প্রতিবেদক :

দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের অন্যতম সূতিকাগার চট্টগ্রামে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দান। দীর্ঘ বছর অবহেলিত থাকলেও এই ময়দানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছয়দফা সহ বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতি স্মারক। টেরাকোটার কারুকাজে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ধূসর বালি ময়দানকে মোড়ানো হয়েছে সবুজে সবুজে। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় চার কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনও করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশেষে নতুন বছরের শুরুতেই আজ দুপুরে উন্মুক্ত করা হয়েছে ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানটি।

সোমবার (২ জানুয়ারি) দুপুর ১টার দিকে লালদীঘির ময়দানটি উন্মুক্ত করে দেন প্রকল্পটির উদ্যোক্তা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। লালদীঘির ময়দানটির মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ মুসলিম হাই স্কুল কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকার পাশাপাশি এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চসিকের সহযোগিতা চান তিনি। পাশাপাশি বিকেল থেকে যে কোন অনুষ্ঠান করতে মাঠের অনুমতির জন্য জেলা প্রশাসন গঠিত কমিটি থেকে অনুমোদন নেওয়ার কথাও জানান শিক্ষা উপমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘স্কুল চলাকালীন সময়ে মুসলিম হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করবেন। তবে স্কুল ছুটির পর এলাকাবাসী বিকেলে হাঁটতে পারবেন। এছাড়া রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন থাকবে। নির্দিষ্ট ফি দিয়ে জেলা প্রশাসন গঠিত কমিটি থেকে অনুমোদন নিয়ে মাঠটি ব্যবহার করা যাবে। তবে মাঠে কোনভাবেই মাইক্রো স্ট্যান্ড আর কোন ধরনের মেলা বসতে দেওয়া হবে না।’

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রায় চার কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০২০ সালে কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০২১ সালে ১০ মার্চ। গত ৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের ২৯টি প্রকল্প উদ্বোধনের সময় পলোগ্রাউন্ড মাঠ থেকে ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে এই লালদীঘির ময়দানের সংস্কার কাজও উদ্বোধন করেছিলেন। লালদীঘি ময়দান নামে পরিচিত হলেও সরকারিভাবে এই মাঠটির মালিকানা চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের। সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ার আগে এই বিদ্যালয়, লালদীঘি এবং আশপাশের এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতো এই মাঠেই। 

উন্মুক্ত হওয়ার পর লালদীঘি মাঠে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলসহ অন্যন্যা নেতৃবৃন্দ, পাশে খেলায় মেতেছে স্কুলের ছাত্ররা ।

চট্টগ্রামের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৭৬১ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চট্টগ্রামের শাসনভার গ্রহণ করে, তখন থেকেই লালদীঘিকে কেন্দ্র করে এই শহরের যত কর্মচাঞ্চল্য বিস্তার লাভ করে। লালদীঘি পাড়ের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের দপ্তরটি ব্রিটিশ আমলের। তখন এটি তহশীল দপ্তর ছিল। লাল রঙের সেই ভবনকে চট্টগ্রামের মানুষ ‘লালকুঠি’ নামে চিনতো। এই ভবনের পাশে ছিল ‘লালঘর’ নামে একটি কারাগার ভবন। এ দুটি ভবনের পাশে ছিল একটি পুকুর। ব্রিটিশ শাসকরা সেই পুকুরের পরিধি বড় করে সেটাকে দীঘিতে পরিণত করেন। পাহাড়ি টিলার ওপর ‘লালকুঠি’ এবং ‘লালঘর’। আর পাশের দীঘিটির নাম তাই স্বাভাবিকভাবে হয়ে গেল লালদীঘি। তার পাশের মাঠটিকেও ‘লালদীঘি ময়দান’ নামে চিনতে শুরু করল সবাই। তাছাড়া ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে প্রথম জনতার সামনে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।

চট্টগ্রাম নগরের ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দান এই বাংলার ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই ময়দান থেকেই গর্জে উঠেছে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি শাসনবিরোধী নানা আন্দোলন সংগ্রামের হাজারো প্রতিবাদী কণ্ঠের। বাংলাদেশ, ভারতসহ অত্র অঞ্চলের অগুনতি নেতৃত্বের পদচিহ্ন পড়েছে এই লালদীঘির ময়দানে। ইংল্যান্ডের লর্ডস স্টেডিয়ামকে ক্রিকেটারদের তীর্থস্থান মনে করে সেখানে খেলতে পারাটা যেমন প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন। তেমনি চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানও প্রতিটি রাজনীতিকের কাছে তীর্থস্থান। এই মাঠে বক্তব্য রাখতে পারা প্রত্যেক রাজনীতিকের কাছে গর্বের, গৌরবের। যে ময়দান চট্টগ্রামের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।

সম্প্রতি সিভয়েসের সাথে আলাপকালে প্রকল্পটির উদ্যোক্তা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সিভয়েসকে বলেছিলেন, ‘নতুন বছরের যে কোন সময় উন্মুক্ত করা হবে লালদীঘির ময়দান। তবে মাঠ ব্যবহারে মানতে হবে বেশ কিছু কঠিন শর্ত। মূলত প্রাধান্য পাবে মুসলিম স্কুলের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও মানুষের হাঁটাচলার বিষয়টি।

চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দান প্রতিটি রাজনীতিকের কাছে তীর্থস্থান। এই মাঠে বক্তব্য রাখতে পারা প্রত্যেক রাজনীতিকের কাছে গর্বের, গৌরবের। তাহলে সেই লালদীঘি ময়দানে কেন আর কোন জনসভা হবে না? এমন প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষা উপমন্ত্রী বললেন, ‘স্কুলের অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যাবে। বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে জনসভা করতে হলে সেখানে মানতে হবে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর।’

রক্ষাণাবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য নওফেল বলেন, ‘এটি যেহেতু মুসলিম স্কুলের মাঠ তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। রক্ষণাবেক্ষণসহ নিরাপত্তার বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষ দেখবে। মাঠে আনসার সদস্য নিয়োগ দেওয়া হবে।’

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here