প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া পিএইচএফ
বিশ্ব বৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত। এই ত্রি-স্মৃতি কি কি?
প্রথম স্মৃতি:
বৃহত্তর ভারতের (তৎকালীন নাম জম্বুদ্বীপ) উত্তর প্রদেশের সীমানা সংলগ্ন নেপালের লুম্বিনী কাননে মহামায়ার পিত্রালয়ে সপারিষদ যাবার পথে শাক্যকুল বংশীয় রাজা শুদ্ধোদনের ঔরসে রানী মহামায়ার গর্ভ থেকে খৃস্টপূর্ব ৬২৩ অব্দে (এখন থেকে ২৬৪৪ বৎসর পূর্বে) শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে শালবৃক্ষের ছায়াতলে বোধিসত্ত্ব সিদ্ধার্থ গৌতম জন্ম গ্রহণ করেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। একই বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে যশোধরা (সিদ্ধার্থের ভবিষ্যৎ সহধর্মিনী), আনন্দ (বুদ্ধের ভাবি একান্ত শিষ্য), ছন্ন সারথি (ঘোড় সাওয়ার), কন্থক অশ্ব (যে ঘোড়ায় চরে সিদ্ধার্থ গৌতম মহাভিনিষ্ক্রমন বা গৃহত্যাগ করেছিলেন), নিধিকুন্ড (চারি মহাধনভান্ডার), মহাবোধির অংকুর (যেই বৃক্ষের নিচে বসে বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলন) ও কালুদায়ি অমাত্য (মন্ত্রী যিনি সিদ্ধার্থ গৌতমের বন্ধু ছিলেন) জন্ম নিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় স্মৃতি:
ভারতের (তৎকালীন জম্বুদ্বীপ) বিহার প্রদেশের গয়া জেলার বুদ্ধগয়ার নৈরঞ্জনা নদীর তীরে উরুবিল্ব বনে বোধিদ্রুম মূলে (অন্য নাম অশ্বত্থ বৃক্ষ) ছয় বৎসর বিভিন্ন স্থানে কঠোর সাধনার পর খৃস্টপূর্ব ৫৮৮ অব্দে (এখন থেকে ২৬০৯ বৎসর পূর্বে), শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বোধিসত্ত্ব সিদ্ধার্থ গৌতম ‘সম্যক সম্বুদ্ধ’ হন (Perfectly self-Enlightened One or Awakened one)। (ত্রিপিটক শাস্ত্র মতে চারি অসংখ্য জন্ম জন্মান্তর পরিগ্রহ করে ৫৫০ বার বোধিসত্ত্ব হিসেবে জন্ম গ্রহণের পর শেষ জন্মে ছয় বৎসর কঠোর কৃচ্ছ তপস্যার পর বুদ্ধগয়ার বোধিদ্রুম মূলে কঠোর সংকল্পে ব্রতী হয়ে ‘সম্যক সম্বুদ্ধ’ হন)। এই বোধিদ্রুম মূলেই তিনি চারি আর্যসত্য বা Four Noble Truths (দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধের উপায় বা মধ্যম পথ) আবিষ্কার করেন। As such The Buddha is a great scientist। গৌতম সম্যক সম্বুদ্ধকেই সংক্ষেপে আমরা গৌতম বুদ্ধ বলে অভিহিত করে থাকি। (বৌদ্ধ শাস্ত্র, মতে গৌতম বুদ্ধ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বোধিদ্রুম সোউপাদিশেষ নির্বাণ প্রাপ্ত হন) দিনটি ছিল বুধবার। বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে এর আগে আরো ২৭জন সম্যক সম্বুদ্ধ জন্ম নিয়েছিলেন। গৌতম বুদ্ধ হলেন ২৮তম সম্যক সম্বুদ্ধ।
তৃতীয় স্মৃতি:
সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বৎসর তাঁর আবিষ্কৃত ধর্ম ও দর্শন প্রচারের পর ৮০ বৎসর বয়সকালে ভারতের (তৎকালীন জম্বুদ্বীপ) উত্তর প্রদেশের মল্লদের শালবনে (মাঘী পূর্ণিমায় পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী) খৃস্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে (এখন থেকে ২৫৬৪ বৎসর পূর্বে) শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে হাজার হাজার শিষ্য প্রশিষ্যদের শোকময় উপস্থিতিতে গৌতম সম্যক সম্বুদ্ধ (গৌতম বুদ্ধ) মহাপরিনির্বাপিত হন। সাধারণ মানুষের বেলায় ‘মৃত্যু’ কিন্তু গৌতম বুদ্ধের বেলায় এই প্রয়াণকে বলা হয় মহাপরিনির্বাণ বা ইংরেজীতে Great Grand Passing Away। মৃত্যু আর মহাপরিনির্বাণে বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে অনেক পার্থক্য আছে। বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে গৌতম বুদ্ধ মল্লদের শালবনে নিরুপাদিশেষ নির্বাণ প্রাপ্ত হন। দিনটি ছিল মঙ্গলবার।
গৌতম বুদ্ধের এই ঘটনাগুলো যথা জন্ম (শালবনে), বুদ্ধ হওয়া (উরুবিল্ব বনে) ও মহাপরিনির্বাণ (শালবনে) প্রকৃতির সাথে পরিপূর্ণভাবে সংমিশ্রিত এবং বর্তমান সময়ে মানবজাতির কাছে স্মৃতিময় বলে আমরা বুদ্ধ পূর্ণিমাকে ত্রি-স্মৃতি বিজড়িত বলে অভিহিত করে থাকি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গৌতম বুদ্ধকে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব বলে অভিহিত করেছিলেন।
শ্রীলংকায় এই দিবসটিকে ‘বেশাখ দিবস বা ইংরেজিতে VESAK DAYÕ হিসেবে পালন করে। বিভিন্ন বৌদ্ধ দেশে বুদ্ধ পূর্ণিমার বিভিন্ন নাম আছে। এই দিবসকে আন্তর্জাতিক বেশাখ দিবস বা International Day of Vesak হিসেবে ঘোষণা করার পেছনের ইতিহাসটি নিম্নরূপ।
১৯৫০ সালে ২৫ শে মে তারিখে বিশ্ব বৌদ্ধ সৌভ্রাতৃত্ব সংঘ (The World Fellowship of Buddhists ev The WFB) বিশ্ব বৌদ্ধ প-িত প্রফেসর ড. গুণপাল মালালা শেখরের নেতৃত্বে গঠিত হয়। ২৭টি দেশের ১২৭ জন নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে বিশ্ব বৌদ্ধদের এই সংস্থা গঠনের সময় বাঙালী বৌদ্ধদের মহান নেতা বিশ্ব বরেণ্য বৌদ্ধ মনীষা বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মহামান্য মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর নেতৃত্বে বাংলাদেশ থেকে সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি এডভোকেট ঊমেশ চন্দ্র মুৎসুদ্দি ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মহাসদ্ধর্মগ্রাম আবুরখীলের বরেণ্য কৃতি সন্তান ভদন্ত বঙ্গীশ ভিক্ষু বিএ. বিএড (পরে শশাংক মোহন বড়ুয়া) যোগদান করেন। ঐ সংস্থা গঠনের সময় সাধারণ অধিবেশনে শ্রীলংকার একজন বৌদ্ধ পন্ডিত, কলম্বোস্থ বিদ্যোদয়া পিরিবেনের অধ্যক্ষ ভিক্ষু ভদন্ত বাড্ডেগামা পিয়রতœ নায়ক মহাথেরো বেশাখ দিবসকে বিশ্ব উৎসব (Global Celebration) হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন। গ্লোবাল বৌদ্ধ Fraternity হিসেবে ঐ প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কিন্তু এর বাস্তবায়ন দ্রুত সম্ভব হয়নি। ১৯৯৮ সালে শ্রীলংকার পার্লামেন্টে বেশাখ দিবস বা বুদ্ধপূর্ণিমাকে আন্তর্জাতিকীকরণের লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব পাশ হয় এবং সেই প্রস্তাবটি জাতিসংঘে উত্থাপন করার জন্য শ্রীলংকার তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী যিনি ছিলেন খৃস্টান তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ের নাম ছিল মি: লক্ষ্মন কাদিরগামার। মি: কাদিরগামার হচ্ছেন শ্রীলংকার তামিল জন্মজাত সন্তান। তিনি ১৯৯৯ সালের ২৩ শে সেপ্টেম্বর জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনে বেশাখ দিবসকে ‘জাতিসংঘ বেশাখ দিবস’ (United Nations Day of Vesak) হিসেবে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং বাংলাদেশ সহ ৩৪টি দেশ এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। জাতিসংঘের ৭৪তম সেশনে ৫৪/১১৫নং প্রস্তাবে বেশাখ দিবসকে আন্তর্জাতিকবাবে পালনের স্বীকৃতি দেয়া হয়। প্রস্তাবে বলা হয় Ò The UN General Assembly recognized Vesak Day as an international observance on 15 December 1999 aiming to honor the Buddhist values of wisdom, compassion and tolerance as a mean to foster world peaceÓ অর্থাৎ বিশ্বশান্তি অর্জনের উপায় হিসেবে জাতিসংঘ বুদ্ধের প্রজ্ঞা, করুণা ও সহনশীলতার মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দিয়ে বেশাখ দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে পালন করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে সমগ্র মানবজাতি বুদ্ধের প্রজ্ঞা করুণা ও সহনশীলতার সংস্কৃতি সুদীর্ঘ আড়াই হাজার বছরের অধিককাল ধরে নিজস্ব কল্যাণে বহন করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও তাই করে যাবে। উল্লেখ্য যে, গৌতম বুদ্ধ কোন গোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে তাঁর ধর্ম-দর্শন প্রচার করেননি। তিনি মানবজাতির কল্যাণের জন্যই তাঁর ধর্ম-দর্শন প্রচার করেছেন। তাই তাঁকে দেব-মনুষ্যের শিক্ষক বলা হয়। শিক্ষক হিসেবে তাঁর উপদেশ মেনে চললে বিশ্বে অবশ্যই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
জাতিসংঘ কর্তৃক বেশাখ দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক বেশাখ দিবস’ ঘোষণার পরের বছর ২০০০ সালের ১৫ই মে জাতিসংঘ হেড কোয়ার্টার ও UNESCO সহ বিভিন্ন দেশের UN অফিসে এই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয়। ২০০১, ২০০২, ২০০৩ সালে একইভাবে এবং অন্যান্য UN অফিসে দিবসটি উদ্যাপিত হয়। ২০০৪ সালে থাইল্যান্ডকে দায়িত্ব দেয়া হয় এই উৎসব উদ্যাপনের জন্য। থাই সরকার মহাচুলালংকরণ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দায়িত্ব অর্পণ করেন। MCU কর্তৃপক্ষ UN ও থাই সরকারের সহযোগিতায় বেশাখ দিবস পালনের জন্য UN এর উদ্যোগে প্রথম আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ সম্মেলনের আয়োজন করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৬ (ছয়) শত প্রতিনিধি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। ২০০৪ সালের ২৫ শে মে এই সম্মেলন থাইল্যান্ডের বুদ্ধমন্থনে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ থেকে শুধু আমি ও আমার সহধর্মিনী প্রফেসর প্রীতিকণা বড়ুয়া এই সম্মেলনে যোগদান করার জন্য আমন্ত্রিত হবার সৌভাগ্য অর্জন করি। ২০০৪ সাল ২০২১ সাল পর্যন্ত থাইল্যান্ডে ১২ (বার) বার, ভিয়েতনামে ৩ (তিন) বার, শ্রীলংকায় ১ (এক) বার এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২০, ২০২১ সালে করোনা মহামারী প্রাদুর্ভাবের কারণে এই সম্মেলন বা আন্তর্জাতিক বেশাখ দিবস পালন করা সম্ভব হয়নি। ষোল বার অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আমার ১৩ (তের) বার আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়।
মূলত: বুদ্ধের করুণা ও সহনশীলতা দর্শনের মাধ্যমে বুদ্ধের প্রজ্ঞাদর্শন আজ বিশ্বব্যাপী প্রচারিত ও প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে মানবজাতি এই প্রজ্ঞা-দর্শনের সুফল পাচ্ছে। আমি একসময় (Wisdom sees loving kindness and compassion) নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলাম। এই মৈত্রী করুণা কিন্তু বুদ্ধের প্রজ্ঞা দর্শনকে মানুষের মনোজগতে বেশী করে উদ্ভাসিত করেছে। এই দুই গুণের মধ্যেই সহনশীলতা নিহিত। আজকাল বিশ্বে মানুষে মানুষে, ব্যক্তি-ব্যক্তিতে, পরিবারে, সমাজে যে সংঘাত দ্বন্ধ, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, হত্যা এইসব অবলোকন করি তার পেছনে রয়েছে লোভ-দ্বেষ-মোহাবিষ্ট নিষ্ঠুর স্বার্থ। স্বার্থের জন্যই আমরা সর্বত্র অস্থিরতা দেখি।
আন্তর্জাতিক বেশাখ দিবসটি জাতিসংঘ কর্তৃক পালিত হয় বুদ্ধ প্রদর্শিত গুণাবলী মানব জাতির কল্যাণে আরো বেশী করে প্রচারের জন্য। সেজন্য প্রতিটি সম্মেলনে একটি প্রতিপাদ্য দেয়া হয়। সেই প্রতিপাদ্যের উপর গবেষকরা তাঁদের সুচিন্তিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং মনোজ্ঞ আলোচনা হয়। উপস্থিত প্রতিনিধিবৃন্দ জ্ঞান সমৃদ্ধ হন। জাতিসংঘ এই মহান কাজটি করার সর্বত্র প্রশংসিত ও ধন্যবাদার্হ হন।
২০২১ সালে ‘আন্তর্জাতিক বেশাখ দিবস’ পালনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ইতিহাসে এই প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউসে বেশাখ দিবস উদ্যাপন। আমেরিকার একজন বিশ্বখ্যাত বৌদ্ধ ধার্মিক উপাসিকা মিসেস ওয়াংমো দিক্সি এর আন্তরিক প্রচেষ্টায় এটি বিশ্বে এই প্রথম সম্ভব হয়েছে। মিসেস দিক্সি এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বুদ্ধগয়ায় যখন প্রথম International Tripitak Chanting ceremony অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘকে একত্রিত করে বুদ্ধভাসিত ত্রিপিটক (বিনয়, সূত্র, অভিধর্ম) পাঠ বা আবৃত্তি করাটা ছিল এই উৎসবের মূল উদ্দেশ্য। এই মহা উপাসিকা এতই ধার্মিক যে তিনি প্রতিটি মূহুর্ত সৎকাজে ব্যয় করেন। হোয়াইট হাউসে আয়োজিত অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন ধর্ম ইন্টু ফাউন্ডেশনের সভাপতি শেকার নরসিমহান। প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে বেশাখ ডে (বুদ্ধপূর্ণিমা) উদ্যাপনের শুভ সূচনা করেন হোয়াইট হাউসের সেকেন্ড জেন্টলম্যান ডগলাস এমফোফ এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান তিনটি শাখার (মহাযান, থেরবাদ ও বজ্রযান) প্রতিনিধিবৃন্দ। বজ্রযানের প্রতিনিধিত্ব করেন ওয়াংমো দিক্সির পিতা ধর্ম কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ভেনারেবল তার্তং টুল্কো রিনপোচে, থেরবাদ ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন শ্রীলংকার জন্মজাত প্রখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু ভদন্ত উপরতন মহাথেরো, মহাযান ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন রেভা মার্ভিন হারাদা।
হোয়াইট হাউসে বেশাখ দিবস উদ্যাপন
বৌদ্ধ ধর্মের তিন শাখা প্রধান প্রার্থনার মাধ্যমে বেশাখ ডে কে সুশোভিত করেন। এই অনুষ্ঠানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেন, “এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বজুড়ে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অমূল্য অবদানকে উদ্যাপন করি। আমরা আজ বৌদ্ধদেব সাথে যোগ দিয়েছি নিজেদের মধ্যে তাদের মধ্যে থাকা সহযোগিতার বিশ্বজনীন নীতি, শান্তি ও মানবতার প্রতি সম্মান ও মর্যাদাকে ধারণ করার জন্য। এই দিনটি আমাদের সকলকে অংশীদারি মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটাতে এবং সম্মিলিতবাবে কাজ করার মাধ্যমে সর্বোত্তম পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য অনুপ্রাণিত করবে”। (ইন্ডিয়ান টাইমস্)
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বিবৃতির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সাথের একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি হোয়াইট হাউস থেকে প্রকাশিত তাঁর সরকারি বার্তায় ঘোষণা করেন, “সিদ্ধার্থের জন্ম, বোধিজ্ঞান লাভ এবং মহাপরিনির্বাণ দিনটিকে স্মরণ করার মাধ্যমে [ফার্স্ট লেডি] জিল বাইডেন এবং আমি আমেরিকা ও বিশ্বজুড়ে বৌদ্ধদের কাছে আমাদের ঊষ্ণ শুভেচ্ছা জানাই। একটি প্রদীপের আনুষ্ঠানিক আলোকসজ্জা পবিত্রতার প্রতীক যা ২৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে পালিত হয়ে আসছে। তাই দিনটি আমাদেরকে বুদ্ধের করুণা, নম্রতা, মানবতা ও নিঃস্বার্থতার শিক্ষাগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয় যা আজকের দিনে খুবই দরকার। আজকের এই দিনে আমেরিকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অনেক অবদানকে স্মরণ করি যা আমাদের সম্প্রদায় এবং দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। আমরা সবাই একত্রে সামনের উজ্জ্বল দিন সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি”। হোয়াইট হাউস)
সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা এক পৃথক বার্তায় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিস বলেছেন, “আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং বৌদ্ধরা ভেসাক উদ্যাপনের মাধ্যমে সিদ্ধার্থের জন্ম, জ্ঞানার্জন এবং মহাপরিনির্বাণকে সম্মান জানায়। ভেসাক নিঃসন্দেহে একে অপরের প্রতি সমবেদনা, ঐক্য এবং যতেœর প্রতীক। এই মানবতার শিক্ষার চেয়ে কোন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আজ হতে পারে না। ডগলাস এমফোফ এবং আমি যারা উদযাপন করছেন তাদের সকলের শুভ কামনা করছি”।
মহাউপাসিকা সেমো ওয়াংমো দিক্সি বলেছেন, “অত্যন্ত আশ্চর্যজনক যে আমেরিকান গণতন্ত্রের কেন্দ্র বিন্দুতে বৌদ্ধ অনুশীলনের তিনটি প্রধান শাখা এক সাথে প্রার্থনা করেছে। এই শুভ দিনে বুদ্ধের জীবন ও শিক্ষা প্রতিপালনের শপথ এখানেই নেওয়া উচিত। আজ হোয়াইট হাউসে বসে যে প্রার্থনা করেছি তার প্রভাবে সমস্ত প্রাণীর জীবনে নিয়ে আসুক অনাবিল শান্তি আর আরোগ্য, বিশেষত ধর্মের প্রাণকেন্দ্র, ভারতে বসবাসকারী আমাদের ভাই- বোনদের জীবনে। আমেরিকার হোয়াইট হাউসে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের আলোর ন্যায় সমস্ত বিশ্বজুড়ে জ্ঞান ও সম্প্রীতির আলো ছড়িয়ে পড়ুক। আমেরিকার বৌদ্ধ ইতিহাসকে সম্মান ও স্মরণীয় রাখতে আমরা আজ এক মিলিয়ন প্রদীপ জ্বালিয়ে দিচ্ছি। আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মকে চিহ্নিত করেছে পিউ রিসার্চ। যদিও আমেরিকান বৌদ্ধদের বেশীর ভাগই এশীয় তবুও আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক ও চলাফেরা সমস্ত বৌদ্ধদের মধ্যে একই”।
পরিশেষে একটা ঐতিহাসিক বিষয় উল্লেখ করতে হয়। বৌদ্ধরা বিশ্বাস করে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেননি বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই আমেরিকা আবিষ্কার করেছে। Readers Digest এ আমি এই তথ্যটি পেয়েছি। তৎকালীন বৌদ্ধ রাষ্ট্র আফগানিস্থান থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গুয়েতেমালায় গিয়েছিলেন যার আদিনাম ছিল গৌতমমালা। রিডার্স ডাইডেস্টের ঐ পাশ্চাত্য লেখক তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিলেন (তবে ঐ রেফারেন্সটা এই মূহুর্তে আমার মনে নেই)।
আজ সেই আমেরিকায় হোয়াইট হাউসে বেশাখ দিবস উদ্যাপন একটি যুগান্তকারী ঐতিহাসিক ঘটনা। কালক্রমে আমেরিকায় বৌদ্ধ ইতিহাস আরো উন্মোচিত বলে মনে করি। বিশ্বে বুদ্ধের প্রজ্ঞার আলো অবিরাম ছড়িয়ে দিতে পারলে মানবজাতি আলোকিত হবে, জ্ঞানের আলোয় স্নাত হবে। সমস্ত সন্ত্রাস, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, হত্যা, পরশ্রীকাতরতা, কুপমন্ডুকতা, অন্ধ ধর্ম বিশ্বাস, মৌলবাদ, সম্প্রসারণবাদ পরিহার করে মানবজাতির মধ্যে প্রজ্ঞার আলো ছড়িয়ে দিই তাহলেই আমরা প্রত্যেকে সার্থক হবো, সফল হবো। বিশেষ করে করোনা মহামারিকালে হোয়াইট হাউসে বেশাখ দিবস পালন ছিল বিশ্বের জন্য অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। আন্তর্জাতিক বেশাখ দিবস আরো উদ্ভাসিত হোক।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রাবন্ধিক, WFB এর শিক্ষা, কৃষ্টি ও শিল্প বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির পরপর চারবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান।