নিজস্ব প্রতিবেদক :১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের সৈনিক বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখীলের মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমান। ৪ আগস্ট রাজাকার-আলবদর বাহিনী তাকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল এ মুক্তিযোদ্ধাকে। রাজাকার বাহিনীর ওপর গ্রেনেড ছুঁড়ে মারাই ছিল তাঁর অপরাধ। সেদিন কয়েকজন রাজাকারকে আহত করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পরও মেলেনি এ বীরের স্বীকৃতি। শহীদ এ মুক্তিযোদ্ধাকে ভুলে যেতে বসেছে নতুন প্রজন্মও।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমানের সহযোদ্ধা ও পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭০ সালে এখলাছুর রহমান তখন দুরন্ত কিশোর। কধুরখীল উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্র। তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কিশোর এখলাছের দায়িত্ব ছিল সংবাদ বাহকের। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতন-নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ দারুণভাবে পীড়া দেয় কিশোর এখলাছকে। শত্রুহননের অদম্য স্পৃহা সৃষ্টি হয় তাঁর মধ্যে। ৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের সোমবার দুপুরে তিনি ছুটে যান ছাত্র ইউনিয়ন মহিলাকর্মী মায়া চৌধুরীর কাছে। তাঁর কাছে থাকত দলের অস্ত্র-শস্ত্র। তাঁর কাছ থেকে তিনটি হাত গ্রেনেড সংগ্রহ করেন এখলাছ।
উপজেলার কধুরখীল খোকার দোকান এলাকায় চায়ের দোকানে বসেছিলেন এখলাছ। সেই সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা কধুরখীল দুর্গাবাড়ির কাছে পৌঁছালে এখলাছ তাদের লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারেন হাত গ্রেনেড। প্রথম টার্গেট লক্ষভ্রষ্ট হয়ে রাস্তার পাশে খাদে বিস্ফোারিত হয়। এরপর হাতে থাকা বাকি দুটি গ্রেনেড ছুঁড়লে আহত হয় দু’রাজাকার। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রাজাকাররা। এখলাছ পালিয়ে যেতে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজাকাররা তাঁকে ধরে বিবস্ত্র করে বেঁধে ফেলে। রাজাকাররা লুঙ্গি দিয়ে পেঁচিয়ে রিকশাযোগে উপজেলা সদরে তাকে নিয়ে আসার পথে লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন এখলাছ। সেদিন আর শেষরক্ষা হয়নি।
উপজেলা সদরের রাজাকার ক্যাম্পে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে নিমর্মভাবে হত্যা কবা হয় তাকে। ১০ আগস্ট তাঁর লাশ পায় স্বজনেরা।
এরপর উপজেলার আকুবদণ্ডী গ্রামের বৈলতলী মাজার শরীফ সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
দেশ স্বাধীনের পর তাঁর বিদ্যাপীঠ কধুরখীল উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনকে তাঁর নামানুসারে করা হয় ‘শহীদ এখলাছ মিলনায়তন’। হাজিরহাট ইকবাল পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদ এখলাছ পার্ক। পরবর্তী সময়ে উদ্যোগ না থাকায় তাও হারিয়ে যায় কালের বির্বতনে।
এ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের আক্ষেপ, স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও শহীদ এখলাছের কোনো খোঁজ-খবর নেননি কেউ। এখন পর্যন্ত তাঁর পরিবার স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো সনদই পায়নি। একটি সনদের জন্য তাঁরা বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে ঘুরতে পরপারে চলে গেলেন এ বীর শহীদের মা মছুদা খাতুন। দেখে যেতে পারেননি স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় বীর সন্তানের স্বীকৃতি। মুক্তিবার্তা (লাল বই) নম্বর : ০২০২০৩০২০৯ এবং মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে শহীদ এখলাছুর রহমানের নাম আছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের স্মারকে তাঁর নাম লেখা হয়েছে মরহুম এখলাছুর রহমান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে ‘মরহুম’ লিখে ইস্যুকৃত সাময়িক সনদপত্র তাঁর পরিবারের কোনো কাজে আসছে না। পরবর্তী সময়ে নাম সংশোধনের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিবের (প্র-৩) দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইস্যুকৃত সার্টিফিকেটে ‘শহীদের স্থানে মরহুম লিপিবদ্ধ হওয়ায় সংশোধনের আবেদন’ শিরোনামে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, বোয়ালখালী চট্টগ্রাম বরাবর ২০১০ ইংরেজির ২১ ডিসেম্বর একটি পত্র লেখা হয়।
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৪৮বছর পার হলেও একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার জাতীয় স্বীকৃতির জন্য দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে তার পরিবারকে।
মুক্তিযুদ্ধে বোয়ালখালীতে প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এখলাছুর রহমানের স্মরণে রবিবার (৪ আগস্ট) খতমে কোরআন ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করেছেন এ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ।
আলোকিত বোয়ালখালী পরিবার এ মহান শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।