জাকাত ও ফিতরা দেওয়ার আগে প্রথমে যথাসম্ভব নিশ্চিত হতে হবে যাঁকে দেওয়া হচ্ছে, তিনি এর উপযুক্ত হকদার কি না। জাকাত, সদকা ও ফিতরা দেওয়ার সময় গ্রহীতাকে তা জানানোর প্রয়োজন নেই

শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

জাকাত সম্পদের প্রবাহ তৈরি করে ও দারিদ্র্য বিমোচন করে। সঠিকভাবে জাকাত প্রদান করলেই সমাজ, দেশ, জাতি ও রাষ্ট্র এবং বিশ্ব দারিদ্র্যমুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যাতে তোমাদের বিত্তবানদের মধ্যেই শুধু সম্পদ আবর্তন না করে।’ (সুরা-৫৯ হাশর, আয়াত: ৭)

হাদিস শরিফে জাকাত ও সদকা প্রদানের উপকারিতা প্রসঙ্গে এসেছে, ‘দাতা আল্লাহর কাছে প্রিয়, মানুষের কাছে প্রিয়, জান্নাতের নিকটতম; জাহান্নাম থেকে দূরে। সাধারণ দাতা অধিক ইবাদতকারী কৃপণ অপেক্ষা আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।’ (সুনানে তিরমিজি)

কোরআন মজিদে জাকাত ব্যয়ের নির্দিষ্ট আটটি খাত উল্লেখ রয়েছে। সদকাতুল ফিতর, ওয়াজিব সদাকাত, ফিদিয়া, কাফফারা ও মান্নত ব্যয়ের খাতও এগুলোই।

আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মূলত সদকা হলো ফকির, মিসকিন, জাকাতকর্মী, অনুরক্ত ব্যক্তি ও নওমুসলিম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে (ইসলামের সুরক্ষার জন্য) ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফির ও পথসন্তানদের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।’ (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৬০)

ওই আটটি খাতের মধ্যে সময়ের প্রয়োজন ও ফলাফল বিবেচনা করে নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী ও অন্যদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে জাকাত-ফিতরা আদায় হওয়ার পাশাপাশি নিয়ত অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষে সওয়াবের পরিমাণও বাড়বে।

উপকার যত ব্যাপক হবে, সওয়াব তত বেশি হবে। যেমন দ্বীনি ইলম অর্জনে দরিদ্র তালেবে এলেম বা অভাবী আলেমকে জাকাত প্রদান করলে তিনি একদিকে দরিদ্র ব্যক্তি হিসেবে অন্য যেকোনো ব্যক্তির মতো উপকৃত হবেন, উপরন্তু এই অতিরিক্ত উপকারের জন্য অধিক সওয়াব পাবেন। যেমন দ্বীনি ইলম অর্জনে ও ধর্মীয় কাজে প্রচার-প্রসারে সহযোগিতা ইত্যাদি।

যাঁদের জাকাত, সদকাতুল ফিতর, ওয়াজিব সদকা, ফিদিয়া, কাফফারা ও মান্নত প্রদান করা যায় না, তঁারা হলেন পিতা-মাতা ও ঊর্ধ্বতন পুরুষ—যেমন দাদা-দাদি ও নানা-নানি। ছেলেমেয়ে ও অধস্তন পুরুষ, যেমন নাতি-নাতনি। স্ত্রী—কারণ তার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান স্বামীর দায়িত্বে। সায়্যদ অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রকৃত বংশধর। ধনী লোক, যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক এবং অমুসলিম ব্যক্তি।

আপন ভাইবোন, ভাগনে-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজি, চাচা, জেঠা, ফুফু, মামা-খালা; চাচাতো-জেঠাতো ভাইবোন, ফুফাতো ভাইবোন, মামাতো-খালাতো ভাইবোন এবং অন্যান্য নিকটাত্মীয় যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হন, তাহলে তঁাদেরও জাকাত, সদকাতুল ফিতর, ওয়াজিব সদাকাত, ফিদিয়া, কাফফারা ও মান্নত দেওয়া যাবে; বরং এঁদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।

হাদিস শরিফে রয়েছে, নিকটাত্মীয়দের দান করলে দ্বিগুণ সওয়াব হয়—প্রথমত, দানের সওয়াব; দ্বিতীয়ত, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার সওয়াব। জাকাত, ফিতরা, ফিদিয়া, কাফফারা ও মান্নত-সদকা নগদ টাকায় বা খাদ্যদ্রব্য এবং অন্য কোনো বস্তু, যেমন পোশাক-আশাক, ঈদের বাজার ইত্যাদি কিনেও দেওয়া যায়।

জাকাত ও সদকায় যাদের অগ্রাধিকার প্রসঙ্গে কোরআনুল করিমে ঘোষণা হয়েছে, ‘এমন অভাবী লোক, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের নিয়োজিত রাখার কারণে (উপার্জনের জন্য) দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে না। সম্ভ্রান্ততা ও আত্মমর্যাদার কারণে অনভিজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবহীন মনে করে। আপনি তাদের চিহ্ন দেখে চিনতে পারবেন। তারা মানুষের কাছে নির্লজ্জভাবে ভিক্ষা করে না। আর তোমরা যেকোনো উত্তম জিনিস ব্যয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সে বিষয়ে অবগত আছেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৭৩)

জাকাত ও ফিতরা প্রদানের আগে প্রথমে যথাসম্ভব নিশ্চিত হতে হবে যঁাকে দেওয়া হচ্ছে, তিনি এর উপযুক্ত হকদার কি না। জাকাত, সদকা ও ফিতরা দেওয়ার সময় গ্রহীতাকে তা জানানোর প্রয়োজন নেই। জাকাতগ্রহীতা যদি আত্মীয়স্বজন, আপনজন বা পরিচিতি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হন, তাহলে জাকাত-ফিতরা উল্লেখ করাটা মোটেই সমীচীন নয়।

কারণ, এতে গ্রহীতা অপমানিত, অসম্মানিত ও বিব্রত বোধ করতে পারেন। অকারণে কাউকে অসম্মান করা বা কারও সম্মান হানি করা গুনাহের কাজ। কোরআনের ভাষায় আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সম্মান আল্লাহর জন্য, সম্মান রাসুল (সা.)-এর জন্য, সম্মান সব মুমিনের জন্য; কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।’ (সুরা-৬৩ মুনাফিকুন, আয়াত: ৮)।

● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

smusmangonee@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here