বিভাগীয় সম্পাদক

২৩ জুন ১৯৪৯। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস। দেখতে দেখতে দলটি ৬৮ বছর অতিক্রান্ত করতে চলেছে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলটি নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সত্তরে পদার্পণ করবে; নিঃসন্দেহে এটি একটি শ্লাঘার বিষয়। এই ৬৮ বছরে এই ভূখ-ে কত বড় বড় দল, বড় বড় নেতার আবির্ভাব হয়েছে, কিন্তু নেতার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে দলেরও এক ধরনের অপমৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কেন? আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে সেটি না হয়ে বিপরীত চিত্র কেন? আওয়ামী লীগের প্রাণভোমরাটি কোথায়?
বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে পথিকৃৎ জনপ্রিয় নেতা ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী পদে বরিত হন তিনি। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের ফলে শেরে বাংলা বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বহীন ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার কৃষক-প্রজা পার্টি কার্যত বিলুপ্ত হয়।

১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা, ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা, মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কার্যক্রম, শেখ মুজিবের ওপর সরকারি নির্যাতন, শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করতে না দেওয়া প্রভৃতি ঘটনা দ্রুত রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দেয়। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিকল্প কোনো রাজনৈতিক দল বা প্লাটফরম না থাকায় তাদের স্বেচ্ছাচারিতা সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়। ইতিহাসের প্রয়োজনে তখনই প্রগতিশীল মুসলিম লীগ কর্মীরা স্বতন্ত্রভাবে দল গঠন ও সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত ‘গণতান্ত্রিক কর্মীশিবির’ থেকে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে নতুন দল গঠনের। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হন টাঙ্গাইলের জনপ্রিয় তরুণ নেতা শামসুল হক এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান। শেরে বাংলাও নতুন দলের সদস্য হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু পরে তাকে আর উৎসাহ প্রকাশ করতে দেখা যায় নি। ১৯৫৪-এর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন আবার শেরে বাংলা রাজনীতিতে সক্রিয় হন। তিনি তার দল কৃষক-প্রজা পার্টিকে নতুন নামে অর্থাৎ কৃষক-শ্রমিক পার্টি নামে পুনরুজ্জীবিত করেন। গঠিত হয় নেজামে ইসলামি পার্টি। ’৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে বিরোধী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। ‘হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী’র আহ্বানে পূর্ব বাংলার মানুষ মুসলিম লীগের কবর রচনা করে।
যুক্তফ্রন্টের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে শেরে বাংলা মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের ঐক্য শেষ পর্যন্ত টেকেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্র, কৃষক-শ্রমিক পার্টির সংকীর্ণতা ও ষড়যন্ত্রের ফাঁদের পা দেওয়া প্রভৃতি ঘটনার প্রেক্ষিতে যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশনের অবসান ঘটে। ১৯৫৬-৫৭ দুই বছর পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের সরকার এবং কেন্দ্র্রেও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন এক বছর সরকার পরিচালনা করে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি ও রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ হয়।
ইতোমধ্যে শেরে বাংলা বয়সজনিত কারণে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। কৃষক-শ্রমিক পার্টি বা কেএসপি-রও কার্যত অপমৃত্যু ঘটে। ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি করেন। ১৯৬২ থেকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন ও বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বে সমারোহ হন শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, ৬-দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাঙালির প্রথম জাতি-রাষ্ট্র স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বাঙালির অবিসংবাদী একক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন, তেমনি আওয়ামী লীগ জননন্দিত সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় অবদান বাঙালির জন্য একটি স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই একটি ঘটনার ভেতর দিয়ে বাঙালি, বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অবিভাজ্য হয়ে ওঠে। ফলে ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পরও এই দলটিকে নিশ্চিহ্ন করা যায় নি। অথচ শেরে বাংলা বা মওলানা ভাসানীর মতো বিপুল জনপ্রিয় জাতীয় নেতাদের তিরোধানের ভেতর দিয়ে তাদের সৃষ্ট রাজনৈতিক দল ও ধারাটিরও বিলুপ্তি ঘটে।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার ক্ষমতাসীন হয়। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনিবার্য বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তারপর বহু ঘটনা ও অঘটনের পর ২০০৮ সালের ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ গণরায় নিয়ে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার পালন করছে। হত-দরিদ্র, পশ্চাৎপদ বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক নতুন, উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে নতুন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে এই দেশ উন্নত-সমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠবে।
শত ঝড় ঝঞ্ঝা, বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চার নেতাসহ অগণিত নেতা-কর্মীদের আত্মদান, জেল-জুলুম-অত্যাচার ভোগ এবং দলটির প্রতিষ্ঠার পর অধিকাংশ সময় অর্থাৎ, ৭০ বছরের মধ্যে ৪৮ বছরই ক্ষমতার বাইরে থাকলেও এই দলটি নিঃশেষিত হয়ে যায় নি; বরং ফিনিক্স পাখির মতো বারবার জেগে উঠে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দলে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ ব্যক্তিনির্ভর নয়, বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী আদর্শনির্ভর বলেই ব্যক্তির মৃত্যু হলেও, দলের মৃত্যু নেই। পক্ষান্তরে ব্যক্তিনির্ভর বলে শেরে বাংলা ও ভাসানীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাদের দলেরও বিলুপ্তি ঘটে।
আওয়ামী লীগের এই টিকে থাকা ও বড় হওয়ার আসল বহস্য আর কিছুই নয়, বাংলাদেশের জনগণের সাথে এই দলের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির বন্ধন। বাঙালি জাতির আশা-আকাক্সক্ষা স্বপ্ন-সংগ্রাম অর্জন ও অগ্রগতি সবকিছু জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের সাথে। জনগণই হচ্ছে এই দলের প্রাণভোমরা। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যেহেতু অবিচ্ছিন্ন সত্তায় একীভূত, সে কারণে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন আওয়ামী লীগ থাকবে।

সূত্র- অনলাইন, এবি/ টিআর-২৩/৬/২০১৯

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here