বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। ১ মাসের অধিক সময় ধরে টানা ছুটির পর ৫ মে সরকারি অফিস আদালত আনুষ্ঠানিকভাবে খোলার কথা। যদিও গত ২৫ এপ্রিল পঞ্চম মেয়াদে ছুটি যখন বর্ধিত করা হয়, তখন ১৮ টি সরকারি প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যবিধি মেনে রপ্তানিমূখী শিল্পকারখানাসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যার ফলে কার্যত লক ডাউন ব্যবস্থা এক প্রকার ভেঙ্গে পড়েছে, লোকজনের ভিড় নাগরিক জীবনকে ব্যস্ত করে তুলছে।

অবশ্য ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটির শুরু থেকেই কিছু সংখ্যক লোক বিধি নিষেধ মানলেও অধিকাংশ মানুষজন নানা অজুহাতে ঘর থেকে বের হয়েছিল। বাজার-হাট, ব্যাংকের কার্যক্রমসহ নানা কারণে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে সামাজিকভাবে মেলামেশা করেছিল।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ২৬ মার্চ থেকে যে এক মাসেরও অধিক সময়ের সাধারণ ছুটি দেয়া হয়েছিল, যে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা আর দুরত্ব সৃষ্টির জন্য, সেটা পঞ্চাশ ভাগের বেশি সফল হয়নি। যদিও এই থেকে কিছুটা হলেও উপকার পাওয়া গেছে। এরফলে সামাজিক সংক্রমণের যে ব্যাপক বিস্তৃতি তা কিছুটা হলেও থেমে গেছে। কিন্তু এই ছুটিতে বাংলাদশের অর্থনীতি একটি বড় ঝাকুনির মধ্যে পড়েছে, অনেক মানুষ বেকার হয়েছে, দরিদ্র মানুষের অভাব-অনটন বেড়েছে আর কর্মহীন হয়ে পড়েছে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ। এই জন্যেই সরকার ছুটি না, বরং করোনা সংক্রমণ মোকাবেলার বিকল্প পথ নিয়ে ভাবছে এবং সেই বিকল্প পথগুলোর জন্যেই ২৫ এপ্রিলের পর থেকে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান খুলে সরকার এক ধরণের নীরিক্ষা করছে।

সরকারের একাধিক সূত্র বলছে যে, ৫ মে এর পর (৬ মে বুদ্ধ পূর্ণিমা এবং ৭ মে থেকে খোলা) সরকার ছুটি আর বাড়াতে চায় না। না বাড়ানোর একটি বড় কারণ সামনে ঈদ এবং ঈদে একটি বড় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপার আছে, সাধারণ মানুষের আয়-উপার্জনের প্রশ্ন জড়িত। আর একারণেই এই সময়ে সরকার যেমন মানুষের অর্থনীতিকে সচল রাখতে চায়, তেমনি জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিও মাথায় রাখবে। আর এমনিভাবে সরকার ছুটি আর না বাড়িয়ে বিকল্প ১০টি বিষয়ের কথা ভাবছে। এগুলো হলো-

১. ছুটি না থাকলেও গণজমায়েত, মাহফিল, ইফতার পার্টি, সমাবেশ বা অনেক লোক জমায়েত হতে পারে এরকম কার্যক্রম আপাতত কিছুদিন বন্ধ রাখার নির্দেশনা হবে।

২. স্কুল কলেজ বন্ধ রাখা। যেটা ইতিমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন যে, পরিস্থিতি ভালো না হলে সেপ্টেম্বরের আগে স্কুল-কলেজ খোলা হবেনা।

৩. কলকারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরন করার জন্য গাইডলাইন তৈরি করা। যেন কলকারখানাগুলো সামাজিক দুরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালিত হয়- এইজন্য এফবিসিসিআই -এর উদ্যোগে একটি গাইডলাইন তৈরি করা হচ্ছে। এই গাইডলাইন মেনে যেন কারখানাগুলো চলে- সেজন্য কঠোরভাবে নির্দেশনা দেয়া হবে।

৪. গণপরিবহনে সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত করা। গণপরিবহনে যে বসার ব্যবস্থা সেখানে যেন সামাজিক দুরত্ব নিশ্চিত হয়- সেটাকে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিকদের ধান কাটার জন্য নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গণপরিবহন ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সেখানে সামাজিক দুরত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছিল। একটি আসনের পর আরেকটি আসন খালি রেখে মানুষ ওঠানো হয়েছিল। এভাবে গণপরিবহনগুলোতে সামাজিক দুরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবহার করার কথা ভাবছে সরকার।

৫. অফিস আদালতে মাস্ক ব্যবহার এবং স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ। অফিস-আদালতগুলো যখন খোলা হবে, তখন সেখানে যেন স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলা হয় এবং সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মাস্ক ব্যবহার জরুরী বলে মনে করছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অফিস-আদালত খুললেও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে যেন খোলা হয় তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে।

৬. পরীক্ষার পরিধি বিস্তৃত করা এবং সরকার ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দিয়েছে যে, পরীক্ষার পরিধি আরো বিস্তৃত করা, যাতে সরকার একটি ধারণা পেতে পারে এবং চলতি মাসের মধ্যেই নতুন করে আরো পাঁচটি, অর্থাৎ মোট ২৫টি স্থান থেকে নিয়মিত পরীক্ষা করা শুরু হবে। দিনে গড়ে ৫ হাজারের উপরে পরীক্ষা করা যাবে বলে সরকার আশা প্রকাশ করছে।

৭. প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন এবং আইসোলেশন জোরদার করা। যারা সন্দেহভাজন, উপসর্গ আছে বা পরীক্ষা করা যাচ্ছেনা, এধরনের সন্দেহভাজনদের আলাদা করা এবং এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বা প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশন জোরদার করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। বসুন্ধরা হাসপাতালটি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে চালু হয়ে যাবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ডিসিসি মার্কেটটাও খুব শীঘ্রই প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশন তৈরি হলে সন্দেহভাজনদের সেখানে রেখে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা করে সংক্রমণ রোধ করা যাবে।

৮. বাজার-হাট উন্মুক্ত স্থানে রাখা। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সরকার ঘিঞ্জি এলাকায় যে বাজারগুলো, তা সরিয়ে উন্মুক্ত স্থানে বাজার-হাট করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করছে তা অব্যহত রাখতে চায় এবং এটাকে আরো বিস্তৃত করতে চায়।

৯. আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার উন্নত ব্যবস্থা করা এবং সরকার মনে করছে যে, যেভাবে করোনা সংক্রমিত হচ্ছে তাতে অন্তত পাঁচ ভাগ মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন হবে এবং সেজন্য হাসপাতালগুলোকে দ্রুত প্রস্তুত করা। যাতে অর্থনৈতিক জীবন এবং কর্মসংস্থানের পাশাপাশি চিকিৎসা চলে তা নিশ্চিত করা।

১০. সর্বশেষ উদ্যোগ হলো যখন যেখানে আক্রান্ত ছড়িয়ে পড়বে সাথে সাথে সেই এলাকাটিকে লক ডাউন করে সামাজিক সংক্রমণ ঠেকানো।

সরকার মনে করছে যে, ঢালাও ছুটি দিয়ে অর্থনীতিকে অচল রাখার বদলে যদি স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক বিছিন্নতা মেনে অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ সচল রাখা যায় তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি ইতিবাচক। সেটা নিয়েই সরকার কাজ করছে এবং আগামী ৫ মে’র পর থেকে সেই পথেই হয়তো যাওয়া শুরু করবে সরকার।

বাংলা ইনসাইডার

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here