আবো. অনলাইন

বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি আমরা জ্ঞান সৃষ্টির আধার হিসেবে গণ্য করি, সেখানে উপযুক্ত গবেষণা থাকতেই হবে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষার নীতিনির্ধারক ও উদ্যোক্তারা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যতটা আগ্রহী, গবেষণার বিষয়ে ততটাই অনাগ্রহী।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বরাতে প্রথম আলোর খবরে জানা যায়, শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫ শতাংশ ২০২২ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও বরাদ্দ রাখেনি। আবার কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এত কম বরাদ্দ রেখেছে, তা দিয়ে কোনো মানসম্পন্ন গবেষণা সম্ভব নয়।

এর আগের বছরের প্রতিবেদনে ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য শূন্য বরাদ্দ ছিল। এর অর্থ, ওই সব বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা যে উচ্চশিক্ষার অপরিহার্য অংশ, সেটাই অগ্রাহ্য করেছে। এ ক্ষেত্রে বরাদ্দের অপ্রতুলতাকে দায়ী করা হয়। বর্তমানে অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয় ১৬৯টি; এর মধ্যে ৫৫টি সরকারি ও ১১৪টি বেসরকারি। অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৭ লাখ ৫৬ হাজার ৭৪৭।

ইউনেসকোর পরামর্শ অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে ১.৭৬ শতাংশ ব্যয় করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দের হার সবচেয়ে কম। আবার যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকে, তারও সিংহভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষক-কর্মীদের বেতন-ভাতায়। গবেষণায় বরাদ্দ থাকেই না বললেই চলে।

বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানক্রমে বাংলাদেশ যে ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে, তারও অন্যতম কারণ যে গবেষণায় দুর্বলতা ও অপ্রতুলতা, তা–ও আমাদের শিক্ষার অভিভাবকেরা বুঝতে চান না। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার বরাদ্দের ২ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের নামকরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ও ১ শতাংশের কম ব্যয় করে থাকে। তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে প্রথম সারির কয়েকটি পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় অধিক মনোযোগী হয়েছে এবং বরাদ্দও বাড়িয়েছে।

ইউজিসির প্রতিবেদনে যে ১৫ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় শূন্য বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম টিকিয়ে রাখা হয়েছে ঢিমেতালে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় করোনার দোহাই দিয়েছে। কিন্তু করোনার আগেও সেখানে গবেষণার চিত্র খুব উজ্জ্বল ছিল বলা যাবে না। গবেষণা করতে অভিজ্ঞ স্থায়ী শিক্ষক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ চলছে নবীন ও খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে। এ অবস্থায় উন্নত মানের গবেষণা আশা করা যায় না।

গত কয়েক বছর বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে উপযুক্তসংখ্যক মানসম্পন্ন গবেষণা না হওয়া নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ইউজিসিও গবেষণাকাজে নানা রকম উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারপরও গবেষণা না হওয়ার কারণ ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা শিক্ষার চেয়ে মুনাফা ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তিকেই বড় করে দেখছেন।

ইউজিসির প্রতিবেদনে গবেষণা বাড়াতে মানসম্মত প্রকাশনায় শিক্ষকদের উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দেওয়াসহ তরুণ গবেষকদের জন্য বিশেষ পুরস্কার, পিএইচডি বৃত্তির আর্থিক পরিমাণ বাড়ানোসহ উচ্চশিক্ষার জন্য ১৪টি সুপারিশ করেছে। কিন্তু সুপারিশ করাই যথেষ্ট নয়। এগুলো পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাস্তবায়ন করছে কি না, সেটাও তাদের দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুধু পাঠদান ও পরীক্ষার মধ্যে সীমিত থাকতে পারে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞান সৃজনের প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে হবে, যেখানে দেশের পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থীরাও আসতে উৎসাহিত হবেন।

যেসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত গবেষণাকে অগ্রাহ্য করে আসছে কিংবা কোনো বরাদ্দ রাখছে না, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় ইউজিসির সুপারিশ বা পরামর্শ কোনো কাজে আসবে না।

প্রথম আলোর সৌজন্যে

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here