁদ ঠাকুরকে।
জঙ্গলাকীর্ণ ওই দিঘীতে পুরো গ্রাম এবং আশপাশের এলাকার অনেকে øান করতেন। তৎকালীন সময়ে ‘কালাজ্বর’ এর প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে মানত করে সেই দিঘীতে øান করলে অসুখ সেরে যেত বলে জনশ্র“তি রয়েছে। কেউ কেউ দূর-দূরান্ত থেকে এসে বোতলে ভরে নিয়ে যেত দিঘীর জল। কিন্তু ট্যানারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের দূষিত বর্জ্যে নষ্ট হয়ে যায় কালার দিঘীর জল। দিঘীটি ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে সীমানা প্রাচীর, মুছে ফেলা হয়েছে স্মৃতিচিহ্ন।
বৈষ্ণব কালাচাঁদের প্রতি একদিন স্বপ্নে আদেশ হয়,‘তুমি যদি দিঘীর ধারে নিম্ব বৃক্ষের (নিম গাছ) নিুে গিয়ে প্রতিদিন প্রতুষ্যে কীর্তণ কর, তবে দেখবে লক্ষী-নারায়ণ তোমার কাছে আসবার জন্য সেই দিঘীতে ভেসে উঠবেন। তখন তুমি তাঁদের নিয়ে যেও।’ এ ঘটনার পরদিন প্রাতে তিনি সেই স্থানে গিয়ে শুরু করেন নাম সংকীর্তন। এভাবে কয়েকদিন যাবার পর একদিন সত্যিই দিঘীর জলে ভেসে উঠলো আকাঙ্খিত দুটি বিগ্রহ। দিঘীতে থাকা কণ্টকাকীর্ণ পদ্মবন অতিক্রম করে তিনি বামহস্তে লক্ষী এবং ডানহস্তে নারায়ণের মূর্তি স্পর্শ করলেন। কিন্তু হঠাৎ লক্ষীমুর্তি জলে ডুবে গিয়ে অন্তর্হিত হলো। অতঃপর সেই বৈষ্ণব নারায়ণের মুর্তি নিয়ে তীরে উঠে আবারো কীর্তন শুরু করলেন। দীর্ঘসময় পরও সুবর্ণময়ী লক্ষীমুর্তি আর জলের ওপর ভেসে উঠলো না। ব্যাথিত মনোরথে বৈষ্ণব কালাচাঁদ নারায়ণ মুর্তি নিয়ে গৃহে ফিরে এলেন। এরপর সেই বিগ্রহ নিজ ঘরের আসনে রেখে শুরু করলেন পুজার্চ্চনা। সেদিন রাতে আবারো স্বপ্নে শুনলেন,‘তুমি বামহস্তে প্রথম মাতৃমুর্তি স্পর্শ করেছ বলেই মা অন্তর্হিত হয়েছেন।’ চোখের জলে বুক ভাসালেন বৈষ্ণব কালাচাঁদ।
যেভাবে বোয়ালখালীতে আগমন : বৈষ্ণব কালাচাঁদের নিত্য দিনের কাজ হয়ে দাঁড়ায় বিগ্রহের সেবাপূজা। এরই মধ্যে একদিন তাঁর প্রতি স্বপ্নযোগে আদেশ হলো-‘আমাকে নিয়ে যাও হাওলা (বর্তমানে পোপাদিয়া) গ্রামে। এ কথা শুনে তাঁর মনে পড়ে যায় সেখানকার রামহরি আচার্যের কথা। প্রবীণ কালাচাঁদের সাথে রামহরির ঘুরু-শিষ্য সম্পর্ক। তবে কে গুরু আর কে শিষ্য-সেই তথ্যটি এখনো অনুদ্ঘাটিত। এদিকে রামহরি আচার্য্যও এক রাতে শুনেছেন একই রকম স্বপ্নাদেশ। দৈব বাণীতে তিনি শুনলেন-‘আমাকে কালাচাঁদের গৃহ থেকে তোমার নিকট আনিয়া রাখ এবং আমার পরম ভক্ত কালাচাঁদের নামেই আমার নামকরণ করিয়া পুজা কর।’ পরদিন উৎকন্ঠিত রামহরির গৃহে সেই বিগ্রহ নিয়ে হাজির হলেন ভক্ত কালাচাঁদ। তাঁকে দেখে অবাক হলেন রামহরি আচার্য্য। দু’জনের মধ্যে হলো ভাব বিনিময়। অতঃপর রামহরির গৃহে ঠাকুরকে রেখে শুরু হলো সেবা-পূজা। এর সপ্তাহকালের মধ্যে দেহ ছেড়ে বৈকুণ্ঠলোক প্রাপ্ত হলেন ভক্ত কালাচাঁদ বৈষ্ণব। এদিকে রামহরির গৃহে স্থাপিত মুর্তির নব নামকরণ হলো “কালাচাঁদ ঠাকুর।” সেই বিগ্রহের পূজার্চ্চনা নিয়েই কেটে যায় তাঁর জীবন।
কালাচাঁদ ঠাকুর বাড়ি : রামহরির যে গৃহে ঠাকুর কালাচাঁদের পূজা হতো, সেটি ছিল বাঁশের খুটির ওপর ভর করে থাকা জরাজীর্ণ কুটির। তাঁর জীবদ্দশায় বিগ্রহটিকে নিয়ে ঘটে যায় অলৌকিক কাণ্ড। প্রতিদিন বিগ্রহের পূজা করতেন এই ব্রাহ্মণ। একদিন পূজা শেষ করে সন্ধ্যায় ঠাকুরকে শয্যা দিয়ে দরজা বন্ধ করে যথারীতি তিনি শোবার ঘরে চলে যান। সকালে এসে মন্দিরের দরজা খুলেই চমকে উঠলেন তিনি। দেখলেন-দক্ষিণমুখি বিষ্ণুমুর্তিটি উত্তরমুখী হয়ে আছে। কেউ দুষ্টুমী করে এ কাজ করেছে ভেবে তিনি আবারো বিগ্রহকে দক্ষিণমুখি করে দিলেন। কিন্তু পরদিন এসেও দেখলেন, মুর্তিটি পুনরায় উত্তরমুখী হয়ে আছে। সেদিনও যথারীতি দক্ষিণমুখি করে বিগ্রহের পূজা শেষ করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ৩য় দিনও বিগ্রহ ফিরে যায় উত্তর দিকে। ঠাকুরের এমন অবস্থানের কারণে রামহরি ধ্যানমগ্ন হলেন। তিনি অনুভব করলেন,‘উত্তরমুখি বিষ্ণু তাঁরই পরম ভক্ত ফতেয়াবাদ গ্রামের কালাচাঁদের দিকে চেয়ে আছেন।’ পূজক রামহরি এখন প্রয়াত। তাঁর অর্চিত বিগ্রহ এখনো উত্তরমুখী হয়ে আছেন। তবে জরাজীর্ণ গৃহটি আর নেই। এই বিগ্রহকে ঘিরে ৫ একরেরও বেশি জমি জুড়ে বোয়ালখালীর পোপাদিয়ায় গড়ে উঠেছে কালাচাঁদ ঠাকুর বাড়ি। বর্তমান মূল মন্দির নির্মিত হয়েছে ষাট বছর পূর্বে। এরপর অন্যান্য স্থাপনাগুলো গড়ে ওঠে গত ৩০ বছরের মধ্যে।
জানা যায়, বর্তমানে যেখানে শিব মন্দির রয়েছে, সেদিকেই ছিল কালাচাঁদ ঠাকুরের বিগ্রহ। কিন্তু আপনা-আপনি দিক পরিবর্তনে এখন উত্তরমুখী হয়ে ঠাকুর কালাচাঁদ পূজা পাচ্ছেন। কালাচাঁদ ঠাকুর বাড়ি পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাজেন্দ্র প্রসাদ চৌধুরী জানান, ১৯৭১ সালের যুদ্ধেও মন্দিরটি অক্ষত ছিল। পাঞ্জাবী সৈন্যরা একবার মন্দিরে প্রবেশ করে লোহার সিন্দুক ভেঙ্গে লুটপাট চালায়। এরপর বিষ্ণুমুর্তিটিকে নির্দিষ্ট স্থান থেকে ফেলে দেয়। এতে বিগ্রহের কিছু অংশে ফাটল সৃষ্টি হলেও পরবর্তীতে সেই ফাটল আপনা থেকেই জোড়া লেগে যায়। কিন্তু যেসব সৈন্য মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করেছিল, তারা তৎকালীন গোমদণ্ডী ক্যাম্পে যাবার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেয়া হলে গণহারে মারা যায় আক্রমনকারী সব সৈন্য। এ ঘটনার পর আর কোন সৈন্য মন্দিরে আসার সাহস পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসেও ঠাকুরের নিত্য পূজা চলেছে, এখনও চলছে।
মিলন তীর্থ : বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া সড়কে কালাচাঁদ ঠাকুর বাড়ি যেতে চোখে পড়ে সুদৃশ্য এক তোড়ণ। তোড়ণের ওপর দুই পাশে দুটি সিংহ মুর্তি এবং মাঝখানে শঙ্খ। এখান থেকে ১০ মিনিটের হাঁটা পথে পৌঁছা যায় মন্দিরে। মন্দির সংলগ্ন পুকুর, শিব মন্দির, কালাচাঁদ ঠাকুর মন্দির, ভোগ রান্না ঘর ও প্রসাদ বিতরণ কেন্দ্র, লাইব্রেরী, গোশালা-সবকিছুই সীমানার ভেতরে। ঠাকুরের মন্দিরের সামনে লেখা আছে :
অপুত্রক পুত্র পায় কালাচাঁদ বরে
নির্ধনের ধনদাতা অশেষ প্রকারে।
অন্ধজনে পায় চক্ষু সুখহীনে সুখ
অনাথেরে করে দয়া না করে বিমুখ।
সনাতনী অন্নপ্রাশন (শিশুর মুখে প্রথম ভাত তুলে দেয়া) তিথিতে দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসেন এই মন্দিরে, আসেন পুত্রবতীরাও। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সকল ধর্মের মানুষ আসেন তীর্থস্থান দর্শনে। ভক্তরা মানত করে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে পূজা দিয়ে মনষ্কামনা পূর্ণ করেন।