শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

কোরবানির ঈদ মানে ত্যাগের আনন্দ। এই পবিত্র উৎসবের রয়েছে বিশেষ কিছু বিধিবিধান। এর অন্যতম হলো তাকবিরে তাশরিক। ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত ৫ দিন ২৩ ওয়াক্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর পুরুষদের সশব্দে এবং নারীদের নীরবে তাকবির বলা ওয়াজিব। নামাজের পর বলতে ভুলে গেলে স্মরণ হওয়ামাত্রই বলতে হবে। একে তাকবিরে তাশরিক বলে, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’ অর্থ: ‘আল্লাহ মহান! আল্লাহ মহান! আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নাই, আল্লাহ মহান! আল্লাহ মহান! আর সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যই।’

ঈদের নামাজঃ
ঈদের দিন সকালে ঈদগাহে বা খোলা মাঠে সম্মিলিতভাবে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায় করা হয়। একে সালাতুল ঈদ বা ঈদের নামাজ বলা হয়। ঈদের নামাজের পর খুতবা দেওয়া ওয়াজিব, এই খুতবা শোনাও ওয়াজিব। পুরুষ ও শিশুরা ঈদগাহে আসবে; নারীদের জন্য ঈদগাহে আসা ওয়াজিব নয়। ঈদের দিন ফজরের নামাজের পর ঈদের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত কোনো নফল নামাজ পড়া যায় না। এই নিয়ম নারী-পুরুষ ও শিশু সবার জন্য।

ঈদের দিনের করণীয় আমলঃ
এদিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, ফজরের নামাজ মসজিদে জামাতে আদায় করা, সকালে গোসল করা, মিসওয়াক করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরা, আতর-সুগন্ধি ব্যবহার করা, ঈদগাহে এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা, আসা-যাওয়ার সময় তাকবির বলা, খোলা মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করা, সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময় করা। সকাল থেকে কোনো কিছু না খাওয়া, প্রথম আহার কোরবানির গোশত দিয়ে করা অথবা পশু জবাইয়ের পর আহার করা। যাঁরা পয়লা জিলহজ থেকে ক্ষৌরকর্ম থেকে বিরত ছিলেন, তাঁরা কোরবানির পর ক্ষৌরকার্য করবেন বা নখ কাটবেন।

কোরবানি-সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানঃ
যদি একাধিকজন একটি পশু শরিকে কোরবানি করেন; তবে প্রথমে প্রত্যেকের অংশ আনুপাতিক হারে সমবণ্টনে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। খুশি মনে কেউ কম নিলে বা কাউকে নিজের থেকে বেশি দিলে দোষ নেই। সব অংশীদার একমত হলে গরিবদের জন্য যতটুকু ইচ্ছা রেখে দিতে পারেন। তবে যাঁর যাঁর অংশ থেকে যাঁর যাঁর মতো আলাদা দেওয়া উত্তম ও নিরাপদ। কারণ, সবার প্রয়োজন সমান নয় এবং মনমানসিকতা এক নয়।

একটি কোরবানি হলো একটি ভেড়া, ছাগল বা দুম্বা। গরু, মহিষ ও উট প্রতিটি ভেড়া, ছাগল ও দুম্বার সাতটির সমান। তাই গরু, মহিষ ও উটে অনূর্ধ্ব সাতটি পর্যন্ত অংশ দেওয়া যায়। আকিকা হলো একটি বা দুটি ছাগল। সুতরাং গরু, মহিষ বা উটে অংশ হিসেবে যেভাবে কোরবানি দেওয়া যায়; সেভাবে একটিকে সাতটি ধরে অংশ হারে আকিকাও করা যায়। কোরবানি ও আকিকা একসঙ্গে করতে কোনো বাধা নেই। ওয়াজিব কোরবানি ছাড়া ছোট-বড় জীবিত–মৃত যেকোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে যে কেউ নফল কোরবানি আদায় করতে পারেন। এতে উভয়েই সওয়াবের অধিকারী হবেন।

নারী যদি সামর্থ্যবান বা সাহেবে নিসাব হন, তাঁর জন্যও কোরবানি ওয়াজিব। শিশুদের ওপর কোরবানিসহ কোনো ফরজ-ওয়াজিব প্রযোজ্য নয়। হিজড়ারা মূলত নারী বা পুরুষ, তাই তারাও প্রাপ্তবয়স্ক এবং সামর্থ্যবান হলে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো কোরবানিও ওয়াজিব হবে।
এমন কিছু লোক (নারী বা পুরুষ) রয়েছেন, যাঁরা বিশেষ কোনো কারণে কোরবানির পশুর গোশত খেতে পারেন না। যেমন: অ্যালার্জি, অ্যাজমা বা অনুরূপ কোনো কারণে। এতে কোনো অসুবিধা নেই। এমনকি তাঁর নিজের কোরবানি হলেও। কারণ, সামর্থ্যবানের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব; গোশত খাওয়া ওয়াজিব নয়। কোনো অসুবিধা না থাকলে কোরবানির গোশত খাওয়া ও খাওয়ানো সুন্নত। যাদের স্বাস্থ্যগত কারণে বিশেষ বিশেষ গোশত ঝুঁকিপূর্ণ বা চিকিৎসকের বারণ রয়েছে, তারা বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে স্বল্প পরিমাণে খেতে পারে।

পশু জবাই করার নিয়মঃ
কোরবানির পশুর মাথা দক্ষিণ দিকে রেখে কিবলামুখী করে পাঠ করবেন, ‘ইন্না ছলাতি ওয়া নুছুকি ওয়া মাহইয়াইয়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রব্বিল আলামিন, লা শারিকা লাহু ওয়া বিযালিকা উমিরতু ওয়া আনা আউওয়ালুল মুসলিমিন।’ অর্থ: ‘নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই নিবেদিত। তাঁর কোনো শরিক নাই, আমাকে এই নির্দেশই দেওয়া হয়েছে এবং আমি প্রথম অনুগত মুসলিম।’ (সুরা-৬ আনআম, আয়াত: ১৬২)। ‘ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাজি ফাতারাছ-ছামাওয়াতি ওয়াল আরদা হানিফাওঁ ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকিন।’ অর্থ: ‘আমি একনিষ্ঠভাবে মনোনিবেশ করলাম তাঁর প্রতি যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সুরা-৬ আনআম আয়াত: ৭৯)।

তারপর ‘আল্লাহুম্মা মিনকা ওয়া লাকা (হে আল্লাহ! তোমা হতে তোমার উদ্দেশ্যে)।’ ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ (আল্লাহর নামে, আল্লাহ মহান!) বলে ধারালো অস্ত্র দ্বারা সযত্নে জবাই করবেন। জবাইয়ের সময় নাম বলা বা পড়া জরুরি নয়। জবাইয়ের পর দোয়া করবেন, ‘হে আল্লাহ, আমার বা আমাদের অথবা তার বা তাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। আমিন!’ অন্যকে দিয়ে জবাই করালে তাঁর চাহিদামতো সম্মানী হাদিয়া দিয়ে তাঁকে খুশি করতে হবে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ফরজ ইবাদতঃ
কোরবানির পর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ফরজ ইবাদত। তাই যত্রতত্র রাস্তাঘাটে পথের ধারে পশু জবাই করা যাবে না। নির্দিষ্ট স্থানে পশু জবাইয়ের পর মলমূত্র, রক্ত ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে এবং বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে বা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। এটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ আমল।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here