মাওলানা তোফায়েল গাজালি 

রাসূল (সা.)-এর জীবনে ঘটে যাওয়া আলৌকিক ঘটনাবলির অন্যতম মেরাজ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রেমের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে আপন সান্নিধ্যে ধন্য করেছিলেন মেরাজের মাধ্যমে।

প্রকৃতপক্ষে মেরাজ মাওলাপ্রেমের সর্বোচ্চ স্তর, যে স্তর অর্জন করতে পেরেছিলেন একমাত্র মুহাম্মাদুর রাসূল (সা.)। পবিত্র কালামে মাওলাপাক মেরাজ বা ইসরার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা মূলত প্রেমিক আর প্রেমাস্পদের রহস্যময় একটি ভেদ। সেই ভেদ জানেন একমাত্র আশিক মুহাম্মদও (সা.) প্রকৃত মাশুক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা।

কবি বলেন- আশিক ও মাশুকের কি যে ভাব/জানে না দু’কাঁধের ফেরেশতা, জানে না মাখলুকাত। পবিত্র কুরআনের ভাষায়- ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি তার বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’ (সূরা ইসরা : আয়াত ১)

শব অর্থ রাত এবং মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন অর্থাৎ ঊর্ধ্বগমনের রাত। মেরাজের রাতে মহানবী (সা.) সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল (আ.) ও হজরত মিকাইল (আ.)-এর সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে প্রথমে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় যান।

তারপর সেখান থেকে প্রথম আসমান হয়ে সপ্তম আসমান, এরপর সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছান। এরপর একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ করেন এবং মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ও জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।

নবুওয়াতের ১১তম বছরের ২৭ রজবে মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল। তখন নবীজির বয়স ৫১ বছর। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘শপথ নক্ষত্রের যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথী বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি।

আর তিনি নিজে থেকে কোনো কথা বলেন না। তা প্রদত্ত ওহি (ভিন্ন অন্য কিছু) নয়। তাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাইল আ.)। সে (জিবরাইল আ.) পাখাবিশিষ্ট, সে স্থিত হয়েছে দূর ঊর্ধ্বে। অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তাঁর বান্দার প্রতি যা তিনি ওহি করেছেন।

ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনগুলো।’ (সূরা নাজম : ১-১৮)।

রাসূল (সা.) মেরাজের রাতে নবীদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.), সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়।

তিনি তাদের সঙ্গে সালাম ও কুশল বিনিময়সহ কথা বলেন। তিনি বায়তুল মামুর হয়ে সিদরাতুল মুনতাহার কাছে যান। সেখানে চারটি নদী দেখেন; দুটি প্রকাশ্য ও দুটি অপ্রকাশ্য। প্রকাশ্য নদী দুটি হলো নীল ও ফোরাত আর অপ্রকাশ্য দুটি নদী জান্নাতের। (বুখারি শরিফ : ৩৬৭৪)।

মেরাজে মহানবী (সা.)কে বিভিন্ন পাপের শাস্তি দেখানো হয়। বেনামাজির শাস্তি দেখানো হলো-বড় পাথর দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হচ্ছে, আঘাতে মাথা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, আবার ভালো হয়ে যাচ্ছে, আবার আঘাত করা হচ্ছে। জাকাত না দেওয়ার শাস্তি দেখানো হলো-তাদের সামনে ও পেছনে পাওনাদাররা ঘুরছে। তারা পশুর মতো চরছে এবং নোংরা আবর্জনা ময়লা ও পুঁজ এবং কাঁটাযুক্ত আঠালো বিষাক্ত ফল খাচ্ছে, জাহান্নামের উত্তপ্ত পাথর ভক্ষণ করছে।

চোগলখোরের শাস্তি দেখানো হলো-তাদের পার্শ্বদেশ থেকে মাংস কেটে তাদের খাওয়ানো হচ্ছে; আর বলা হচ্ছে, যেভাবে তোমার ভাইয়ের মাংস খেতে, সেভাবে এটা খাও। অনুরূপ দেখলেন গিবতকারীদের শাস্তি। তারা অগ্নিময় লোহার নখর দিয়ে তাদের চেহারা ও বক্ষ বিদীর্ণ করছে। রাসূল (সা.) বললেন, হে জিবরাইল (আ.), এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হলো সেসব লোক যারা পশ্চাতে মানুষের মাংস খেত (পেছনে মানুষের সমালোচনা করত)। দেখানো হলো-সুদখোরদের বড় বড় পেট, যার কারণে তারা নড়াচড়া করতে পারছে না।

তাদের সঙ্গে রয়েছে ফেরাউন সম্প্রদায়, তাদের আগুনে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। জিনাকার বদকার নারী, যারা ব্যভিচার করেছে এবং ভ্রূণ ও সন্তান হত্যা করেছে, তাদের দেখলেন পায়ে আংটা লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে; তারা আর্তচিৎকার করছে। ব্যভিচারী জেনাকার পুরুষের শাস্তি দেখলেন। এক সম্প্রদায়ের সামনে একটি উত্তম পাত্রে উপাদেয় তাজা ভুনা মাংস এবং অন্য নোংরা একটি পাত্রে পচা মাংস। তারা উত্তম পাত্রের উন্নত তাজা সুস্বাদু মাংস রেখে নোংরা পাত্রের পচা মাংস ভক্ষণ করছে।

বললেন, হে জিবরাইল (আ.), এরা কারা? তিনি বললেন, এরা হলো ওইসব পুরুষ যারা নিজের বৈধ স্ত্রী রেখে অন্য নারীগমন করেছে এবং ওইসব নারী, যারা নিজের বৈধ স্বামী রেখে পর পুরুষগামিনী হয়েছে। রাসূল (সা.) দেখলেন, এক লোক বিশাল লাকড়ির বোঝা একত্র করেছে, যা সে উঠাতে পারছে না; কিন্তু আরও লাকড়ি তাতে বৃদ্ধি করছে।

বললেন, হে জিবরাইল (আ.), এটা কী? তিনি বললেন, এ হলো আপনার উম্মতের সে ব্যক্তি-যে মানুষের আমানত আদায় করেনি; বরং আরও অধিক গ্রহণ করেছে। দেখলেন অশ্লীল বাক্য ব্যবহারকারী ও ফেতনা সৃষ্টিকারীদের শাস্তি। তাদের জিহ্বা ও ঠোঁট অগ্নিময় লোহার কাচি দ্বারা কর্তন করা হচ্ছে, আবার তা আগের মতো হয়ে যাচ্ছে এবং আবার কাটা হচ্ছে; এভাবেই চলছে। দেখলেন ছোট্ট একটি পাথর থেকে বিশাল এক ষাঁড় বের হলো; আবার ওই ষাঁড় সেই পাথরের ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল; কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছিল না। বললেন, হে জিবরাইল (আ.), এটা কী? তিনি বললেন, এটা হলো সেসব লোকের দৃষ্টান্ত, যারা বড় বড় দাম্ভিকতাপূর্ণ কথা বলে লজ্জিত হয়, পরে আর তা ফিরিয়ে নিতে পারে না।

এতিমের সম্পদ আত্মসাৎকারীদের দেখলেন। তাদের ওষ্ঠাধর যেন উটের ঠোঁটের মতো। তাদের মুখে আগুনের জ্বলন্ত কয়লা প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে এবং তা তাদের পায়ুপথ দিয়ে বের হয়ে আসছে। মদ, মাদক ও নেশা গ্রহণকারীদের শাস্তি দেখলেন। তারা জাহান্নামিদের শরীর থেকে নির্গত বিষাক্ত নোংরা পুঁজ পান করছে। নবী করিম (সা.) মালিক নামে জাহান্নামের রক্ষী ফেরেশতাকে দেখলেন। সে মলিন মুখ, হাসি নেই। বলা হলো, জাহান্নাম সৃষ্টির পর থেকে সে কখনো হাসেনি। (বুখারি ও মুসলিম)

মেরাজের উপহার সম্পর্কে হাদিসে উল্লেখ আছে, মেরাজের রজনীতে নবী করিম (সা.) ও তাঁর উম্মতের জন্য কয়েকটি উপহার প্রদান করা হয়-প্রথমত, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ; যা প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্ত ছিল। দ্বিতীয়ত, তাঁর উম্মতের যেসব ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, আল্লাহ তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন। তৃতীয়ত, সূরা বাকারার শেষাংশ। চতুর্থত, সূরা বনি ইসরাইলের ১৪টি নির্দেশনা। যেমন-১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর সঙ্গে কারও শরিক না করা, ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ করা, ৩. আত্মীয়স্বজন, এতিম ও মুসাফিরের অধিকার প্রদান করা, ৪. অপচয় না করা, ৫. অভাবগ্রস্ত ও প্রার্থীকে বঞ্চিত না করা, ৬. হাত গুটিয়ে না রেখে সবসময় কিছু দান করা, ৭. অন্যায়ভাবে কোনো মানুষকে হত্যা না করা, ৮. দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তান হত্যা না করা, ৯. ব্যভিচারের নিকটবর্তী না হওয়া, ১০. এতিমের সম্পদের ধারেকাছে না যাওয়া, ১১. যে বিষয়ে জ্ঞান নেই, তা অনুসন্ধান করা, ১২. মেপে দেওয়ার সময় সঠিক ওজন পরিমাপ করা, ১৩. প্রতিশ্রুতি পালন করা, ১৪. পৃথিবীতে দম্ভভরে চলাফেরা না করা।

মেরাজের রাত বরকতময়। শরীয়তে এ রাতে নির্দিষ্ট করে বিশেষ কোনো ইবাদতের নির্দেশনা না থাকলেও এ রাতে নফল ইবাদত-বন্দেগি করা অলি-বুজুর্গদের স্বভাব। সুফিরা প্রবল পরাক্রমশালী আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও তার বন্ধু, মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহামিলনের এ রাতকে নিজেদের মুক্তির মাধ্যম মনে করেন। আমাদের উচিত এ রাতে নিয়মতান্ত্রিক ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি অধিক পরিমাণে দরুদ শরিফ, কুরআন তেলাওয়াত, ইসতিগফার ও নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে নিজের ও বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্য দোয়া করা। আল্লাহতায়ালাই একমাত্র তাওফিক দাতা।

মাওলানা তোফায়েল গাজালি : আলেম ও গণমাধ্যম কর্মী

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here