মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন :

কৃষকের লাভ লুটে খাচ্ছে খাদ্য কর্মকর্তারা


কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনায় অনিয়ম রোধে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তারপরও কৃষক হয়রানি ও অনিয়ম থামানো যাচ্ছে না। খাদ্য ও গুদাম কর্মকর্তাদের ‘বশ’ করতে না পারলে হয়রানি করার অভিযোগ কৃষকদের। ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।


প্রতিটন ধান বিক্রিতে দিতে হয় ৪/৫ হাজার টাকা


বাঁশখালী উপজেলার ৭নং ওয়ার্ডের কৃষক সৈয়দ আহমদ (৭০) বলেন, প্রতি কানি জমিতে ধান চাষে খরচ হয় প্রায় ১১ হাজার টাকার বেশি। ধান হয়েছে গড়ে ৫৫ আড়ি। প্রতিকেজিতে খরচ পড়েছে প্রায় ২০ টাকা। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ২৬ টাকা দরে ধান কিনছে। আর ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করলে পাওয়া যাচ্ছে ১৫-১৬ টাকা। ধানের উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে কৃষকদের উৎসাহিত করতে ধান কিনে সরকার। এতে কিছুটা লাভ পায় কৃষক। কিন্তু সেই ধান খাদ্য গুদামে বিক্রি করতে পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তি পোহাতে হয়। প্রতিটন ধান বিক্রিতে খাদ্য ও গুদাম কর্মকর্তাদের ৪-৫ হাজার টাকা দিতে হয়। তিনি দাবি করেন, খাদ্য ও গুদাম কর্মকর্তাদের টাকা না দিলে ধান ফেরত দেয়। টাকা দিলেই ধান ঠিক থাকে। না হলে ধান চিটা হয়েছে বলে হয়রানি করা হয়।


সরকার কিনছে ২৬ টাকায়, ফড়িয়ারা ১৫ থেকে ১৬ টাকায়


একই অভিযোগ বোয়ালখালী, ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট এলাকার কয়েকজন কৃষকের। ফটিকছড়ি এলাকার কৃষক ধনু মিয়া, আবুল কালাম বলেন, গত বোরো মৌসুমে কৃষক বেশি হয়রানির শিকার হয়েছে। দালাল ছাড়া খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করতে হিমশিম খেতে হয়েছে কৃষকদের। অনেক কৃষক হয়রানির কারণে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারেনি। এবার আমন মৌসুমেও একইভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। প্রতিটনে ৪-৬ হাজার টাকা দাবি করছে। টাকা না দিলে কৃষকদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। বিশেষ করে ধান চিটা রয়েছে বলে ফেরত দিচ্ছে খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা। দালালের মাধ্যমে টাকা দিলে ওই ধান গ্রহণ করা হচ্ছে।

কৃষকদের অভিযোগ, হয়রানির কারণে সরকারের কাছে ন্যায্যমূল্যে ধান বিক্রি করতে না পেরে ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ ধার-দেনা ও দাদন নিয়ে চাষাবাদ করেছেন অনেক কৃষক। ধান বিক্রি করতে না পারলে দাদনের সুদ ও ঋণের পরিমাণ দিনে দিনে বাড়ে। তবে অবস্থাসম্পন্ন কৃষকেরা ধান বিক্রি করতে না পেরে গোলায় রেখে দিতে বাধ্য হয়।

এদিকে, বাঁশখালী উপজেলার কৃষকেরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করে এখন বিপাকে। বছর শেষের হিসাব-নিকাশের কারণে কৃষকদের টাকা ছাড় দিচ্ছে না ব্যাংক।

বাঁশখালীর পুকুরিয়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের কৃষক ছাবের আহমদ বলেন, ‘এক সময় ১৬-১৮ কানি জমিতে ধান চাষ করতাম। এখন ধান চাষে খরচ বেড়ে গেছে। পোষাতে পারি না। তাই পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য মাত্র ৬ কানি জমিতে ধান চাষ করি। আরও ১২-১৪ কানি জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। প্রতিকানিতে ৯ হাজার ৭শ টাকা খরচ হয়ে বলে জানান তিনি। লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ায় ধান চাষ কমিয়ে ফেলেছেন তিনি।

চট্টগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি আমন মৌসুমে চট্টগ্রাম থেকে ১৮ হাজার ৪৯৮ মে. টন ধান কিনবে সরকার। কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা দরে কিনবে।

চট্টগ্রামে এবার ১৮ হাজার ৪৯৮ মে. টন ধান ক্রয় করা হবে। তম্মধ্যে সন্দ্বীপ উপজেলা থেকে দুই হাজার ৪৩৭ মে. টন। মিরসরাই উপজেলা থেকে দুই হাজার ৮৯ মে. টন। সীতাকুণ্ড উপজেলা থেকে ৬১১ মে. টন। ফটিকছড়ি উপজেলা থেকে দুই হাজার ২২৭ মে. টন। হাটহাজারী উপজেলা থেকে ৯৫৮ মে. টন। রাউজান উপজেলা থেকে এক হাজার ১৭০ মে. টন। রাঙ্গুনীয়া উপজেলা থেকে এক হাজার ৫৪৫ মে. টন। বোয়ালখালী উপজেলা থেকে ৪৫৭ মে. টন। পটিয়া উপজেলা থেকে এক হাজার মে. টন। চন্দনাইশ উপজেলা থেকে ৮৩৪ মে. টন। লোহাগাড়া উপজেলা থেকে এক হাজার ১০৩ মে. টন। আনোয়ারা উপজেলা থেকে ৭০৬ মে. টন। বাঁশখালী উপজেলা থেকে এক হাজার ৫১৯ মে. টন। কর্ণফুলী উপজেলা থেকে ৩৬১ মে. টন। নগরীর পাঁচলাইশ থানা থেকে ১১২ মে. টন। ডবলমুরিং থানা ৪২ মে. টন। পতেঙ্গা থানা থেকে ৭৩ মে. টন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক খাদ্য কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রান্তিক কৃষক ও কৃষি বিভাগের পাঠানো তালিকা ধরে ধান কিনছে উপজেলা ক্রয় কমিটি। কৃষি বিভাগের দেওয়া তালিকা থেকে লটারির মাধ্যমে ধান ক্রয় করা হচ্ছে। চিটা’র বিষয়ে বলেন, সরকারের সংগ্রহ করা ধান দীর্ঘদিন গুদামে রাখতে হয়। তাই চিটামুক্ত শুকনো ধান ক্রম করতে হয়। যাতে গুণগতমান বজায় থাকে। কারণ পররতীতে এসব ধান মিলিং করে চাল করা হবে।

বোরো ধান-চাল নীতিমালায় রয়েছে, ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির সভাপতি হচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য সচিব হচ্ছেন খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা।

সূত্র জানায়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের পাশ কাটিয়ে দালাল ও ফড়িয়াদের মাধ্যমে ধান কেনা হচ্ছে। এতে ন্যায্যদাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক।
কৃষকদের দাবি, কৃষক বাঁচাতে হলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা আরও দুই-তিন গুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। অন্যথায় কৃষক চাষাবাদে নিরুৎসাহিত হবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here