সাইফুল ইসলাম আল-আযহারি

আলহামদুলিল্লাহ একটি বছর পরে আবার আমাদের মাঝে পবিত্র জিলহাজ মাস ফিরে এসেছে। এই মাসে সমগ্র দুনিয়া থেকে আল্লাহর বান্দাগণ কাবা ঘরের দিকে অভিমুখী হচ্ছে। একদিকে হাজীরা হজের কার্যক্রম সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অন্যদিকে আমরা আল্লাহর দেয়া বিধান কোরবানির প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। কোরবানি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে এক বিশেষ অনুগ্রহ। কেননা বান্দাহ কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারে। কোরবান শব্দটি কুরবুন শব্দ থেকে উৎকলিত। অর্থাৎ নিকটবর্তী হওয়া, সান্নিধ্য লাভ করা। শরিয়তের দৃষ্টিতে ১০ জিলহজ হতে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবেহ করাকে কোরবানি বলে।

 কোরবানির ইতিহাস
মানবসৃষ্টির শুরু থেকেই কোরবানির বিধান চলে আসছে। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতে এ কোরবানি ছিল একটি অপরিহার্য অংশ। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানির এক রীতিপদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওই সব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেসব আল্লাহ তাদের দান করেছেন’ (সূরা হজ-৩৪)।

মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কোরবানি হজরত আদম আ:-এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কোরবানি। আন্তরিকতা ও উদ্দেশ্যের সততার কারণে হাবিলের কোরবানির কবুল হলো, কিন্তু নিষ্ঠার অভাব ও অমনোযোগিতার কারণে কাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে প্রত্যাখ্যাত হলো।
কোরবানির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন হজরত ইবরাহিম আ: ও হজরত ইসমাঈল আ:। মহান আল্লাহর জন্য হজরত ইবরাহিম আ:-এর সর্বোৎকৃষ্ট ত্যাগ এবং হজরত ইসমাঈল আ:-এর আত্মোৎসর্গ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দ হলো যে, তিনি ইব্রাহিম আ:-কে আপন বন্ধুরূপে (খলিলুল্লাহ) গ্রহণ করলেন। শুধু তা-ই নয়, মহান আল্লাহ তাকে মুসলিম জাতির পিতার আসনে অভিষিক্ত করলেন এবং তার ছেলে ইসমাঈল আ:-এর পবিত্র বংশধারায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর উত্থান ঘটালেন। তিনি হজরত ইব্রাহিম আ: ও হজরত ইসমাঈল আ:-এর ত্যাগের ইতিহাসকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য সর্বকালের সব সচ্ছল মানুষের জন্য কোরবানিকে বাধ্যতামূলক করলেন।

কোরবানির মৌলিক শিক্ষা
আমাদের জীবন, আমাদের সম্পদ সব কিছুই মহান আল্লাহর দান। পরম প্রভুর জন্য প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে পারাই কোরবানির শিক্ষা। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বান্দার গোলামি প্রকাশ পায়, তার প্রভুর জন্য তার ভালোবাসা ও ত্যাগের মাত্রা নির্ণীত হয়। আল্লাহর দান আল্লাহকে ফিরিয়ে দিতে আমরা কতটা প্রস্তুত, তারই একটি ক্ষুদ্র পরীক্ষা হলো কোরবানি। আমাদের জীবনসম্পদ আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতিই গ্রহণ করি কোরবানির মাধ্যমে। কোরবানি দোয়ার মধ্যে মৌলিক যে কথাটি আমরা বলি তা হলো “আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সারা জাহানের ‘রব’ আল্লাহর জন্য” (সূরা আনআম-১৬২)। মূলত আমাদের জীবন ও সম্পদের মালিক আল্লাহ। এ দুটো জিনিস আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করাই ঈমানের অপরিহার্য দাবি এবং জান্নাত লাভের পূর্বশর্ত। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন’ (সূরা তওবা-১১০)। কাজেই জীবনসম্পদ আল্লাহর এবং তা আমাদের কাছে আমানত। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ও তার পছন্দনীয় পথে ব্যয় করাই ঈমানের দাবি। কোরবানি মানুষকে ঈমানের এ দাবি পূরণের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে।

কোরবানির প্রাণশক্তি
কোরবানির উদ্দেশ্য আবশ্যই সৎ হতে হবে এবং তাতে ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ থাকতে হবে। কোরবানি প্রদর্শন ইচ্ছা ও অহঙ্কারমুক্ত হতে হবে। অনেকেই বাহবা পাওয়ার জন্য ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হওয়ার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার গরু বা উট কিনে লাল ফিতা বেঁধে পথে পথে ঘোরান। এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো সচ্ছল ব্যক্তির জন্য জীর্ণশীর্ণ কম দামি পশু কোরবানিও অনুচিত। এ ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বাণীর দিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ বলেন- ‘ওই সব পশুর রক্ত-গোশত আল্লাহর কাছে কিছুই পৌঁছে না, বরঞ্চ তোমাদের পক্ষ থেকে তোমাদের তাকওয়া তাঁর কাছে পৌঁছে ’ (সূরা হাজ )। এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট, উদ্দেশ্যের সততা ও খোদাভীতি কোরবানি কবুলের শর্ত। পশুটি কত বড় ও কত দামের সেটা আল্লাহর কাছে কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। ভোগ নয়, ত্যাগেই আনন্দ- এটিও কোরবানির একটি শিক্ষা। কোরবানির গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করে তাদের মুখে হাসি ফোটানোও কোরবানির অন্যতম লক্ষ্য। রাসূল সা: কোরবানির তিন ভাগের এক ভাগ গোশত গরিবদের মাঝে বিতরণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। ইচ্ছে হলে এর বেশি; এমনকি সবটাও দান করা বৈধ। কোরবানির গোশত খাওয়া ও সংরক্ষণ বৈধ, তবে তা করতে গিয়ে কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য ‘অন্যের জন্য ত্যাগ’ যেন লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে আমাদের সবাইকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শুধু পশু নয়, পশুত্ব কোরবানি করাও কোরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভেতরের পশুত্বকেও কোরবানি করতে হবে।

গুরুত্বপূর্ণ আমল সমূহ 
কোরবানি সংক্রান্ত একটা বিশেষ মাছআলা হল- ৯ জিলহজ্জ ফজর থেকে শুরু করে ১৩ জিলহজ্জ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক বলা ওয়াজিব। জামাআতে নামায হোক বা একাকী, সর্বাবস্থায় এটা বলতে হবে। পুরুষ হোক বা নারী সকলকে বলতে হবে। তাকবীরে তাশরীক হলো :-  أَللّٰهُ أَكْبَرُ أَللّٰهُ أَكْبَرُ لَا إِلٰهَ إلَّا اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ أَللّٰهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الْحَمْدُ
ঈদুল আযহার দিনে যে সমস্ত সুন্নাত রয়েছে, সেগুলোও আমরা খেয়াল করে আমল করি। ঈদুল আযহার দিনে বিশেষ ১৩ টা সুন্নাত রয়েছে :
১. ভোরে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা।
২. মেসওয়াক করা।
৩. গোসল করা।
৪. যথা সাধ্য উত্তম পোশাক পরিধান করা।
৫. শরীয়ত সম্মতভাবে সাজ-সজ্জা করা।
৬. খুশবূ লাগানো।
৭. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কোন কিছু না খাওয়া।
৮. আগে আগে ঈদগাহে যাওয়া।
৯. ঈদুল আযহার নামায সকাল সকাল পড়া।
১০. পারলে ঈদগাহে যেয়ে ঈদগাহে নামায পড়া উত্তম।
১১. পায়ে হেটে ঈদগাহে যাওয়া।
১২. যাওয়ার সময় এই তাকবীর জোরে জোরে পড়ে পড়তে যাওয়া- أَللّٰهُ أَكْبَرُ أَللّٰهُ أَكْبَرُ لَا إِلٰهَ إلَّا اللّٰهُ وَاللّٰهُ أَكْبَرُ أَللّٰهُ أَكْبَرُ وَلِلّٰهِ الْحَمْد
১৩. এক রাস্তায় যাওয়া, অন্য রাস্তা দিয়ে প্রত্যাবর্তন করা।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের সব কিছু সহীহভাবে আমল করার তাওফীক দিন। পশু কোরবানির মাধ্যমে ঈমানের সাক্ষ্য প্রদান এবং পশুত্ব কোরবানির মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়াই কোরবানির দাবি। কোরবানির মাধ্যমে ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা ইত্যাদি পশুত্বকে দমন করে মানুষের সুকুমারবৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারলে আমাদের কোরবানি সার্থক হবে এবং সমাজে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে। পরিশেষে আল্লাহর কাছে সকলের কোরবানি কুবল ও সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।

লেখক: ভাইস প্রিন্সিপাল, ইন্টারন্যাশনাল মাদ্রাসাতুল কুরআন।

https://alowkitaboalkhali.com/%e0%a6%87%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%ae%e0%a6%bf-%e0%a6%9a%e0%a7%87%e0%a6%a4%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%95%e0%a7%8b%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%bf/

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here