আমেরিকায় মশার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে কয়েক মাস আগেই সেখানকার নানা বড় শহরে ড্রোন নামিয়েছিল গুগল। এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে মশা দমনের ভার নিল খোদ নাসা। নাসার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থার ল্যাবরেটরি। এদের হাতিয়ারটি ড্রোনের চেয়েও শক্তিধর। সোজা কথায় বললে মশা মারতে কামান নয়, রীতিমতো স্যাটেলাইট দেগেছে নাসা। তবে এর পাশাপাশি ছোট ছোট অজস্র দলও তৈরি করেছে তারা। থাকছে এয়ার ট্র্যাপিংয়ের ব্যবস্থাও। যে ব্যবস্থা সবচেয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। স্যাটেলাইট ছাড়াও সেই দলের কাছে মজুত থাকবে ক্যামেরা, গ্রাফ, ম্যাপিংয়ের ব্যবস্থা, তথ্য যাচাই ও জমা করার জন্য নানা ধরনের চিপ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র দাবি, আমেরিকা তো বটেই, বাংলাদেশ, ভারত-সহ এশিয়ার প্রায় সব দেশই মশার আতঙ্ক বুকে নিয়েই বাঁচছে। প্রতি বছর প্রায় ৩০-৫০ কোটি মানুষ মশাবাহিত রোগের শিকার হন। মৃত্যু হয় প্রায় ১ কোটি জনের। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয়ের সময়টুকুও পাওয়া যায় না। ইদানীং সে সমস্যা আরও বাড়ছে বলে উদ্বেগ হু-র।

কিন্তু মশা মারতে এমন কামান, থুড়ি, স্যাটেলাইট দাগতে হল কেন নাসা-কে?

‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’ (সিডিসি)-র তথ্য অনুয়ায়ী, গত কয়েক দশক ধরেই মশার হানাদারিতে ব্যতিব্যস্ত ইংল্যান্ড-আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিশেষ করে গরমের সময় এই মশার উৎপাত বাড়ছে। ক্যালিফোর্নিয়া, সান ফ্রান্সিসকো-সহ আমেরিকার বেশ কিছু বড় শহর মশার জ্বালায় নাজেহাল। গত কয়েক দশক ধরেই মশার অত্যাচার ক্রমেই বাড়ছে আমেরিকা জুড়ে। ২০০৪ সালে মশার প্রাদুর্ভাব যতটা ছিল, ২০১৬-য় পৌঁছে সেই প্রভাব বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। নাসা-র এই কাজটি প্রথমে ক্যালিফোর্নিয়া শহরে শুরু হয় বছর পাঁচেক আগেই। আসে বিপুল সাফল্য। সেই সফলতাই এ বার এই প্রোজেক্টকে গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে দেওয়ার সাহস জোগায় নাসা-কে। যা এত কাল ক্যালসার্ব (ক্যালিফোর্নিয়া ভেক্টরবর্ন ডিজিজ সার্ভিলেন্স) ছিল তা এ বার ভেক্টরসার্ব হয়ে উঠবে। অর্থাৎ ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়াও গোটা আমেরিকায় যেখানে যেখানে মশা রয়েছে সেখানেই তল্লাশি চালাবে।

মশাদের এই বাড়বাড়ন্ত ও কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বিষয়টি ভাবনায় রেখেছে আমেরিকাকে। গোটা বিশ্বেই মশারা দিনের পর দিন জিনগত মিউটেশনের ফলে মশা মারার বিভিন্ন পদ্ধতি ও রাসায়নিকের সঙ্গে অভিযোজিত হতে শিখে যাচ্ছে। তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করেন মশাবাহিত অসুখের বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী। কলকাতায় মশা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবেও তিনি এই বিষয়টিকেই দায়ী করছেন।

 স্যাটেলাইট এ বার মশা খুঁজবে?

এও কি সম্ভব? আশ্বস্ত করছেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি এমিরেটাস জুলজির প্রাক্তন অধ্যাপক সমীরণ চক্রবর্তী। তাঁর মতে, আসলে স্যাটেলাইটটি লক্ষ্য রাখবে কোথায় মশা জন্মানোর পরিবেশ-পরিস্থিতি রয়েছে। সেই তথ্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে চলে যাবে টিমের কাছে। দলে থাকছেন বিভিন্ন পতঙ্গবিদ, বিজ্ঞানী, পতঙ্গবিদ্যার অধ্যাপক-সহ অনেকেই। তাঁরা অকুস্থলে পৌঁছে মশার ডিম পাড়ার খবর, লার্ভা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা, মশার শরীরে কতটা জীবাণু, আদৌ কোনও রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা তাদের আছে কি না এই পুরো বিষয়টাই খতিয়ে দেখবে। তৈরি করবে জায়গাটির মানচিত্র, তুলে রাখবে ছবিও। যার সাহায্যে বোঝা যাবে ওই মশা কতটুকু ছড়িয়ে যেতে পারে, জায়গার অবস্থানই বা কী। পরীক্ষার বিষয়টিতে সাহায্য করবে বিভিন্ন সংস্থার ল্যাবরেটরি। এ বার সেই সব তথ্য ও পরীক্ষার ফল জমা হবে দলের কাছে থাকা চিপে। সেই ডেটাবেসই ছড়িয়ে দেওয়া হবে নাসার বিশেষ ওয়েবসাইটে। সেই ওয়েবসাইট নিয়মিত দেখে মশা দমনের পদক্ষেপ নেবে সরকারি দফতরগুলি। থাকবে এয়ার ট্র্যাপিংয়ের ব্যবস্থাও। মশারা কোনও রাজনৈতিক ব্যবধান মানে না। জানে না কোন দেশের আকাশ কার। তাই ডানায় ভর করে সহজেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যেতে পারে। প্রজাতি অনুসারে মশাদের আবার ওড়ার ক্ষমতাও পৃথক হয়। কেউ হাওয়ার সাহায্যে বেশি দূর ওড়ে, কেউ আবার নিজেরাই অনেক দূর উড়তে পারে। এয়ার ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আসা মশাদের গতিবিধি ও হাওয়ার গতি কোন অভিমুখে সেই দিকটাও খতিয়ে দেখা যাবে।

কাজ হবে তো?

তবে ফল পেতে গেলে এই পদ্ধতি প্রতি দিন ধৈর্য ধরে পালন করতে হবে। বেশ ব্যয়সাপেক্ষ এমন উপায় চালিয়ে যেতে না পারলে খুব একটা লাভ নেই। ঠিক যে কারণে ভারতেও সত্তর-আশির দশকে ইসরো-র সাহায্যে জিপিএস ম্যাপিং করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মসকিউটোজেনিক কন্ডিশন (কোথায় কোথায় মশার ডিম পাড়ার জন্য অনুকূল অবস্থা তা জানা) খতিয়ে দেখার কাজ সফল হয়নি বলে মনে করেন ম্যালেরিয়া ও পতঙ্গবাহী অসুখের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী। তাঁর মতে, ‘‘ভারতেও অনেকেই জিপিএস ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে মশা দমনের উপায়ের কথা ভেবেছেন। গবেষণাও করেছেন। এই পদ্ধতিতে এক দিনেই কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না। দীর্ঘ দিন ধরে একটু একটু করে জমা হবে তথ্য। বিভিন্ন পরীক্ষা, ব্যর্থতা, সাফল্য সব নিয়েই এগোবে প্রোজেক্ট। খুব ব্যয়সাধ্য ও বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের অভাবেই ভারতে এই ধরনের প্রোজেক্ট বেশি দিন চলেনি। তবে ঠিক মতো কাজ করলে ও খরচ জোগাতে পারলে এ ভাবে মশার উৎপাত অনেকটা কমিয়ে দেওয়া সম্ভব।’’

তাঁর সঙ্গে সহমত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক পার্থিব বসু। তাঁরও বিশ্বাস, নাসা যে ভাবে কোমর বেঁধে মশা মারতে নেমেছে তার সুফল মিলবে হাতেনাতে। মশার লার্ভা পাওয়ার পরেই শুরু হবে আসল কাজ। সে সব পরীক্ষা করে তাতে অসুখের জীবাণু পেলে এক রকম, না পেলে ওই স্থানের অন্যান্য মশাদের লার্ভা নিয়ে ফের পরীক্ষা— রীতিমতো সময়সাধ্যও ব্যয়সাধ্য। তবে এই পদ্ধতিই সবচেয়ে আধুনিক।’’

আমেরিকা বা বিশ্ব সরিয়ে নজরের বৃত্তকে আর একটু ছোট করলে বোঝা যায় দুনিয়ার এই দুর্বিসহ যন্ত্রণা থেকে বাদ নেই শহর কলকাতাও গত শুক্রবারও পুর অধিবেশন ডেঙ্গি নিয়ে উত্তাল হয়েছে। এই অবস্থায় নাসা-র এমন পদ্ধতি মনে আশার আলো দেখালেও খরচ ও সমন্বয় সবটা মেনে এমন পদ্ধতির শরণ নেওয়া যায় কি না তা ভাবাচ্ছে কলকাতার তামাম পতঙ্গবিদ ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here