– হামিদুল হক
যারা পরীক্ষায় খারাপ বা ফেল করেছ, মনে করোনা তোমাদের স্বপ্ন এখানেই শেষ!
আমার স্কুল জীবনের সহপাঠী ইউছুপ, ক্লাশের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র ছিল । তবে – যত বাহ্যিক কাজ, খেলাধুলা, অনুষ্ঠানন, দলগত নেতৃত্ব ছাড়াও যত দুষ্টুমি ১ নম্বরে ওর নাম। পড়ালেখা বাদে অন্যসব বিষয়ে ওর মেধা ছিল প্রখর।
একদিন পড়া মুখস্থ দিতে না পারায় শিক্ষকের বেদম মার খেয়ে স্কুল পালাল। ১০ বছর পর আমি ইন্জিনিয়ার হয়ে বের হলাম। দুই বছর দেশে চাকুরী করে মধ্যপ্রাচ্যে দেশে পাড়ি জমালাম।
কাতার গিয়ে আর এক সহপাঠীর মাধ্যমে জানলাম ও সেখানে। ফোন নং পেয়ে ফোন করে পরিচয় দিলাম, সে আমার ঠিকানা জিজ্ঞেস করে একটু বলল-একটু পর আসছি।
আমার চাকুরি তেমন বেশি ভাল ছিলনা। নতুন চাকরি, কোম্পানির দেওয়া একটি রুমে ৮ জন। ঘেঁষাঘেঁষি করা লোহার খাটে সন্ধ্যায় চিত হয়ে শুয়ে কল্পনা আর বাস্তবতার মধ্যে কত ফারাক তার হিসাব নিকাশ করছি আর ইউছুপের জন্য অপেক্ষা করছি।
কিছুক্ষণ পর বাইরে একটা গাড়ির হর্ণ শুনলাম সাথে আমার মোবাইল টাও বেজে উঠল। আমি একটা শার্ট আর পেন্ট পড়ে বাইরে গিয়ে দেখলাম – একটা চমৎকার পাজেরো গাড়ির সামনে এরাবীয়ান যুব্বা আর মাথায় চাকতি পরিহিত লম্বা, সুদর্শন এক লোক হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি ভাবলাম আমাদের কোম্পানির মালিক পক্ষের কোন আরবি শেখ টেখ হবে। কাছে গিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম।
এক পর্যায়ে উনি বললেন- ” কাইফা হালে, ইয়া আযনাবী”। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। সে দেশে যাওয়ার আগে বাংলা- আরবী স্পীকিং একটা চটি বই পড়েছিলাম। সে সুবাদে ঐ কথার অর্থটা মোটামুটি বুঝতে পারলাম( অর্থাৎ, কেমন আছেন হে বিদেশি) । তারপর হঠাৎ ” হায়রে দোস্ত হামিদ, কেমন আছিস, কখন আসলি এদেশে” বলে আমাকে জড়িয় ধরে রাখল কিছুক্ষণ। বলল “উঠ, গাড়িতে উঠ “।
আমার তখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল এই ইউছুপ, সেই ইউছুপ।
“মানতাকাছানিয়া” লোকালিটি থেকে বের হয়ে সন্ধ্যার আলোকোজ্জ্বল কাতারের রাজপথ ধরে নতুন পাজেরো গাড়ি ১২০ কিমি. বেগে সা-সা করে চালাচ্ছিল সে।
ওকে কতবার স্কুলের গনিতের হোমওয়ার্ক করে দিয়েছি, ইংরেজীর নিধু স্যারের মাইরের হাত থেকে বাচানোর জন্যে মুখে মুখে কতবার tense এর rules মুখস্থ করেছি। ওর মাথায় এগুলি ঢুকতনা, বলতাম-বেটা তোর মাথায় সব গোবর । ও হোহো করে হাসত।
মার খেয়ে স্কুল থেকে পালানোর পর এ পর্যন্ত তার খবর জানতাম না। আমি স্কুল – কলেজে মোটামুটি ভাল ছাত্র ছিলাম। ভাল রেজাল্ট করে নিজেকে একজন ইন্জিনিয়ার হিসেবে সমাজে পরিচিত করলাম।
মাঝে মাঝে ইউছুপের কথা মনে হত। ভাবতাম, স্কুল জীবনে অকৃতকার্য একজন ছাত্রের জীবন বোধ হয়, নষ্ট হয়ে গেল।
হঠাৎ গাড়ি ব্রেক করল, নামলাম। একটা প্রাসাদময় ভবনে লিফটে চড়ে উপরে উঠলাম। বাসায় প্রবেশ করে আরো চমকে গেলাম। একটা বিশাল আকারের ড্রইং রুম। থাক, এসবের বর্ণনা আর না দিই।
ও সেখানে ২ বছর কনস্ট্রাকশন ফার্মে কাজের সীমাহীন কষ্ট আর পরিশ্রমের কথা বর্ণনা করল।
৪০ ডিগ্রী সেঃ গ্রেঃ তাপমাত্রায় হাই রাইজ বিল্ডিংয়ের স্ট্রাকচার রড বেন্ডিং, বালি- সিমেন্ট মিক্সার দিয়ে ইট গাঁথুনির মত পরিশ্রমের কাজ দক্ষতার সাথে রপ্ত করে সে। এরপর চাকুরী ছেড়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে কনস্ট্রাকশন কাজের ঠিকাদারি শুরু করে। পূথিগত বিদ্যা বেশি না থাকলেও পরিশ্রম, ধৈর্য আর নেতৃত্বের গুণাবলি দিয়ে সেখানে ধীরে ধীরে সে বিশাল কনস্ট্রাকশন ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে। যেখানে আমার চেয়ও বড়বড় ৭/৮ জন প্রকৌশলী তার ফার্মে কাজ করে। তথাপি আমি পেশায় ইন্জিনিয়ার শুনে সে আমাকে যথেষ্ট সম্মান ও মূল্যায়ন করল।
আমার এ লিখাটা কোন বানানো গল্প বা কাহিনি নয়। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্বৃত।
আজ এস, এস, সি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে।
আমাদের কঁচি মনা ছাত্র-ছাত্রীরা যারা পরীক্ষায় খারাপ করবে, আমি এখানে তাদের কোন দোষারোপ করবোনা।
সম্মানিত অভিবাবকদের নিকট একটা মেসেজ থ্রো করাই এ লিখার উদ্দেশ্য। বলব —
আসুন। আমাদের সন্তানদের রেজাল্ট খারাপ বা আশানুরূপ জিপিএ না পাওয়ার জন্য বকাঝকা না করে তাদের ভিতরের অন্য প্রতিভা অন্বেষণ করার চেষ্টা করি। এদের বিএ, এম,এ পাশ করিয়ে কেরানী বানিয়ে অদক্ষ, অনুৎপাদনশীল বোঝায় পরিণত না করে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ করে উৎপাদনশীল কর্মী হিসাবে গড়ে উঠতে সহায়তা করি।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সমাজ ও দেশ গঠনে কারিগরী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। পুঁথিগত বিদ্যায় অনগ্রসরেরা আসলে মেধাহীন নয়। এদের প্রতিভা অন্যভাবে নিহিত আছে। সে সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত করতে এদের সহায়তা করতে হবে। এবারের এস, এস, সি তে কৃতকার্য – অকৃতকার্য সকল ছাত্র-ছাত্রী দের প্রতি রইল অভিনন্দন।
সকলের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম।
– হামিদুল হক, অধ্যক্ষ, বাঁশখালি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট।