হানিফ সংকেত
আশির দশক থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করছি। সে সময় অনেকেরই অভিযোগ ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে স্বাধীনভাবে অনুষ্ঠান করা যায় না। নিয়ন্ত্রণে থেকে সৃজনশীল অনুষ্ঠান করা সম্ভব নয়। এসব কারণেই ’৯৪ সালের শুরুর দিকে আমরা প্রথম আন্দোলন শুরু করেছিলাম, যাতে টিভির বাইরে এসে অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে পারি, যা পরবর্তী সময়ে টিভি নীতিমালার আলোকে টিভিতে প্রচারিত হবে। সেই আন্দোলনের ফসল হিসেবেই ১৯৯৪ সালের ১৮ নভেম্বর প্রথম প্যাকেজ অনুষ্ঠান হিসেবে ইত্যাদির যাত্রা শুরু হয় এবং সূচিত হয় বেসরকারি অনুষ্ঠান নির্মাণের পথ।
আশির দশক থেকে অনুষ্ঠান করলেও ‘ইত্যাদি’ শুরু ১৯৮৯ সালের মার্চে। এই দীর্ঘ সময়ে কাজ করতে গিয়ে টিভির রীতিনীতির অনেক পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন দেখেছি। ’৮২ সালের সামরিক শাসন থেকে শুরু করে তিনটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দুটি রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন মেয়াদের সরকার এবং ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিগত সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেছি। আর এখন ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে নবীন-প্রবীণের অন্তর্বর্তীকালীন নির্দলীয় সরকারের আমলে প্রবেশ করেছি।
২০০৯ সালে মহাজোটের মন্ত্রিসভা গঠনের আগেই প্রথম আলোতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে ‘ভবিষ্যৎ তথ্যমন্ত্রী সমীপে’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। আমাদের আশা ছিল, দেশে সত্যিকার অর্থেই একটি সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক ধারা চালু হবে। সব মত, পথ ও বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঠিক মূল্যায়ন হবে। আর গণমাধ্যমে উঠে আসবে সেসব চিত্র। কিন্তু সেই চিত্র কি আমরা দেখেছি? লেখাটি যখন লিখেছি, তখন দেশে এত গণমাধ্যম ছিল না। ছিল না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এত ব্যাপকতা।
রাষ্ট্রের প্রধান প্রচারযন্ত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রতিই সবার আকর্ষণ ছিল বেশি। দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ধরে একনাগাড়ে বিটিভিতে কাজ করতে গিয়ে বিটিভির নিয়ম–অনিয়ম, নীতি–দুর্নীতি এবং সরকার পরিবর্তনের পর অনেকের চরিত্রের পরিবর্তন, অদৃশ্য ইঙ্গিতে কালোতালিকাভুক্ত করা, ননসেন্স সেন্সর—এটা দেখানো যাবে না, ওটা দেখানো যাবে না ইত্যাদি দেখেছি।
বাংলাদেশে একমাত্র ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানটিই সব সময় আট–নয়জনের একটি প্রিভিউ কমিটি দেখে থাকেন। সময়-সময় কমিটির সদস্য পাল্টায়, যুক্ত হয় দলীয় সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী। অধিকাংশ সময়ই কমিটির আপত্তি অযৌক্তিক মনে হলে আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থাকতাম। কারণ, আমার শক্তি ছিল ইত্যাদির কোটি কোটি দর্শকের ভালোবাসা। কখনো কোনো তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিনি, কথাও বলিনি। তাঁরাও কখনো ডেকে কথা বলেননি। মূলত তথ্যমন্ত্রীরা রাজনৈতিক বিষয় নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন।
প্রতিটি আমলেই ইত্যাদিকে তার চেনারূপেই দেখা গেছে, কখনো চরিত্র পাল্টায়নি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সম্পর্কে জানতে এবং জানাতে ইত্যাদির টিম নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই দেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তে। তুলে ধরতে চেষ্টা করি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সৌন্দর্য। সামাজিক অসংগতি তুলে ধরে সম্প্রীতির কথা বলি, সচেতন হতে বলি। ইত্যাদিতে থাকে না কোনো রাজনীতি বা দলীয় মতবাদ। থাকে না কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা আমলার উপস্থিতি। তাই দলমত-নির্বিশেষে সবার কাছেই ইত্যাদি সমান জনপ্রিয়।
আমি যখন অনুষ্ঠানটি শুরু করি, তখন দেশে কোনো স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না। তাই বিটিভিতেই শুরু করি। বিটিভি যেমন সরকার নিয়ন্ত্রিত, চ্যানেলগুলো তেমনি মালিক নিয়ন্ত্রিত। যিনি যেই মতবাদের, তিনি সেভাবেই তাঁর চ্যানেল চালান। যেদিকে সুবিধা, সেদিকে ছাতা ধরেন। বিভিন্ন আমলে বিভিন্ন প্রকৃতির চাটুকার দেখেছি। ইদানীং এই তোষণ বা তোষাও একটি পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তোষামোদ কর্মের জন্য কোনো মেধা বা নীতির প্রয়োজন হয় না। ক্ষমতার নৈকট্য লাভের জন্য এঁরা সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে থাকেন। এর ফলে পদক পাওয়া, পদবি পাওয়া, লাইসেন্স পাওয়া, খেতাব পাওয়া, রাষ্ট্রীয় সফরে স্থান পাওয়া, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া ইত্যাদি নানান প্রাপ্তি ঘটে। আমার দীর্ঘ টেলিভিশন জীবনে এই চাটুবৃত্তির বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছি।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে দেওয়া একটি বিজ্ঞপ্তিতে কোনো বিজ্ঞাপনে তাঁর ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ করার নির্দেশনা দেখে ভালো লেগেছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের আশার আলো দেখায়। বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রপ্রধানের ছবিসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে নানা ধরনের বিজ্ঞাপন দেখা যেত। প্রধান উপদেষ্টার এই নির্দেশনা থেকে অনেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।’ এ ধরনের পারিষদের প্রয়োজন নেই। এদের সংখ্যা কমিয়ে শূন্যে আনতে হবে।
দেশে এখন সম্প্রচারে আছে ৩০টির অধিক চ্যানেল। এর মধ্যে কটি যে সত্যিকার ‘টেলিভিশন’ হতে পেরেছে, সে এক বড় প্রশ্ন। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে চ্যানেল সংখ্যা বাড়লেও সবই যেন একই রকম। মাঝেমধ্যে লোগো দেখে বুঝতে হয় কোনটা কোন চ্যানেল।
এবারের আন্দোলনে গণমানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে ‘যমুনা টেলিভিশন’। কারণ, এর সংবাদ প্রকাশে ছিল ভিন্নতা। কথা হয়েছিল যমুনা টিভির সিইও স্নেহভাজন ফাহিম আহমেদের সঙ্গে। অভিনন্দন জানালাম—বলল, ‘একটু ঝুঁকি নিয়েই সত্য প্রকাশ করতে হয়েছে।’ এটাই বাস্তবতা। কিন্তু ঝুঁকি কেন থাকবে? মিডিয়ার স্বাধীনতা হরণই এর জন্য দায়ী। নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণমাধ্যমের দলীয় সংস্কৃতি থেকে সবাই মুক্তি চায়।
আমাদের সংস্কৃতি আমাদের অনন্ত অক্ষয় সম্পদ এবং সামাজিকতা আমাদের জাতিসত্তার পরিচয়। আত্মপরিচয়ের এই অহংকার আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আর সেটা সম্ভব একটি বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে। যাদের প্রাণের বিনিময়ে এই বিজয় অর্জিত হয়েছে, তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সর্বজন শ্রদ্ধেয় নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি তিনিই এখন তথ্য উপদেষ্টা। সুতরাং এবার আশা করছি দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রটি তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে। সব গণমাধ্যমও সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার সাহস পাবে। মাননীয় তথ্য উপদেষ্টার কাছে সবিনয় নিবেদন, এবারের এই স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্জন হোক ‘অসত্য’ তথ্যবর্জিত একটি স্বাধীন গণমাধ্যম। যেখানে গণমাধ্যমকর্মীরা স্বাধীনতা ও নৈতিকতা বজায় রেখে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করতে পারবেন। যেখানে দল–মতনির্বিশেষে সবাই মন খুলে কথা বলতে পারবেন।
● হানিফ সংকেত: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
প্রথম আলোর সৌজন্যে