l শারফিন শাহ l
শহুরে সাহেবরা মুখ বাঁকিয়ে বলতে পারে, ‘গাঁও-গেরামের আবার ঈদ! যেখানে নুন আনতে পানতা শেষ সেখানে আবার ঈদ কিসের? ঈদ তো আমাদের। নতুন জামা, নতুন খাবার-দাবার, আর ফুলবাবু হয়ে ঘোরাঘুরি—আহ! গাঁও-গেরামে এত আনন্দের কম্বিনেশন আসবে কোত্থেকে?’ আসে আসে। মেঘলা আসমান ফুঁড়ে যেমন বৃষ্টির ফোয়ারা নামে, অন্ধকারকে ধাক্কা মেরে যেমন আলো হেসে উঠে, বেদনার বুকে বুক মিলিয়ে যেমন পাখি সুরের ঝংকার তোলে, গাঁও-গেরামের মানুষেরাও তেমন সব অভাব-অনটন, দুঃখ-দারিদ্র্য, জরা-জীর্ণতাকে ঝাঁটা মেরে ঈদ আনন্দে মেতে উঠে।
প্রমাণ চান? আমি নিজেই তো একটা প্রমাণ। গেরামের ঈদ নিয়ে আমার স্মৃতির সিন্দুকে জমা আছে সোনার মতো ঝকঝকে কিছু স্মৃতি। সেখান থেকেই কিছু বের করছি এবার। তখন আমাদের বাড়িতে কোনো রেডিও-টেলিভিশন ছিল না। কারণ আমার আব্বার একটাই কথা ছিল, ‘রেডিও-টেলিভিশন অইল শয়তানের বাকশো। ঘরে শয়তানের বাকশো রাখা চলবে না।’ তো যেহেতু রেডিও-টিভি নেই সেহেতু মসজিদের মুয়াজ্জিন ডাক দিলে আমরা সবাই ঘুম ছেড়ে সেহরি খেতাম আর সারাদিনের রোজার পরে ইফতার করতাম। দিনটি ছিল ২৯ রমজান। সেদিন চাঁদ উঠলে পরের দিন ঈদ হওয়ার কথা। আকাশ ছিল মেঘলা তাই চাঁদ উঠেছে কিনা বোঝার উপায় নেই। রাতে খানিকক্ষণ আকাশে উঁকিঝুকি মেরে প্রতিদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। ভোররাতে মুয়াজ্জিন ডাক দিল, ‘উঠুন সেহরি রান্না করুন, সেহরি খান!’ আম্মা সেহরি রান্না করলেন আর আমরা সেহরি খেলাম। পরের দিন সকালবেলা পাশের বাড়ির করিম চাচা এলেন আমাদের বাড়ি। তিনি পান চিবোচ্ছেন আর পিক ফেলছেন। আমরা তো অবাক। আম্মা বললেন, ‘আপনে রোজা রাখেননি?’ মতিন চাচা বললেন, ‘রোজা আবার কী, আইজ তো ঈদ! শোন নাই রেডিওতে ঈদের গান অইতাছে!’
শহরে ঈদ বোনাস, সেলামি নিয়ে ব্যাপক কাণ্ডকারখানা চলে। কিন্তু গেরামে এইসব নিয়ে তেমন লম্ফঝম্ফ নেই। তবে একবার আমি নিজে ঈদ সেলামি দিতে গিয়ে মধুর ঝামেলায় পড়েছিলাম। আমাদের পাড়ার কিসলু নামের এক বাচ্চা ছেলের গোমড়া মুখ দেখে তাকে দশ টাকা সেলামি দিলাম। অমা কিছুক্ষণ বাদে দেখি পুরো এক ডজনের একটি বাচ্চা ছেলের দল আমার সামনে এসে হাজির! জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী চাও বাচ্চারা?’ একটা বাচ্চা সামনে এসে বলল, ‘আপনি কিসলুরে টাকা দিছেন। আমাগরেও দেন!’
আমি তো পুরাই ‘থ’। ওদের ধমক দিয়ে বললাম, ‘আমি কি টাকার কুমির রে। যা ভাগ সব! আমার কাছে টাকা নেই।’ একটা বাচ্চা বলল, ‘আপনার লগে অনেক টাকা আছে। কিসলু কইছে। টাকা দেন নইলে আমরা যামু না।’
মহা ঝামেলায় পড়া গেল। এই কিসলু ব্যাটা তো মহা বিটলা। আমার কাছে কত টাকা আছে সেটাও সে বুঝে গেছে। অবস্থা দেখে মনে হলো এই বাচ্চারা আমাকে ছাড়বে না। তাই সবাইকে দশ টাকা করে একশত বিশ টাকা দিলাম। টাকা পেয়ে সবাই একযোগে এমন একটা হাসি দিল যে আমিও ওদের সাথে হাসতে লাগলাম।
আরেকবারের ঘটনা। ঈদের দিন মেজো মামা দাওয়াত দিয়েছেন। মামার বাড়ির দাওয়াত বলে কথা। তাই ছুট দিলাম। গিয়ে দেখি এলাহি কারবার। জিভে জল আনা খানাদানার আয়োজন। আমার আর তর সইছিল না। তাই চটজলদি হাতমুখ ধুয়ে গপাগপ খাওয়া শুরু করলাম। মামা বললেন, ‘খাও বাবা সবই তোমার জন্য।’ আমি ভেতরে খুশি হলেও বাইরের সৌজন্যতার খাতিরে বললাম, ‘সবই আমার জন্য মানে, আপনারা খাবেন কী?’
মামা বললেন, ‘আমরা তো পোলাও-মাংস খাই না বাবা, আমাদের পেটে গণ্ডগোল অয়! আমরা শাক-সবজি আর ডাল খাব।’
আমি বললাম, ‘তাই বলে ঈদের দিনও খাবেন না?’
মামী বললেন, ‘খানাপিনায় কী ঈদের আনন্দ আছে বাবা? ঈদের আনন্দ তো মনে! মনের খাওয়া অইলেই পেটের খাওয়া অয়।’
মামীর কথার মধ্যে একটা দার্শনিকতার গন্ধ পেলাম। হঠাত্ লক্ষ করলাম মামীর পরনের শাড়িটা পুরোনো। রঙটা ময়লা। মামার তো টাকা-কড়ির অভাব নেই। তারপরও এই অবস্থা কেন বুঝলাম না! কোনো ঝুট-ঝামেলা আছে কিনা তা আবিষ্কার করতে মামীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামী, আপনারা ঈদে নতুন পোশাক-আশাক কিনেননি?’ মামী হেসে বললেন, ‘পোশাকে কী আর ঈদের আনন্দ আছেরে বাবা? ঈদের আনন্দ তো থাকে মনে! মনে আনন্দ না থাকলে পোশাকে কাজ হয় না। গত বছর ঈদের সময় আমরা বেড়াতে গেলাম ঢাকায়। আমার ভাইয়ের বাড়ি। সেখানে ওদের কত রঙ-বেরঙের খাবার আর পোশাক। অথচ তারা কি সুন্দর করে ঝগড়া করল! আর আমাদের সাধারণ পোশাক আর সাধারণ খাবার, আনন্দ কি কম!’
মামীর কথা শুনে মনে পড়ল আমার এক স্যারের কথা। তিনি বলেছিলেন, ‘শহরে ঈদের আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় শপিংমলে, পার্কে আর রেস্তোরাঁয় কিন্তু গাঁও-গেরামের ঈদের আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায়, আর মানুষের মনে মনে! সুতরাং গাঁও-গেরামের ঈদ আনন্দই শতভাগ খাঁটি ঈদ আনন্দ।’
স্যারের কথাও শতভাগ খাঁটি। তার প্রমাণ প্রতিবছর ঈদ মৌসুমে শহর ছেড়ে হাজার হাজার মানুষের বাস, লঞ্চ, ট্রেনে বাদুরঝোলা হয়ে গেরামে ছুটে চলা—শতভাগ খাঁটি ঈদ আনন্দের জন্য!
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here