মো.ছাদেকুর রহমান সবুজ: বাপ-দাদার কথা, ‘নগর যাতায়াতে কর্ণফুলীর সাম্পানই ছিলো ভরসা’। ইংরেজ শাসনামলের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৩০সালে বার্মা ফ্রন্টের সেনা পরিচালনায় কর্ণফুলী নদীর উপর রেল চলাচলের উপযোগী করে আপদকালীন কালুরঘাট সেতু নির্মিত হয়।

দুই অ্যাবটমেন্ট, ছয় ব্রিক পিলার, ১২টি স্টিল পিলার ও ১৯টি স্প্যানের সমন্বয়ে নির্মিত ৭শত গজ লম্বা এ সেতু উদ্বোধন করা হয় ১৯৩০ সালের ৪জুন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে রেল লাইনসহ সড়ক সেতুতে রূপান্তর করে একমুখী যানচলাচলের উপযোগী করা হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসে নতুন দিক। তবে কালের বিবর্তনে বাঙালির ইতিহাসের সাক্ষী এ সেতু জরার্জীণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ সেতুতে জড়িয়ে আছে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি। আছে ব্যথা, দু:খ গাঁথা, অব্যক্ত শতশত কাহিনী। এভাবেই কেটে গেলো স্বাধীনতার ৪৭টি বছর। বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে ৮৭ বছরের বার্ধক্য কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে সেতুটিকে।

এরই মধ্যে বড় অংকের অর্থ ব্যয়ে ১৯৮৬, ১৯৯৭, ২০০৪ ও ২০১২ সালে করতে হয় বড় ধরণের সার্জারী বা সংস্কার। যদিও সংস্কারের সময় বন্ধ রাখা হয়েছিলো যানচলাচল, নদীতে চলেছিলো ফেরি। সংস্কার করা হলেও বছর যেতে না যেতেই বেহালদশা হয়ে পড়ে এ সেতু। বয়সের ভারে ন্যুজ এ সেতু এখন আর ভার বইতে বা সইতে পারছে না। কখন জানি করে হার্টফেল! প্রতি বছর ইজারা দিয়ে ভালোয় আয় হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের। কালুরঘাট সেতু দুধের গরু, লাথি দিলেও ভালো -এ ভাবনায় চলছে আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ও ভারী যানবাহন।

আশ্চর্যের বিষয়, ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা এ সেতুর ইজারা দেয়া বা যানচলাচল বন্ধ রাখেননি রেলকর্তারা। একমুখী সেতু হওয়ায় দুই পাশে লাইন দিয়ে পাড়ি দেয় গাড়ি। যা গত তিন দশক ধরে প্রতিনিয়ত দীর্ঘ লাইনে রূপান্তর হচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে ক্ষণস্থায়ী জীবনের মূল্যবান শ্রমঘণ্টা নষ্ট করে ও কষ্ট করে কালুরঘাট সেতু পাড়ি দিতে হয়। দাবী ওঠে ‘কালুরঘাটে নতুন সেতু চাই’। তবে দাবীদাররা জানেন না, ঠিক কবে এ দাবী পূরণ হবে। হয়তো হবে কোনো এক সময়!

প্রবাদে রয়েছে ‘গাঁধা পানি গোলা করে খায়’। আল্লাহ না করুক, বড় ধরণের বিপর্যয়ের পর হয়তো এ সেতু নির্মাণে সময়ক্ষেপণ করবে না রাষ্ট্র চালকরা। বিপর্যয় হলে বা কি ? শোকে মুহ্যমান আর সমবেদনার বুলি ঝরাবেন তাঁরা। ভাবান্তরে এমন উদ্ভট চিন্তা আসতেই পারে, তাতে দোষ নেই।

অতীতে বহু প্রাণহানি ঘটেছে এ সেতুতেই। সেই পরিবারগুলোর খবর, কেউ নিয়েছেন কিনা জানা নেই। হ্যাঁ, কালুরঘাটে দীর্ঘ লাইনে বা সেতুতে গাড়ি নষ্ট হয়ে কিংবা উভয় দিকের গাড়ি উঠে যানজটে রোগীর মৃত্যু বা দূর্ঘটনায় মৃত্যু আমরা প্রায়শ: দেখেছি। স্বজন হারানোর বেদনাও করেছি উপলদ্ধি। এমন ঘটনাও ঘটেছে, প্রসূতি মা, শিশুর প্রথম কান্না শুনেছেন এ সেতুতে। হয়তো মা ডাক শুনতে পারেননি আর।

বে-খেয়ালী রাষ্ট্র চালকরা এসব অনুধাবন করেন না। অনুভবের বোধ হয়তো তাঁদের নেই। তবে মজার ব্যাপার, জাতীয় নির্বাচন আসলে ভোট আদায়ে এ সেতুই হয় তাঁদের চাবিকাঠি। বুলি আওড়ান, ‘নির্বাচিত হলে হবে সেতু পুন:নির্মাণ বা নতুন সেতু। ‘কাজীর গরু কিতাবে, গোয়ালে নেই’।

স্বাধীনতার পর ক্ষমতার পালাবদলে অনেক এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন নদীর এপার ও ওপারের মানুষ। যেই লাউ, সেই কদু। ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরা হয়তো ভাবেন, ‘বৃটিশের হাতে গড়া কালুরঘাট সেতু ! এখনো চলছে তো, ভাঙ্গেনি।’

টানা তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদল বারবার এ সেতুর দাবি তুলে বক্তব্য রেখেছেন জাতীয় সংসদে। ভবিষ্যতে আরো রাখবেন। তিনি বক্তব্য রাখলেও সেই আবেদন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার বিন্দু মাত্র লেশ দেখা যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ সেতুর ব্যাপারে আন্তরিক হলেও কেনো জানি তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না!

শেষতক সাংসদ বাদল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্য বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কোনো সুরাহা না হলে পদত্যাগ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে দিয়েছেন দেশবাসীকে। তাঁর আবেদন অনুরোধের বক্তব্য শুনে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘জাগরণ’ কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়ে গেল,

‘জেগে যারা ঘুমিয়ে আছে তাদের দ্বারে আসি
ওরে পাগল, আর কতদিন বাজাবি তোর বাঁশী
ঘুমায় যারা মখমলের ঐ কোমল শয়ন পাতি
অনেক আগেই ভোর হয়েছে তাদের দুখের-রাতি।
আরাম-সুখের নিদ্রা তাদের, তোর এ জাগার গান
ছোবে না’ক প্রাণ রে তোদের, যদিই বা ছোঁয় কান।
নির্ভয়ের ঐ সুখের কূলে বাঁধল যারা বাড়ি
আবার তারা দেবে না রে ভয়ের সাগর পাড়ি।
ভিতর হতে যাদের আগল শক্ত ক’রে আঁটা
“দ্বার খোল গো” ব’লে তাদের দ্বারে মিথ্যা হাঁটা।
ভোল রে এ পথ ভোল
শান্তিপুরে শুনবে কে তোর জাগর-ডঙ্কা রোল।।’

আসা যাক বোয়ালখালীর কথায়, এ উপজেলার প্রায় দুইলাখ লোকের নগর যাতায়াতে ভরসা এ সেতু। নয়তো ‘রঅইন্ন্যা ঘুরে শহর’ যাওয়ার ব্যবস্থা তো রয়েছেই।

উপরের ভারবাহী লেখা পড়ে, মনে নিশ্চয় ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। সেতু নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম অনেক তো হলো। ক্ষোভের কথা বটে, তবে রাগলে হবে না আর হাল ছাড়লেও হবে না। কেননা এ দাবী আমাদের। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হলেও দাবী আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আন্দোলনের ফলে ২০১৫ সালে মিলে কালুরঘাটে সেতু নির্মাণ প্রকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নীতিগত অনুমোদন।

এ সেতু নির্মিত হলে পর্যটন নগরী কক্সবাজার, টেকনাফ ও পার্বত্য জেলা বান্দরবানসহ দক্ষিণ চট্টগ্রাম ঘিরে শিল্পায়ন ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে -এমনটাই প্রত্যাশা সকলের।

সেতুর দাবিতে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা অনশন করবেন আগামী ৬ জুলাই শনিবার পূর্ব কালুরঘাটে। তাদের এ কর্মসূচি সফল হোক, সার্থক হোক।

লেখক :
সাংবাদিক,
সমন্বয়ক: বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here