প্রফেসর শেখ এ.রাজ্জাক রাজু
ছোট্ট একটি ভাইরাস – নাম তার “করোনা” l গোটা বিশ্বের মানুষ এই ভাইরাসের ভয়ে আতংকিত ও ঘর বন্দি l মহামারি করোনার থাবা বিশ্বের সব জনপদের মতো বাংলাদেশের জন- জীবনকেও বিপন্ন করে তুলেছে সেই সাথে অর্থনীতির চাকাও স্থবির করে দিয়েছে l বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উৎকর্ষের যুগেও পৃথিবীর মানুষকে অমানিশার ঘোরে এতটা হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দিবে, এতটা পরাস্ত করবে, কেউ কোনোদিন, কখনো ভাবতেও পারেনি l কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর! করোনা পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনধারাকে l
আমাদের চারপাশে একটা অদ্ভুত অচেনা পরিবেশ বিরাজ করছে l অনেক পরিচিত কাছের মানুষগুলো কেমন যেন অচেনা, অপরিচিত হয়ে গেছে l দেখা দিয়েছে খাদ্যের, চিকিৎসা, লেখাপড়ার, স্বাভাবিক চলা ফেরার এমনকি দাফন -কাফনের অনিশ্চয়তা l লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে- শ্রমিক, কল- কারখানায় থমকে গেছে উৎপাদনের চাকা; বিশেষ করে শিক্ষক সমাজ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত l শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একনাগারে দীর্ঘ ১৬ মাস বন্ধ থাকার কারণে l করোনায় অনেক মানুষের মুখোশ খুলে দিয়েছে এবং বুঝা গেছে কে আপন,কে পর l দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন ভূমিকা আর কিছু মানুষের অমানবিক আচরণ আমাদেরকে বিস্মিত করেছে; তারা ভুলেই গিয়েছে যে, আমরা শিক্ষক- শিক্ষিত সমাজের মানুষ l
করোনাকালীন এই ১৬ মাসেই ৫০ বছরের চেনা মানুষগুলো কেমন যেন অচেনা হয়ে গেছে ! শিক্ষকেরা সারা জীবনব্যাপী সমাজে শিক্ষা বিস্তারে জীবনকে উৎসর্গ করেছে জ্ঞান দান করতে করতে l প্রবাদ আছে,”অর্থই অনর্থের মূল” কিংবা ” বিদ্যাহীন মানুষ পশুর সমান” l কিন্তু সেই শিক্ষকদের অনেকেই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে জীবনের পড়ন্ত বিকেলে কারো পশুর(গরুর) খামারের কর্মচারী,কেউবা জুতা ,আম- সবজি, মাছ বিক্রেতা অথবা রিক্সা- ভ্যান, বাইক …..চালিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে l
কথিত আছে,” খিদে পেলে বাঘেও ধান খায়” l কিন্ডারগার্টেন ও নন- এমপিও স্কুল, কলেজের শিক্ষকেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অস্বীকার করার উপায় নেই l পার্থিব জীবনে ধনী-গরিব, শিক্ষক- কর্মচারী, ব্যাংকার,মন্ত্রী- এমপি, জজ-ব্যারিস্টারদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও “করোনা” কিন্তু ধনী- গরিব, ছোট – বড়, জাতি -ধর্ম- বর্ণকে পার্থক্য করেনি lতাই, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছেl এক্ষেত্রে অর্থ সত্যিই অনর্থের মূল বলে প্রমাণিত হয়েছে l
পৃথিবীর সমস্ত অর্থ – সম্পদের বিনিময়ে কখনোই মৃত্যু রোধ করা যায়নি, যাবেও না- এটাই স্বতঃসিদ্ধ l মৃত্যুর কাছে আমরা সবাই পরাজিত- নির্মম সত্য এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতাও বটে l মুক্তিযুদ্ধ গিয়েছে,ঘূর্ণিঝড় – বন্যা,খরা-দুর্ভিক্ষ কত কিছুই না দেখেছে এদেশের মানুষl তবুও আঁকড়ে ধরে বেঁচেছে- মরেছে l নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে নিজের খাবার, ঘর -বিছানা ভাগাভাগি করে থেকেছি এই ” আমরাই”l আত্মীয়,বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশির অসুখ কিংবা মৃত্যুর খবর শুনলেই ছুটে যেতেন তাদের বাড়িতে বা হাসপাতালে l স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভীড় সামলাতে হিমশিম খেতে হতো l লাশবাহী গাড়ি দেখলেই হিন্দু- মুসলিম, ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে ভীড় লেগে যেতো l কিন্তু আজ সেই ” আমরাই ” কেমন যেন হয়ে গেছি!
মহামারি করোনা আমাদের জীবনকে পাল্টে দিয়েছে,সহমর্মিতা, সহযোগিতা মানবিকতা যেন ভুলতে বসেছি l করোনাই পাশের বাড়ির বা ফ্ল্যাটে কেউ মারা গেলে একনজর দেখার চেষ্টাও করি না এমনকি মৃত ব্যক্তির গোসল করানোর লোক খুঁজে পাওয়া দুস্করl করোনাই হয়তো বা আমাদের এই সমাজের মানুষকে নিষ্ঠুর করে তুলেছে l করোনাই শিখিয়েছে এই নির্মম- নিষ্ঠুর বাস্তবতা l তবুও পরিশেষে বলি,” আসুন আমরা সকলে সচেতন ও মানবিক হইl তাহলেই, মানবতা ও মানবিকতার জয় হবে” l
প্রফেসর শেখ এ.রাজ্জাক রাজু- শিক্ষা উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ:হালিশহর সেন্ট্রাল কলেজ, চট্টগ্রাম; পিএইচডি গবেষক, লেখক ও সংগঠক l