মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন : ৯০ বছরের পুরোনো কালুরঘাট সেতু এখন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টিতে সেতুর পিচ ওঠে কঙ্কালসার হয়ে গেছে। জীর্ণশীর্ণ সেতু দিয়ে প্রতিদিন মৃত্যু সওয়ারি হচ্ছেন লাখো মানুষ।
⇒ টেন্ডার প্রসেসিং করতে ২-১ মাস
সময় লাগতে পারে : জিএম
স্থানীয়রা জানায়, মেয়াদোত্তীর্ণ কালুরঘাট সেতুর অবস্থা অনেক আগেই নাজুক ছিল। সাম্প্রতিক সময়ের অতিবৃষ্টিতে সেতুর অবস্থা আরও করুণ আকার ধারণ করে। ছোট-বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে হাঁ করে রয়েছে। যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তবে সেতুর ইজারাদার প্রতিষ্ঠান ইটের খোয়া ফেলে গর্তগুলো ভরাট করার চেষ্টা করলেও বৃষ্টির পানি আর গাড়ির চাপে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
⇒ ১০ টনের অধিক ভারী ওজনের
গাড়ি চলাচল করায় সেতুটি নাজুক
হয়ে পড়েছে : প্রকৌশলী
সেতুর ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আলহাজ মো. আলম (ববি) পূর্বকোণকে বলেন, প্রতি বছর সেতু থেকে সাড়ে ৫ কোটি টাকার ইজারা আদায় করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তা থেকে আধা-এক কোটি টাকা খরচ করলেও কোন রকমে যানবাহন চলাচল করতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় সেতুটি এখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যেকোনো মুহূর্তে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
২০০১ সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছিল রেল। ১০ টনের অধিক ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সেতুর দুই পাশে দুটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দায় সারে রেল। জরাজীর্ণ সেতুর উপর প্রতিদিন চলাচল করছে ২০-৩০ টন ওজনের যানবাহন। এ বিষয়ে কোন নজরদারি নেই।
বোয়ালখালী সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক হেলাল উদ্দিন টিপু বলেন, সেতুর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ায় যানবাহন চলাচলের সময় সেতুটি কাঁপতে থাকে। আল্লাহর নাম জপে সেতু পার হই।
বোয়ালখালী পৌরসভার প্যানেল মেয়র শাহজাদা এস এম মিজানুর রহমান বলেন, ‘৯১ সালের পর থেকে রেল কাম সড়ক সেতু নির্মাণের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছি বোয়ালখালী তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। শুধু প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসে দিন কাটছে। বাস্তবের কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে, টানা বৃষ্টিতে সেতুর পিচ ওঠে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছে। স্থানে স্থানে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত। শুধু তাই নয়, রেল বিটও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কয়েক স্থানে রেল বিটের ফিস প্লেট ধসে গেছে। বিট দেবে গিয়ে রেল চলাচলে জন্য মারাত্মক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদে পদে হাঁ করে রয়েছে বিপদের আশঙ্কা। সেতুটি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়লেও না দেখার ভান ধরে রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কয়েক মাস ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যানবাহন চলাচল করলেও সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়নি রেল।
কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম কাজেম বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। চট্টগ্রামে অনেক বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু একটি সেতুর কারণে পিছিয়ে পড়ছে শহরতলীর একটি জনপদ। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সেতুটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়লেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কুম্ভকর্ণে ঘুম ভাঙছে না। একমাত্র রেলওয়ের অবহেলার কারণে সমালোচিত হচ্ছে সরকার।
জানা যায়, গত মঙ্গলবার সেতুর সংস্কারের জন্য রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের (জিএম) আবেদন করেছেন স্থানীয়রা। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাছির উদ্দিন গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘আমি পরিদর্শন করেছি। চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে বলছি, যত তাড়াতাড়ি পারে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়ার জন্য।’ সংস্কার কাজ কখন শুরু হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার তো একটা প্রসেস আছে। যে কাউকে তো কাজ দিতে পারি না। টেন্ডার আহ্বান করতে হবে। টেন্ডার দাখিল হবে, ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে।’
জিএম একদিকে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কথা বললেও পরক্ষণে বলেন, কোন সমস্যা নেই। খুব তাড়াতাড়িই কাজ ধরব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোন প্রকল্প লাগবে না। রেভিনিউ থেকে আমরা সংস্কার করব। তবে একটু সময় লাগবে।’ কত মাস সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রসেসিং করতে ২-১ মাস সময় লাগতে পারে।’
একই কথা বললেন সেতু প্রকৌশলী আবরার হোসেন। তিনি বললেন, ‘ট্রেন চলাচলের উপযোগী রয়েছে। যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে খারাপ হয়ে পড়েছে। বর্ষা শেষ হলে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে। কারণ বর্ষাকালে কাজ টেকসই হবে না।’
১০ টনের অধিক ওজনের যানবাহন চলাচলের কারণে সেতুর অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রকৌশলী আবরার হোসেন বলেন, ‘দুই পাশে দুটি বেরিয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল। কে বা কারা তা ভেঙে ফেলেছে।’
কালুরঘাট সেতুর টোল ও রেলওয়ে সূত্র জানায়, কালুরঘাট সেতু দিয়ে দৈনিক চারটি যাত্রী ও একটি তেলবাহী ওয়াগন চলাচল করে। ছোট-বড় মিলে কমপক্ষে ৩০-৪০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। ট্রেন ও বিভিন্ন যানবাহনে প্রতিদিন দেড় লক্ষাধিক মানুষ সেতু পারাপার করে।
বোয়ালখালী টেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিম বলেন, রেলের ফিস প্লেট ধসে যাওয়ায় ট্যাক্সি-টেম্পোর চাকা প্রায়ই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যানবাহন চলাচল বিকল হয়ে প্রতিদিন যানজট লেগে রয়েছে। প্রসূতি ও রোগীবাহনকারী এম্বুলেন্স বা যানবাহনকেও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যাত্রীদের শ্রমঘণ্টা যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ক্ষতির মুখে পড়ছে গাড়ি মালিক-শ্রমিকেরা।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ‘৮০ দশকে সেতুর মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। এরপর থেকে জোড়াতালি দিয়ে সেতুটি টিকিয়ে রাখা হয়েছে।