৭১’র এই দিনে ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন পটিয়া থানার (বর্তমানে চন্দনাইশ উপজেলা) দোহাজারী ও আশেপাশের এলাকাগুলো মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে হানাদারমুক্ত হয় পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের ৫টি থানা।

দোহাজারীতে সংগঠিত পাক হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের দুইদিন ব্যাপী সম্মুখ সমরের পর ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে হানাদার বাহিনী পালিয়ে গেলে ঐদিনই দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাঁচটি থানার সর্বত্র উত্তোলন করা হয় বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা। মুক্ত হয় পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম।

কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীর পটিয়া থানা থেকে শুরু হয়ে চকরিয়া থানার সীমানা পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকার তৎকালীন পাঁচটি থানা বোয়ালখালী, আনোয়ারা, পটিয়া, সাতকানিয়া ও বাশঁখালী ১৯৭১ এর প্রায় পুরো ৯ মাস পাক হানাদারবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল।

৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনীর দখল থেকে বৃহত্তর দোহাজারী মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাঁচটি থানা (তখন বর্তমান কক্সবাজার জেলা দক্ষিণ চট্টগ্রামের অংশ ছিল) সম্পূর্ণরূপে শক্রমুক্ত হয়।

এর আগে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণের সাথে গেরিলা বাহিনীর মরণপণ আঘাত বিভিন্ন থানায় হানাদার বাহিনীর গড়ে তোলা আস্তানাসমূহ আক্রান্ত হতে থাকে।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের প্রথম দিকে প্রতিটি থানায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর আক্রমণ জোরদার হয়ে উঠলে পাকবাহিনী তাদের মনোবল হারিয়ে ফেলে। ফলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের শেষ দিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েকটি থানা বিশেষ করে আনোয়ারা, বাঁশখালী মুক্ত হয়ে যায়। এই দুটি থানা হানাদারমুক্ত হলেও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কসহ মূল তিনটি থানা সাতকানিয়া, পটিয়া ও বোয়ালখালীর নিয়ন্ত্রণভার পাকবাহিনীর হাতেই ছিল এবং তা দোহাজারীতে দুইদিনের সম্মুখ যুদ্ধ পর্যন্ত বলবৎ ছিল।

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই পাকবাহিনী দোহাজারীকে ঘিরে দুর্ভেদ্য রক্ষণব্যুহ গড়ে তোলে। যাতে করে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা যায়। দোহাজারীতে স্থল, রেল, নৌ ও আকাশপথের সুযোগ কাজে লাগিয়ে সড়ক বিভাগের কার্যালয়টিকে তাদের প্রধান অফিস হিসাবে বেছে নেয়। একই সাথে পাশাপাশি অবস্থিত সাঙ্গুভ্যালি টিম্বার ইন্ডাস্ট্রিজের বাংলোকে ভিআইপি রেস্ট হাউজ বানিয়ে এবং উক্ত কারখানার বিশাল মাঠকে হ্যালিপ্যাডে রূপান্তরিত করে তাদের দুর্গ গড়ে তোলে। একইভাবে দেওয়ানহাট বিএডিসি কার্যালয়, দোহাজারী উচ্চ বিদ্যালয়, দোহাজারী বিদ্যুৎ ভবনকে ব্যারাকে পরিণত করে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পুরো এলাকায় নির্বিচারে নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যেতে থাকে।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে যখন পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে বিভিন্ন থানা থেকে পিছু হটে আসতে থাকে তখন পাক হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দালাল রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর সহযোগিতায় ভয়ংকর আক্রোশে পটিয়া সাতকানিয়ার নিরীহ জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। দালাল বাহিনীর সদস্যরা গ্রামে গ্রামে বিশেষ করে হিন্দু প্রধান এলাকায় গিয়ে ধরে নিয়ে আসতো নিরীহ যুবক-যুবতীদের। মুক্তিবাহিনীর চর অজুহাতে ধরে আনা যুবকদের পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো। আর মহিলাদের উপর চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন। সেসময় রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল খরস্রোতা শঙ্খনদীর পানিও।

এরই মধ্যে ১১ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর একটি দল শঙ্খ নদীর দক্ষিণপাড়ে কাটগড়, কালিয়াইশ এলাকায় পাকবাহিনীর পরিত্যক্ত ব্যাংকারগুলোর দখল নিয়ে অবস্থান গ্রহণ করে।

১২ ডিসেম্বর দুপুরে ক্যাপ্টেন গুরুং এর নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর একটি দল এবং বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) কমান্ডার ইঞ্জিনিয়ার সিদ্দিক আহমদ, ডাঃ বি এম ফয়েজুর রহমান (এমএলএ), আবুল কাসেম সন্দ্বীপের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের আরো একটি দল যৌথভাবে এসে অগ্রবর্তী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়ে হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১২ ডিসেম্বর বিকেল থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ দল সকালে শঙ্খনদীর অপরপাড়ে দোহাজারী উপ-শহরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। এসময় পাকবাহিনীও সমানে জবাব দিতে থাকে। এভাবে বিরামহীন যুদ্ধ চলার পর ১৪ ডিসেম্বর বেলা ২টার দিকে পাকবাহিনী তাদের সব সরঞ্জাম ফেলে সদলবলে পালিয়ে যায়। তিনদিনের এই সম্মুখ সমরে মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও নিহত হয় হানাদার বাহিনীর ৯ সদস্য ।

পাক হানাদার বাহিনী যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে দোহাজারী থেকে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্ত হয়ে যায় দোহাজারীসহ পুরো (কক্সবাজার ছাড়া) দক্ষিণ চট্টগ্রাম। সাথে সাথে মিছিল সহকারে রাস্তায় নেমে আসে শত শত মুক্তিপাগল জনতা।বিজয়ের গানে গানে মুখরিত হয়ে উঠে রাজপথ। পৎ পৎ করে উড়তে থাকে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল সবুজের পতাকা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here