নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
আওয়ামী লীগ নেতাদের জীবনীও নেই, সমাজ অধ্যয়ন কেন্দ্র নামে একটি পাঠচক্র থেকে শরীফ শমসিরের সম্পাদনায় প্রকাশিত এম এ আজিজ স্মারক গ্রন্থ এবং আমি কিছু স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনা প্রকাশ করেছি। তাতে যেসব তথ্য, ঘটনা উঠে এসেছে, তার ভিত্তিতে এই গ্রন্থটি লিখতে দুঃসাহস করেছি।
আমি অসুস্থ, কলম ধরতে গেলে হাত কেঁপে কেঁপে যায়। কিন্তু বিবেকের তাড়না আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। তাই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ইতিহাস রচনার জন্য অধমের এই অক্ষম প্রয়াস।
আওয়ামী লীগ যেমন বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগও তেমনি আজিজ-জহুরেরই ইতিহাস। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কোন স্বাধীন সংগঠন নয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরই একটি শাখা মাত্র, কেন্দ্র থেকে যখন যে কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে, সে কর্মসূচি চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন করেছেন আজিজ-জহুর। এখানেই একটি কথা আসে। তাঁরা কি শুধু কেন্দ্রের কর্মসূচিই বাস্তবায়ন করেছেন, না তাঁরা চট্টগ্রামের জন্য নিজস্ব কিছু কর্মসূচি তৈরি করে তার ভিত্তিতে আন্দোলন, সংগ্রাম, সংগঠন করেছেন। তাঁরা কি শুধু কেন্দ্রের অন্ধ অনুকরণই করেছেন? না, সৃজনশীলভাবে তার প্রয়োগ করেছেন।
মূল দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পরপরই চট্টগ্রাম আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিলো। সে হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরই সমবয়সী এবং অভিন্ন ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ। ১৯৪৩ সালের ২৩ জুন পুরোনো ঢাকার টিকাটুলী কে এম দাশ লেনে ঢাকা পৌরসভার তৎকালীন ভাইস-চেয়ারম্যান কাজী বশির হুমায়ুনের রোজ গার্ডেন হলে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। আজ ২৩ জুন আওয়ামী লীগের জন্মদিন। চট্টগ্রামের ১১ জন নেতাও ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেন হল রুমে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। যে কারণে তাঁদেরকে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা পিতা (Founding Fathers’) হিসেবে গণ্য করা চলে।
সুতরাং শাখা হলেও চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। দলের সমস্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে চট্টগ্রামে। কখনো কখনো চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে পথ দেখিয়েছে। যেমন ৬ দফা বানচালের জন্য ৮ দফা দিয়ে পিডিএম যে চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছিল, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দই সেই চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে আওয়ামী লীগকে রক্ষা করেছিলেন।
কখনো কখনো চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে সঠিক রাজনীতির পথে চলতে সাহায্য করেছিলেন। কঠিন রাজনৈতিক সংকটময় মুহূর্তে মূল দলের নেতৃবৃন্দ কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিংবা বিভ্রান্তির শিকার হয়ে যখন ভুল পথ অবলম্বন করে দলকে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার পরিচয় দিতে যাচ্ছিলেন, তখন এম এ আজিজের সাহসী অবস্থান দলকে আপসহীন রাজনীতির ওপর স্থির থাকতে সাহায্য করেছিলো।
চট্টগ্রাম থেকে রোজ গার্ডেন সম্মেলনে যোগদানকারী ১১ জনের নাম কোথাও পাওয়া যায় না।
দেশভাগের পূর্বে চট্টগ্রামের যেসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী কলকাতায় অবস্থান করতেন এবং সেখানে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ করতেন, তারা এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিতরাই চট্টগ্রাম থেকে রোজ গার্ডেন সম্মেলনে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এ ব্যাপারে প্রবীণ রাজনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মওলানা এ আর চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, মওলানা ছালে জহুর, ইউনুস খান, ডা. শামসুল আলম, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী চট্টগ্রাম থেকে রোজ গার্ডেন সম্মেলনে গিয়েছিলেন। তবে মওলানা এ আর চৌধুরী আমাকে বলেছেন যে জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ আজিজ রোজ গার্ডেন সম্মেলনে যাননি। ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং আজিজুর রহমানও (গোরা আজিজ) সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন বলে কলামিস্ট ইদরিস আলম উল্লেখ করেছেন দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত তাঁর লেখায়। আমার ধারণা জহুর-আজিজ রোজ গার্ডেন সম্মেলনে না যেয়ে পারেন না। কারণ ফজলুল কাদের চৌধুরী, জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ আজিজ, মওলানা এ আর চৌধুরী, মওলানা আবু তাহের, আজিজুর রহমান, ডা. শামসুল আলম, এরা সকলেই একসঙ্গে মুসলিম লীগ করতেন। তাদের মধ্যে নেতা ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি মুসলিম লীগে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপে ছিলেন। জহুর আহমদ চৌধুরীও কলকাতা থেকে সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক। ফজলুল কাদের চৌধুরী চট্টগ্রাম জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আর জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন প্রচার সম্পাদক। সুতরাং চট্টগ্রামে মুসলিম লীগের সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের উপর্যুক্ত ব্যক্তিরা সকলেই যদি রোজ গার্ডেন সম্মেলনে যোগদান করে থাকেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এখানে ১০ জনের নাম আমরা পাচ্ছি, তাঁরা হচ্ছেন-মওলানা এ আর চৌধুরী, ২ মওলানা আবু তাহের, ৩. এমএ আজিজ, ৪. জহুর আহমদ চৌধুরী, ৫. ফজলুল কাদের চৌধুরী, ৬. আজিজুর রহমান, ৭. ডা. শামসুল আলম, ৮. মওলানা ছালে জহুর, ৯. ইউনুস খান, ১০. মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী। একজনের হিসাব মিলছে না। আবার ফজলুল কাদের চৌধুরী সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গেলেও শেষ পর্যন্ত সম্মেলনে যান নি। ফলে আরো একজন কমে সংখ্যাটা ৯জন হয়ে যাচ্ছে। আমরা তিনজনের কথা ভাবতে পারি, যাঁদেরকে নিয়ে এগারো জনের হিসাব সম্পূর্ণ করা যায়। এই তিনজন হচ্ছেন-সন্দ্বীপের রেদওয়ানুল বারী, শেখ মোজাফফর আহমদ ও আমীর হোসেন দোভাষ। বারী সাহেব গেছেন, একথা তিনি আমাকে বলেছেন। তাহলে শেখ মোজাফফর ও আমীর হোসেন দোভাষের মধ্যে যে কোন একজন যান নি।চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন সাংবাদিক ওবায়দুল হক। তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনকালে একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তাঁর লিখিত “স্মৃতির মিনারে মাওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব” শীর্ষক গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “১৯৪৯ সালে আমি একজন ক্লিয়ারিং এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা শুরু করি। সদরঘাটস্থ পুরাতন কাস্টমস হাউসের সামনে ছিল অফিস এবং বাসা ছিল ফিরিঙ্গীবাজার। একদিন সন্ধ্যায় শ্রমিক নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর আন্দরকিল্লাস্থ অফিসের পাশে দ্বিতলের উপর সুভাষ ট্রেডার্স নামে একটি অবাঙালি প্রতিষ্ঠানে যাই। তাদের মালামাল বন্দর থেকে ছাড় করার ব্যাপারে কথাবার্তা শেষে ফিরে আসছিলাম। সিঁড়ি থেকে রাস্তায় নামতেই আমার সামনে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা চকরিয়ার জনাব আজিজুর রহমান ও মরহুম আবুল খায়ের সিদ্দিকীকে দেখতে পাই। তারা আমাকে দেখেই বললেন, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আমি আমার ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে দ্বিতলে গিয়েছি জানালে তারা আমাকে তাদের সাথে আসার আহ্বান জানান। আমি তাদের সাথে পুনরায় দ্বিতলে উঠে জহুর আহমদ চৌধুরীর অফিসে প্রবেশ করি। সেখানে মরহুম এম.এ. আজিজ, তৎকালীন মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের সালারে জিলা শেখ মোজাফফর আহমদ, মাওলানা আবদুর রহমান ও মাওলানা আবু তাহের, শিল্পপতি মোহাম্মদ ইউসুফ, আমির হোসেন দোভাষসহ কয়েকজন নেতাকে দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়। অনেকক্ষণ আলোচনা করার পর পরবর্তী সভায় একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই সভায় আমি যথারীতি উপস্থিত হলেও জনাব আজিজুর রহমান ও আবুল খায়ের সিদ্দিকী অনুপস্থিত থাকেন। এতে সকলেই মত প্রকাশ করে বলেন যে, তাঁরা বোধ হয় মুসলিম লীগ ত্যাগ করবেন না। পরে তাদের বাদ দিয়ে উপস্থিত অন্যান্যদের মধ্যে শেখ মোজাফফর আহমদকে সভাপতি ও এমএ আজিজকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রথম চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। তখন আমিও একজন সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন সভায় অংশগ্রহণ করতে শুরু করি। এক্ষেত্রে আমি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামকে অনুসরণ করে সভায় প্রথমে গণসংগীত ও পরে বক্তৃতা করতাম। উল্লেখ্য, কলকাতায় কংগ্রেসের যে কোন জনসভা হলে রবীন্দ্রনাথ অথবা কাজী নজরুল ইসলাম গণসংগীত পরিবেশন করতেন। পরে আর এক সভায় শ্রমিক নেতা মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরীকে সভাপতি এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে (আজাদী সম্পাদক) সভাপতি করে যথাক্রমে সিটি ও চট্টগ্রাম উত্তর মহকুমা আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মহকুমা কমিটিতে মাওলানা আবু তাহেরকে সাধারণ সম্পাদক ও আমাকে প্রচার সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়।”(ওবায়দুল হক : প্রাসঙ্গিক কথা- স্মৃতির মিনারে মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিব, প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০০৬, চট্টগ্রাম)।
ওবায়দুল হকের এই বক্তব্য থেকে যে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেটি হলো প্রথমে জেলা কমিটি গঠিত হয়েছিলো। আর আন্দকিল্লায় জহুর আহমদ চৌধুরীর শ্রমিক সংগঠনের অফিসকে কেন্দ্র করেই চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতি গড়ে উঠেছিলো। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সময় জহুর আহমদ চৌধুরীর উক্ত অফিসেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন থেকে শুরু করে সর্বদলীয় বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক ওয়াবদুল হকের কথাই হয়তো সত্যি। প্রথমে জেলা ও শহর নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিলো। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন সালারে জিলা শহীদ শেখ মোজাফ্ফর আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ। কিছুদিন পর আলাদা শহর আওয়ামী লীগ কমিটি গঠিত হয়। এর সভাপতি হন আমীর হোসেন দোভাষ এবং সাধারণ সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক
সৈাজন্যে- দৈনিক আজাদী