আহসানুল কবির
 ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’। তারপরও জীবনে মৃত্যু আসে-মৃত্যুই সত্য এবং অনিবার্য বলেই মৃত্যুর মুখোমুখি অবাধ্য হয়ে বলা যায় না- ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো?’ ‘তাই মরণ রে, তুহু মম শ্যামসমান।’ রবীন্দ্রনাথ থেকে শঙ্খঘোষ পর্যমত্ম মৃত্যু চেতনাটি শেষ পর্যমত্ম কঠিনেরে ভালোবাসা এবং নিজেকে সমর্পন করা। ১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ কবিগুরু মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর গত সময় ৭০ বছর। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের চৌদ্দনম্বর পুত্রের জন্ম ১৮৬১ সালের ২৫ বৈশাখ যে বাড়িতে হয়েছিলো-তারই ঠিক আশি বছর পর ১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ তাঁর মৃত্যু হয়।
দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে রবীন্দ্রনাথ একদিকে তৈরী হয়েছেন অপরদিকে মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্রকে তৈরী করেছেন। মননশীল ‘কবি-মানুষের’ অবসর বলতে আশ্রম জীবন শিলাইদহ এবং শামিত্ম নিকেতন। জমিদারির দায়িত্ব প্রাপ্ত হবার পর তাঁকে বারবার আসতে হয়েছে-পূর্ববঙ্গের রাজশাহী, পাবনা এবং কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। ‘বাড়ির বাহিরে যাওয়া আমাদের বারণ ছিল সেই জন্যে বিশ্ব প্রকৃতিকে আড়াল আবডাল হইতে দেখিতাম যেদিন বাহির হইলাম সেদিন গঙ্গার তীরভূমি যেন আমাকে কোলে করিয়া লইল।’ (জীবনস্মৃতি: রবীন্দ্রনাথ)।
এমন মুক্তি আর মুগ্ধতার মধ্যে রবীন্দ্র-প্রতিভার বিস্ময়কর বিকাশ শিলাইদহের মাটিতেই ঘটতে থাকে। এখানে এসেই রবীন্দ্রনাথ মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যে রাজা প্রজার ব্যবধানে তিনি মানুষের জন্যে কল্যাণকর, সহায়কগুচ্ছ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাস নিয়ে তিনি গাইলেন ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, তাঁর এ আচরন দুই সম্প্রদায়ের মানুষই গ্রহণ করে তাঁকে মাহামানবের মর্যাদায় আসিন করেছিলো। তারপরও রবীন্দ্রনাথ তাঁর পারিবারিক প্রয়োজনে বড় মেয়ে মাধুরিনাতীর (বেলা)’র বিয়ে উপলক্ষে ১৯০১ সালে শিলাইদহ ছেড়ে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন। ১৮৯১সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যমত্ম প্রায় একদশক রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে পরিবারসহ বাস করেছিলেন। ১৯০১ সালেই রবীন্দ্রনাথ শামিত্ম নিকেতনে ৫জন ছা্ত্র নিয়ে স্কুল শুরু করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ঘিরেই রবীন্দ্রনাথের মেধা অর্থ সবকিছুই যখন ব্যয় হচ্ছিল তখন প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ভারত ব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ আশ্রমভিতিক পরীক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানটির সফলতায় কবির পিতৃ বিয়োগ ,পত্নী-বিয়োগ ,পু্&ত্র- বিয়োগ, কন্যা-বিয়োগের কষ্ট কবিকে ভুলিয়ে রেখেছিলো ।
তবে বলাকা কাব্যের গতিবাদি দর্শনই তো কবিকে্ক্রমশ-অভিজ্ঞতার ভারে বুড়া করে তুলছিলো আর সেক্ষেত্রেই কবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই শারীরিকভাবে অসু্স্থ  হয়ে পড়েছিলেন। কবিগুরুর প্রিয় শিষ্য শামিত্মদেব ঘোষের লেখা ‘গুরুদেবের তিরোধান পর্ব’ থেকে এই দিবসের কথা ইতিহাস সুত্রে তুলে ধরা হলো। ‘তাঁর প্রস্টেট গ­্যান্ডের কাজ যথাযথ ভাবে হচ্ছিল না। ফলে নিয়মিত প্রস্রা্বের অসুবিধা দেখা দিয়েছিল ’। সেই সময় কবি কালিম্পঙে মৈত্রেয়ী দেবীর আশ্রয়ে ছিলেন। এমন অবস্থার একটু উন্নতি হলে কবিকে শামিত্ম নিকেতনে নিয়ে আসা হয়। এখানে এসে তিনি পুত্রবধূ, মেয়ে এবং নাতনীর সেবা যত্নে একটু ভালো বোধ করলেও তাঁর অবস্থার উন্নতিু হচ্ছিল না দেখে সবাই মিলে কলকাতার শল্যচিকিৎসকের কাছে নেয়ার সিদ্ধামত্ম হয়। তবে এর ফাঁকে কবিকে কবিরাজি চিকিৎসাও দেয়া হয়। তাতে কোন ফল না পাওয়ায় কবিকে এবার সত্যি সত্যি কলকাতা নেয়ার ব্যবস্থা করা হলো। তবে কবি এমন অস্ত্রোপচারে ইচ্ছুক ছিলেন না বলে আরো পূর্বে তুঁাকে কলকাতা নেয়া হয়নি। এবার অবস্থার বেগতিক ভাব দেখেই কবি সম্মতিদেন। ‘কলকাতায় গুরুদেবকে যেদিন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল-সেদিন উদয়ন বাড়ির সামনে এখানকার আশ্রমিকরা সমবেত হয়েছিলেন। যে পথ দিয়ে তাঁকে গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয় , সেই রাসত্মার দু’পাশে সকলে ভারাক্রামত্ম চিত্তে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে জোড় হাতে প্রণতি জানিয়েছিলেন ।
’ গাড়িটি ধীরে চলছিল কবি ভারাক্রামত্ম ছিলেন চোখে কালো চশমা কবির অশ্রু জল এবং আবেগ চশমার আড়ালেই ঢাকা ছিলো। কয়েক দিন হয়ে যাবার পর কবির অস্ত্রোপচারের খবর এলো এবং সেই সাথে কবির জ্ঞান না ফেরার খবরে শামিত্মদেব ঘোষ রাত্রি বেলাতেই কলকাতায় রওনা দিয়েছিলেন ।
২২শ্রাবন তিনি সকালে জোড়াসাঁকোর বাড়ি পৌঁছে দেখেন হাজার হাজার মানুষের ভীড় বাড়িটি ঘিরে। চারিদিকের মানুষের ভীড় ঠেলে শামিত্মদেব বাবু সিঁড়ি ভেঙ্গে দু’তলার ঘরে গিয়ে কবির পা’য়ের কাছে দাঁড়িয়ে দেখেন কবির নির্বাক চেহারা। কবির মুখে দু’পাটি দাঁত লাগানো ছিলো। সেগুলো খুলে রাখার কারনেই মুখটি চুপসে ছিল। ‘সে যুগের আকাশুবাণীর দ্বারা গুরুদেবের খবর এমন ভাবে প্রচারিত হয়েছিল যে ,তার দ্বারা সকলেই বুঝে নিয়েছিলেন গুরুদেবের মৃত্যু আসন্ন।’ ভাবনাটি বেলা ১২ টার দিকেই সত্যি  হলো একটি ঘোষনায় ‘গুরুদেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন’। মানুষের ভীড়ে বাড়িটির ফটক ভেঙ্গে গিয়েছিলো। সরকার তাড়াতাড়ি করেই শব যাত্রার ব্যবস্থা করেছিলেন পাছে মানুষের ভীড় আরও বেড়ে যাবে এই ভয়ে। শোকযাত্রায় লাখো মানুষের ঢল। শহর থেকে নিমতলা শ্মশান ঘাট পর্যমত্ম মানুষের সারি। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে শামিত্মনিকেতন থেকে শিক্ষক সুরেন কর এসেছিলেন তিনি তিনটি পিতলের কলস এনেছিলেন শ্মশানের ভস্ম নেয়ার জন্যে। শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শেষে মানুষ চলে গেলে শামিত্মদেব ঘোষ এবং সুরেন কর ছাই কুড়িয়ে কলস ভরে শামিত্মনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সেদিন শামিত্মনিকেতনের মানুষ সেই ঘড়া তিনটিকেই শ্রদ্ধা ভক্তিতে দু:খভরা মনে বরণ করেছিলো। দর্শনার্থীদের দেখাবার জন্য উত্তরায়নে রবীন্দ্রভবনে তা রাখা হয়েছিল। শামিত্মদেব ঘোষ গুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর একটি আঙ্গুলের হাড় এনেছিলেন তা নিজ বাড়িতে সযত্নে রেখে গেছেন। দুই বাংলাতেই তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ধরে রাখার জন্যে বড় মাপের প্রতিষ্ঠান বা  সংগ্রহশালা গড়ে উঠেনি বলে জোড়াসাঁকো থেকে হারিয়ে গেছে মৃত্যু শয্যার সেই খাটটি আর শামিত্ম নিকেতন  থেকে হারিয়ে গেছে ভস্মের তিনটি কলস এবং নোবেল পুরস্কারের পদক। আর আমাদের বাংলাদেশেও পতিসর সাজাদপুর এবং কুষ্টিয়ার শিলাইদহ হারিয়ে যাচ্ছে ফুরিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নামচুরি জ্ঞানচুরির চেয়ে ধনচুরির প্রতিই লোভ বেড়েছে লাভ বেড়েছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here