প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার »

ভূমিকা : কোন ঐতিহাসিক ঘটনার মূলসুত্র ততক্ষণ পর্যন্ত বোধগম্য হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা তার সময়কালকে না নির্ধারণ করতে পারবো। যে কোন ঘটনা সময়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। প্রত্যেক চিন্তাবিদ, বীর, ইতিহাসের কুশীলবই সময়ের শ্রেষ্ট সন্তান। কেউ বীর হয়ে জন্মগ্রহণ করে না, লেখক হয়ে জন্ম নেয় না, সময়ই একজন ব্যক্তিকে বীর করে আর লেখক করে তোলে। সামাজিক, রাষ্ট্রিক পারিপার্শ্বিক অবস্থাই নির্ধারণ করে দেয় তার যোগ্য সন্তানদের দায়িত্ব। এমনই এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর আবির্ভাব ঘটে। সময়ই তাঁকে ডেকে নিয়ে এসেছে। তাঁকে ভাবিয়েছে তাঁর প্রিয় মাতৃভুমি আর মাতৃভাষার হালহকিকত সম্পর্কে। মাত্র পঁচিশবছর বয়স্ক টগবগে তরুণের মনোজগতে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তা-ই তাঁকে এ-জাতির ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছে। মাহবুব উল আলম চৌধুরী এখন শুধু একজন ব্যক্তি মানুষের নাম নয়, ইতিহাসের একজন নির্মাতা। এ-জাতির শ্রেষ্ট সন্তানদের একজন।
মানুষ যখন বিপদাপন্ন হয়, তখন তাঁর ভেতরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বিপদ মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। বৈরি সময়কে হটিয়ে আবার স্বাভাবিক সময়ে প্রবেশের জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে। ঠিক তেমনি ঐতিহাসিক এক মুহূর্তে বাংলাভাষা ও বাঙালি স্বত্বার আত্মপরিচয় বিনির্মাণের জন্যে বিপদ আঁচ করেও নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। দেশ এভাবেই সঙ্কটকালীন সময়ে তাঁর শ্রেষ্ট সন্তানদের হাতেই নিরাপদ হয়ে ওঠে। শত্রু মুক্ত হয়। আজকের বাংলাভাষা, বাংলাদেশ আর বাঙালি- ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন :
১৯২৭ সালের ৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাতা রওশন আরা বেগম আর পিতা আহমদুর রহমান। মাত্র চারবছর বয়সে পিতৃহারা হন তিনি। ১৯৪১ সালে রেঙুনে বাবা মারা যান। আর তাঁকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। তাঁর শৈশব জীবনে পিতৃমাতৃহীন হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত সফলভাবে নিজের জীবনকে গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে রাউজানের গহিরা হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাস করেন। এরপর ইন্টারমিডেয়েট পড়াকালীন সময়ে রাজনৈতিক কারণে তাঁকে চট্টগ্রাম কলেজ ত্যাগ করতে হয়। ছাত্রজীবন থেকেই মেধাবী ছিলেন এবং তাঁর ভেতর একধরনের বিপ্লবী চেতনাবোধ কাজ করতো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন একজন দুঃসাহসী প্রতিবাদী প্রাণ। ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনি বৈচিত্র্যময় একাশি বছরের জীবনকে যাপন করেছিলেন।
রচনাবলী :
মাহবুবুল আলম চৌধুরী সব্যসাচী লেখক ছিলেন। তাঁর রচনাবলীতে ইহলোকিক চিন্তাধারারই প্রতিফলন ঘটেছে। সমকালীন ঘটনাবলী বিভিন্নভাবে তাঁর লেখক মানসকে প্রভাবিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে একজন সমাজবীক্ষক তো তা-ই করেন। একজন সাধারণ নাগরিকের সাথে একজন লেখকের যে মূলপার্থক্য তা হলো- লেখক সমকালকে তার উপলব্ধি আর অনুভবের মাধ্যমে লেখনিতে ধারণ করে থাকেন। একজন সাধারণ নাগরিক যা পারে না। তাই লেখকরা অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম। মাহবুব উল আলম চৌধুরীর যে সমাজবীক্ষণ তাঁর রচনাবলীতে ফুটে উঠেছে তাতে দেখা যায় তিনি তাঁর সময়কালের একজন ব্যতিক্রম ব্যক্তিত্ব। সমাজ, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। তাঁর অবলোকন প্রক্রিয়াকে ‘ঈগল-আই-ইনভেস্টিগেশন’ বলা যায় নিঃসন্দেহে। তাঁর
উল্লেখযোগ্য রচনাবলীগুলো হলো:
কাব্যগ্রন্থ : আবেগধারা (১৯৪৪), ইস্পাত (১৯৪৫), অঙ্গীকার (১৯৪৬), কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি (১৯৮৮), সূর্যাস্তের অস্তরাগ (২০০৪), সূর্যের ভোর (২০০৬), গরাদভাঙার সংগ্রামীরা জাগো (২০০৭), অর্দশনা (২০০৮), এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে (২০০৮),
প্রবন্ধ সংকলন : সংস্কৃতি : জাতীয় মুখশ্রী (২০০৬), গণতান্ত্রিক ্স্ৈবরতন্ত্র, স্বৈরতান্ত্রিক গণতন্ত্র (২০০৬), আলোর সন্ধানে দেশ (২০০৮), সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি (২০০৮)।
আত্মজীবনী : স্মৃতির সন্ধানে (২০০৮)। ছড়ার বই : ছড়ায় ছড়ায় (২০০৪)।
নাটক : ভাঙন, ৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় লেখা- দারোগা (১৯৪৪), আগামীকাল (১৯৫৩)।
উপন্যাস : বিষের নেশা (১৯৪৬)
পুস্তিকা : বিপ্লব (বাজেয়াপ্ত) ১৯৪৬, কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি (বাজেয়াপ্ত) ১৯৫২, মিশরের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৫৬)।
সম্পাদনা : মাসিক সীমান্ত (১৯৪৭-১৯৫২), দৈনিক স্বাধীনতা (১৯৭২-১৯৮২)।
একুশের প্রেক্ষাপট : একটি কবিতার জন্ম ও মাহবুব উল আলম চৌধুরী
মাহবুব উল আলম চৌধুরী আকস্মিকভাবেই একুশের ঘটনার ভেতর জড়িয়ে পড়েননি।

দেশবিভাগ পরবর্তী সময়কাল থেকেই বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির যে অস্তিত্ব সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছিলো তারই ফল হচ্ছে একজন মাহবুব উল আলম চৌধুরী আবির্ভাব। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে স্ফূরণ তাঁর হৃদয়বন্দর মাতিয়ে রাখতো সেখানে ছিলো দেশ ও জাতির জন্যে ভালোবাসা। তাই যখনই ভাষার প্রশ্নে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তখনই তাঁর মুক্তিপিয়াসী মন দেশ ও ভাষার অস্তিত্বের টানে ছুটে এসেছে। সম্পৃক্ত করেছে নিজেকে ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাথে। আমরা জানি, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ববাংলা এক সঙ্কটের মধ্যে নিপতিত হয়েছিলো এবং ১৯৪৭-এর অব্যবহিত পর থেকেই তা স্পষ্টরূপ ধারণ করে আর ১৯৪৮ সালে তা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারপর থেকেই বাংলাভাষা আর বাঙালির ঐতিহ্যকে সুরক্ষা দানের লক্ষ্যে এ-ভূখন্ডের মানুষের মনে স্বদেশপ্রেম ষ্ফূরিত হতে থাকে। তারই চুড়ান্ত পরিণতি ভাষা আন্দোলন। তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী খেয়ালও করতে পারেনি যে ভাষার এ-সংগ্রাম দাবানলের মতো পূর্ববঙ্গের মানুষের হৃদয়ে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ ছড়িয়ে দিতে পারে।
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রগতিশীল ‘সীমান্ত’ পত্রিকা তাঁর সম্পদনায় প্রকাশ করেন। এবং এ-পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক ছিলেন সুচরিত চৌধুরী। এবং ১৯৪৮ সালে ‘সীমান্ত’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক বৈঠক প্রতিষ্ঠিত হয়। এ-সময়কালটাতে তাঁর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টায় বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং সংগঠনগুলো সংস্কৃতিপ্রেমিদের মনের ভেতর আলো দিতে থাকে। আর অন্যতম আলোকবর্তিকা ছিলো প্রগতিশীল, প্রতিবাদী আর গণমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠার পত্রিকা ‘সীমান্ত’।
‘উর্দু এবং শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ -শাসকগোষ্ঠীর এ ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি এদেশের মানুষের ভেতরের মানুষটিকে জাগ্রত করেছিলো। আপামর জনসাধারণও এতে সামিল হয়েছিলো প্রতিবাদী সূর্যতরুণদের সাথে। মাত্র পঁচিশ বছরের টগবগে তরুণ মাহবুব উল আলম চৌধুরীও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় তখন ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। পুলিশ গুলি বর্ষণ করছে। আর প্রতিরোধকারীদের বুকফাটা যন্ত্রণা আর ভাষা রক্ষার সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ক্ষোভের যেনো রক্ত বৃষ্টি হচ্ছিলো। মুহূর্তের মধ্যে এ-খবর চট্টগ্রামে পৌঁছে। এবং বিপ্লবের উৎসভূমি চট্টগ্রাম ফুঁসে ওঠে। সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য খোন্দকার মুহাম্মদ ইলিয়াস চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। মাত্র দুদিন আগেই তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সংঘটিত করার অভিপ্রায়ে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। এ-সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পূর্ব ঘোষণানুযায়ী পূর্ণাঙ্গ হরতাল পালিত হচ্ছিলো। মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক। তিনি তখন জলবসন্তে আক্রান্ত ছিলেন।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ঢাকায় গুলিবর্ষণে বাঙালি ভাষাসৈনিকদের শহীদ হওয়ার খবর পেয়ে অস্থির হয়ে ওঠেন। তাঁর মনের ভেতর প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বয়ে যায়। তাঁর প্রিয় সহচর ও সহযোগী ননী ধর সাথে ছিলেন। অসুস্থ কবি নিজেকে আর স্থির রাখতে পারেনি। তাঁর ভেতরের সত্তার আহ্বানে অস্থির হয়ে আছেন। তিনি মুখে মুখে বলতে লাগলেন আর ননী ধর লিখতে লাগলেন অমর কবিতাখানি। তখন সময় ছিলো রাত। আর তারপরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দানে প্রতিবাদ সভা। তখনই সিদ্ধান্ত হয় কবিতাটি সেখানে জনসম্মুখে পাঠ করা হবে এবং জনগণের মধ্যে তা বিতরণ করা হবে। কিন্তু মুশকিল হলো এতোরাতে এটা ছাপানো যায় কীভাবে।
চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় অবস্থিত কোহিনূর প্রেসের মালিক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের সাথে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর পূর্বপরিচয় ছিলো। সে সুবাদে সেখান থেকেই কবিতাটি ছাপানো হয়। চট্টগ্রাম তখন উত্তাল। চারিদিকে শুধু স্লোগান আর স্লোগান। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ‘খুনি শাহীর পতন চাই’। ‘মুসলিমলীগ নেতাদের ফাঁসি চাই’। ‘খুনি তোমার রক্ষা নাই, নুরুল আমিনের কল্লা চাই’- ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত জনপদ। বিকাল তিনটায় লালদিঘির মাঠ তখন জনারণ্য। চৌধুরী হারুন উর রশিদ আবেগাপ্লুত হৃদয়ে উদাত্ত কন্ঠে পাঠ করলেন-
কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি
ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে- রমনার রৌদ্রদগ্ধ
কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়
ভাষার জন্য, মাতৃভাষার জন্য- বাংলার জন্য।
………………………………………………….
হে আমার মৃত ভাইরা,
সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তোমাদের কন্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকারে
ভেসে আসবে
সেই দিন আমার দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে
প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে।
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর এ-কবিতাটিতে আবহমান বাঙলার প্রতিচিত্র রূপায়িত হয়েছে পরিপূর্ণভাবে। আবেগের সাথে ইতিহাসও ঐতিহ্যের যে অচ্ছেদ্যবন্ধন তিনি সুনিপূণভাবে গেঁথে দিয়েছেন, তাতে মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। একটি জাতির জন্ম হঠাৎ করেই হয়নি কোনোকালে। ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের গর্ভ থেকেই জন্ম নেয়- জাতি। ঠিক তেমনিভাবে বাংলা, বাঙালি আর যখন বাংলাদেশের কথা আসে, তখন অবধারিতভাবেই আমাদের ফিরে যেতে হয় সেই ইতিহাসের পাঠশালায়। যেখানে সূচিত আর নির্মিত হয়েছিলো এ-জাতির রূপরেখা।
স্বপ্ন কোনো দিন রক্তছাড়া পূরণ হয়নি। আমরা ইতিহাসের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর পূর্ণপাঠ করতে গেলে দেখি, রক্ত কীভাবে স্বপ্নের জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। স্বদেশের প্রকৃতি কীভাবে মুক্তির বারতা মনের ভেতর উস্কানি দেয়, তার উৎকৃষ্ট স্লোগান হচ্ছে এটি- ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে কেউ ভূলুন্ঠিত করতে পারেনি। স্বাধীনতা প্রিয় এ-জাতিকে দাবিয়ে রাখা পৃথিবীর কোনো জাতির পক্ষে সম্ভব নয়। পাকিস্তানীরা নয় শুধু, তাদের আগেও অনেকে এসেছিলো; কিন্তু টিকতে পারেনি। সে ইতিহাস আমরা জানি। যাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে, যাদের দুঃসাহসী অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হয়েছে, প্রাণের ভাষা হয়েছে, স্বপ্নের ভাষা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্যে বলি-
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শতমায়ের অশ্রুগড়া ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখনির অন্যতম উপকরণ স্বদেশ। দেশের প্রতি যে দায়বদ্ধতা, তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন পরিপূর্ণভাবে। তাই তিনি একাধারে সমাজকর্মী, সংস্কৃতিসেবক, রাজনীতির কুশীলব, সাংবাদিক, পত্রিকার সম্পাদক, গণমানুষের মুক্তির দিশারী হিসেবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন। মাতা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির প্রতি তাঁর অকৃত্রিম অনুভব তাঁকে আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবিতায় আন্তর্জাতিকতা রয়েছে। শোষিত মানুষের স্বপ্নের কথা রয়েছে। স্বদেশের দুঃসহ সময়ের কথা রয়েছে, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির বারতা রয়েছে। চিন্তাধারায় তাঁর মধ্যে নাজিম হিকমত আর পাবলো নেরুদার বিশেষ মিল রয়েছে। বিশেষ করে যখন মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতার শেষের লাইনগুলো পড়তে গেলে পাবলো নেরুদা আর নাজিম হিকমতের কবিতার কথা মনে পড়ে। নেরুদার ‘ঊাবৎু উধু ণড়ঁ চষধু্থ কবিতার এ-লাইনটির তীব্র প্রভাব মাহবুব উল আলম চৌধুরীর একুশের কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে।
একুশের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ :
একুশ আমাদের কাছে একটি আদর্শের নাম। আমাদের পবিত্র স্বাধীনতার বীজতলা ছিলো এই একুশ। কবি ময়ূখ চৌধুরী লিখেছেন ‘একুশের চাবি একাত্তরের দরজা’ । স্বাধীনতার যে মূল স্পিরিট সেটা একুশে ফেব্রুয়ারির অর্জন থেকে সূচিত হয়েছে। ‘কাঁদতে আসিনি- ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ কবিতাটির মধ্যে সে স্পিরিট ছিলো। এ-সম্পর্কে ‘প্রসঙ্গ : একুশের প্রথম কবিতা’ বইয়ে চৌধুরী জহুরুল হক বলেন, ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত এই কবিতাটিতে ভাষা-আন্দোলনে নিহত শহীদদের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অগ্নিক্ষরা বিদ্রোহী কন্ঠই শুধু উচ্চারিত হয় নি- যাকে বলি একুশের চেতনা, স্বাধীনতার চেতনা, তারও দীপ্র দলিল রচিত হয়েছে।’ [পৃ.১১]।
প্রকৃতপক্ষে ন্যায্য কোনো দাবীকেই দুনিয়ার কোনো জালেম সরকার কখনও দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মানুষের তীব্র আশা-আকাঙ্ক্ষার তোপের সম্মুখে দাঁড়াতে পারেনি রাষ্ট্রীয় পোশাকে সজ্জিত অস্ত্রধারী বাহিনী। সত্যি, স্বপ্নের মতো ভয়ানক অস্ত্র আর দুনিয়াতে কিছু নেই।
ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের অস্তিত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দুনিয়ার বুকে এমন কোনো বাঙালি নাই- যার বুকে এ-মাসের আগমন তাৎপর্যবাহী নয়। ১৯৫২ থেকে ৭১ এ-সুদীর্ঘকাল আমাদের প্রতিনিয়ত জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কাটাতে হয়েছে অধিকার আদায়ের জন্যে, দেশ-মাতৃকার মুক্তির জন্যে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে। একুশের এই চেতনার কারণেই আমরা সফল হয়েছি- একটি দেশ, একটি পতাকা আমরা পেয়েছি। আমরা আমাদের অস্তিত্বকে অর্থবহ করার জন্য যারা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে, আজ কৃতজ্ঞতাভরে তাঁদের স্মরণ করছি। আমি জানি এই রক্তের ঋণ কোনে দিন শোধ হবে না।
আজ বুকে তাজা রক্তের দাগ নিয়ে শহীদ মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্মৃতিসৌধ। এগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের ত্যাগের মহিমা কীর্তন করে। এগুলো স্রেফ কোনো ইটের গাঁথুনি নয়- আমাদের অর্জিত ইতিহাসের একেকটি খুঁটি। আপনারা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের স্মরণে তৈরি পবিত্র শহীদ মিনার। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের জন্য নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ। আমাদের স্মৃতিসৌধটি সাতজোড়া দেয়াল নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। দেয়ালগুলো পর্যায়ক্রমে ছোট থেকে বড় করে সাজানো হয়েছে। এই সাতজোড়া দেয়াল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাতটি ধারাবাহিক ঘটনার পর্যায়ক্রমকে উপস্থাপন করছে। এগুলো হল : ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।
আমাদের পবিত্র সংবিধানের অনুচ্ছেদ (৩)-এ বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। আমাদের প্রাণের ভাষাও বাংলা। এবং ভাষা আন্দোলনের মূল স্লোগানের একটি ছিলো, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু কর’। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আজও একুশের চেতনা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভাষা আন্দোলন হয়েছিলো আজ থেকে ৬৬ বছর আগে। ভাষা আন্দোলনের ১৯ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঘটে। ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই বাংলাদেশের অস্তিত্বের বীজ নিহিত ছিলো, যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে চুড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে। ভাষাতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের কাছে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ মার খেয়েছে- পৃথিবীর শুধু এ-ভূখণ্ডেই।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও আজ বাংলাদেশে বাংলা ভাষার করুণ দশা পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে তথা- উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রশাসন, আদালত আর বিচারিক কাজে বিদেশী ভাষারই আধিপত্য রয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা হচ্ছে শ্রেণিবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা। যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলাভাষা উপেক্ষিত হচ্ছে। দেশের আনাচে-কানাচে ইংরেজি শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় একশ্রেনি সেখানে তাদের সন্তান ভর্তি করাচ্ছে আবার বাকীরা বাংলা মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। ফলে সমাজের মধ্যে আবার একধরনের বিভক্তি তৈরি হচ্ছে। এতে করে নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যে মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে যে অবৈতনিক শিক্ষা কার্যক্রম হয়েছে তা আরো জোরালো ও যুগোপযোগী করে তুলতে হবে। অবশ্য অন্যান্য ভাষাকে উপেক্ষা না করে একুশের চেতনাকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে বাংলাভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে সম্মান দিতে হবে।
ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদের কাছে আমাদের একুশের চেতনাকে নত করা যাবে না। আগে আমাদের যা আছে তা সমৃদ্ধ করতে হবে। তারপর বাইরের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। বাধ্যতামূলকভাবে অফিস-আদালতের ভাষা বাংলা করতে হবে। যাতে সাধারণ মানুষও তার সুফল পেতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৌশলবিজ্ঞান ও কৃষি-প্রযুক্তির বইপুস্তক বাংলায় রচনা করতে হবে। এবং বিদেশী বই সমূহের অনুবাদের দায়িত্ব জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি গ্রহণ করতে পারে। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং এর সঙ্গে বাংলার কোনো বিরোধ নেই। যার যতো ইচ্ছা আর সম্ভব ভাষা শিখতে পারে। কিন্তু বাংলাকে অবজ্ঞা আর অবহেলা করে নয়। একুশের চেতনাই আমাদের আদর্শে ধারণ করতে হবে।
নিজের ভাষাচর্চা ব্যতীত কোনো জাতি উন্নতির সোপানে পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক প্রণীত শিক্ষানীতির যথার্থ বাস্তবায়ন করে জাতীয় ক্ষেত্রে সকলের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। আজকের বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখি, চীন, কোরিয়া, জার্মানি, রাশিয়া এবং স্ক্যান্ডেনেভিয়ান রাষ্ট্রসমূহ নিজভাষায় জ্ঞানচর্চা করে শিক্ষা এবং বিজ্ঞানে উৎকর্ষতা অর্জন করে আত্মনির্ভরশীল হয়েছে। আমরা যদি মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা করে শিক্ষাকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারি, তাহলে বাংলাদেশও পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। যে আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বুকে ধারণ করে, যে তিমিরদশা থেকে মুক্তির জন্যে ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধে এদেশের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছিলো, তা আমাদের কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হবে। তাদের আত্মত্যাগকে আমরা যদি অস্বীকার করি, তাহলে তা হবে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।
মাহবুব উল আলম চৌধুরী ও নতুন প্রজন্ম :
আমরা এখন চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ একটি অস্থির বিশ্বে বসবাস করছি। যেখানে আমাদের স্বপ্নগুলো যেমন পূরণ করছি তেমনি বিচিত্ররকমের দুঃস্বপ্নও আমাদের নিয়ত তাড়া করছে। এরমূলে রয়েছে- পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা ও স্বার্থপরতার রাজনীতি। তার সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্বায়নের বহুমুখী চ্যালেঞ্জ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের নিজেদেরকেই ভুলিয়ে দিচ্ছে। আমরা কাউকে আর মনে রাখতে পারছি না। কিন্তু এ-অবস্থা তো আমাদেরকে বিভ্রান্ত করছে। আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম নতুন প্রজন্মের মাথায় নেই। পরদেশী সংস্কৃতি চর্চার কারণে নিজেদের গুলোকে পর ভাবতে শুরু করেছে।
বিশ্বায়নের ফলে অগ্রগতির সাথে সাথে আমাদের দুর্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। কারণ- নব্য-উপনিবেশের সৃষ্টি এই বিশ্বায়ন থেকে। এর প্রভাব রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনকেও স্পর্শ করছে। আর এগুলোর পেছনে রয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। ‘এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত টেলিফোন (১৮৭৬), বাণিজ্যিক ট্রান্সআটলান্টিক বেতার যোগাযোগ (১৯০৫), পাবলিক সিনেমা (১৯০৬), টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ (১৯১৯/২০), রঙিন টেলিভিশন (১৯৪১), ট্রানজিস্টর (১৯৪৮), ইলেকট্রনিক মেইল (১৯৬৪), ফেইসবুক ইত্যকার তথ্যপ্রযুক্তি।
পুঁজিবাদ উদ্ভুত এই ধনবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে একপক্ষীয় বলা হতো না, যদি না এটি হতো একদেশদর্শী, ভারসাম্যহীন এবং কেবল সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অনুকূলে। সমগ্র পুঁজিকে কেন্দ্রীভুত করে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহ প্রাক্তন উপনিবেশের স্বাধীন মানুষকে কল্পনা করে তথাকথিত অশিক্ষিত, অসংস্কৃতিবান ও অনভিজাত ‘আদার (ড়ঃযবৎ) রূপে। বাণিজ্যিক উদারীকরণের নামে প্রতিষ্ঠা করে করে বাণিজ্যিক আগ্রাসন এবং গড়ে তুলতে চায় উন্মুল ও বৈচিত্র্যহীন বিশ্বসংস্কৃতি- যা মানুষকে তাঁর দেশীয় ভাষা ও সাংস্কৃতিক অবজ্ঞার প্ররোচনা দেয়। তাই এই বিশ্বায়ন মূলত খণ্ডিত, মানবিকতা বর্জিত বণিকবৃত্তির অবিচ্ছিন্ন অংশ; বিশ্বকে দ্রুত বৈচিত্র্যহীন ও সৃষ্টিশীলতা রহিত করার দ্রুততম প্রক্রিয়া এবং পশ্চিমা ধনবাদী আকাঙ্ক্ষার সাম্প্রতিক সংস্করণ।’
আমাদের শঙ্কিত হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে ভাষা-সাম্রাজ্যবাদ। পশ্চিমা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমাদের মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক সংস্কৃতি আমাদের নিজস্বতাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আজকের বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষমতাশালীদের ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। যা বিদ্যা, অর্থ ও প্রতিপত্তির দাম্ভিকতায় উর্ধ্বে। অপরকে আশ্রয় দিতে গিয়ে নিজেকে তো আর উদ্বাস্তুতে পরিণত করা যায় না।
বিশ্বখ্যাত ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশিত ভাষ্যানুযায়ী- পৃথিবীতে প্রচলিত ছ’হাজার ভাষার মধ্যে আগামী একশ বছরে অর্ধেক ভাষা অর্থাৎ ৩০০০ ভাষা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অর্থাৎ তাদের ভাষ্যানুযায়ী প্রতি দু’সপ্তাহে বিশ্বের কোথাও না কোথাও একটি ভাষার মৃত্যু অপমৃত্যু ঘটছে। এই অপমৃত্যুর যে সংখ্যা-তালিকা দাঁড় করিয়েছে তা হচ্ছে এরকম : “বিশ্বে এখন ৫১টি ভাষা আছে যার সর্বশেষ মাত্র একজন ব্যক্তি জীবিত আছে। এর আবার ২৮টিই অস্ট্রেলিয়ার। আর একশ জনের কম জানে এমন ভাষা আছে প্রায় ৫০০। একহাজারজন বলতে পারে এমন ভাষা আছে ১৫০০। দশহাজারের কমসংখ্যক মানুষ বলতে পারে এমন ভাষার সংখ্যা ৩,০০০। আর একলাখ লোকের ভাষা হিসেবে আছে ৫০০০।”
এতকথা বলার মূল কথা হল- আমাদের মায়ের ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। নিজের মায়ের ভাষাকে অবজ্ঞা করে- অপরের ভাষার ডুগডুগি বাজানোতে গৌরবের কোনো কিছু নাই। আপন ঘর সামলাতে হবে। আমাদের ঘরের সাজসজ্জাকরণ করবো কিন্তু নিজস্বতা পরিহার করে নয়।
সপ্তদশ শতকে ইউরোপে রেনেসাঁস তথা পুনর্জাগরণ হওয়ার ফলে মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ, দেশপ্রেম ও সৌন্দর্য ভাবনার মধ্যে দিয়ে দেশপ্রেম ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা পরিলক্ষিত হয়। ইউরোপ জেগে ওঠার বহু আগ থেকে আমরা জাগ্রত ছিলাম। আমাদের গৌরবগাঁথা প্রাচীন। কিন্তু আমরা পরধন লভে মত্ত হয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্রবোধ রক্ষা করতে পারিনি।
১৯৫২ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে মানুষটি মানুষের কথা ভেবেছেন, দেশের কথা ভেবেছেন, সমগ্র মানবজাতির কথা ভেবেছেন- তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি একটি দেশের শুধু স্বপ্নদ্রষ্টা নন, সত্যিকারের রূপকারও। বিশ্বের বুকে তিনি আমাদের নিজস্ব আইডেন্টিটি সৃষ্টি করেছেন। দেশ দিয়েছেন। পতাকার মালিক করেছেন আমাদের – তাই তিনি আমাদের জাতির পিতা। তাঁর স্বপনকে বুকে ধারণ করে এখন দেশ পরচিালনা করছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জঙ্গিবাদমুক্ত, ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে স্বপ্ন ও দৃঢ় অঙ্গীকার। মানুষ মানুষের জন্যে- জীবন জীবনের জন্যে- এ প্রত্যয় তাঁর বুকে সদাবিরাজমান। তাই গণহত্যার শিকার নিপীড়িত এবং স্বদেশ থেকে উৎখাত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি গড়ঃযবৎ ড়ভ ঐঁসধহরঃু উপাধি লাভ করেছেন বিশ্বের কাছ থেকে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাঁর ভাষা আান্দোলনে যোগদানের কথা তুলে ধরেছেন। ভাষা আন্দোলনে পিকেটিংয়ের সময় বঙ্গবন্ধুসহ অনেককে গ্রেফতার করে জেলেপুরে রাখা হয়। সে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘যে ওয়ার্ড়ে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চারনম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেওয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচ দিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট ছোট্ট মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হত না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই,’ ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই,’চলবে না’- নানা ধরণের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, “হক সাহেব ঐ দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।” হক সাহেব আমাকে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব।” [পৃ. ৯৪-৯৫]।
নতুন প্রজন্মকে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর অবদান জানাতে হবে। শিক্ষার স্তরগুলোতে পাঠ্য করতে হবে। এসব কীর্তিমান পুরুষদের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নামকরণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারগুলোর নাম এ-সব কীর্তিমানদের নামে করতে হবে। তাঁদের নিঃষ্বার্থ ত্যাগ-তিতিক্ষার মহিমা নতুন প্রজন্মের কাছে উজ্জ্বল ও ভাস্বর করে রাখতে হবে। প্রজন্মের ভেতর আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করতে হবে, পূর্বপুরুষদের ইতিহাসকে জানতে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি ছাত্রাবাস তৈরি করা জরুরি। এটি বলতে এখন লজ্জা লাগছে। কারণ অনেক দেরি হয়ে গেছে। একেবারে না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভালো। আমি আশাকরি, অচিরেই আমরা উদ্যোগ দেখতে পাবো- তাঁর নামে ছাত্রাবাস তৈরির ঘোষণার।
বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্তের ভাষায় বলি, ‘‘মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে বাংলাদেশ কতদিন মনে রাখবে বলা কঠিন। কৃতজ্ঞতা আমাদের স্বভাবজাত ধর্ম হয়ে ওঠেনি এখনো। তবে তরুণ তরুণীদের বলি, চারপাশে প্রাণহীনতা, ভোগবাদ আর উচ্চকিত সময়ে বিভ্রান্ত হওয়ার কালে এ জাতীয় বীরদের প্রতি ফিরে তাকাতে হবে। কারণ এদের হাতেই পুষ্ট হয়েছে ইতিহাস। দেশ পেয়েছে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি। এরাই প্রেরণা দেবেন সুখী ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গঠনে। এটা কথার কথা নয়, প্রগতির সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জীবনই খোলা বইয়ের মতো জাতির শক্তির উৎস হয়ে থাকবে। শোক নয় শিক্ষা ও জীবন গ্রহণেই তাঁকে সম্মান জানানো কর্তব্য।”
পরিশেষে, আমি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘সূর্যাস্তের অস্তরাগ’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা আপনাদের শোনাচ্ছি:
আমার মৃত্যুতে
আমার মৃত্যুতে
তোমরা কাঁদো
আর না-ই কাঁদো,
তারার অশ্রু
শ্রাবণ ধারায় সেদিন বৃষ্টি হয়ে পড়বে
বৃষ্টি হয়ে ঝরবে।
আর তোমরা ভাববে,
মৃত্যুর কাছে
মানুষ কত অসহায়।
মৃত্যুকে আমি অতিক্রম করেছি।
আমার মৃত্যুতে
কৌতুহলী লোকজনেরা
ভীড় করে আসবে,
বেশী করে আসবে তারা,
যাদের বিরুদ্ধে আমি
চিরকাল লড়াই করেছি।
তারা দেখতে আসবে,
আসলে আমি মারা গেছি,
না আরেকটা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
অন্ধকারের প্রেতাত্মারাও আসবে
আমাকে স্বর্গের সনদ দিতে,
যেন ভবিষ্যত প্রজন্ম আমার কবিতাকে
তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না পারে।
তোমরা বিভ্রান্ত হয়ো না।
আমার মৃত্যুতে তোমরা কাঁদো আর না-ই কাঁদো
আকাশ কাঁদবে,
তারার অশ্রু বৃষ্টি হয়ে ঝরবে।
আপনারা আমাকে এখানে আমন্ত্রণ জানিয়ে যে সম্মান প্রদান করেছেন- সত্যি আমি এর জন্য অভিভূত, কৃতজ্ঞও। আপনাদের আমন্ত্রণের কারণেই আমি আজকে আমার ভাবনাগুলো তুলে ধরতে পারছি।
লেখক: উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।সূত্র : দৈনিক আজাদী