

বিপ্লবের মহানায়ক মাষ্টার দা সূর্যসেনের প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রদ্ধা- ১৮ই এপ্রিল ১৯৭৫ সাল।








অগ্নিযুগে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
‘জগতের যত বড় বড় জয়
বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে
হইয়াছে মহীয়ান।
কোন রণে কত খুন দিল নর
লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর
লেখা নাই তার পাশে।
কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি
কত বোন দিল সেবা
বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে
লিখিয়া রেখেছে কেবা?’
মাষ্টারদা সূর্যসেনের জীবনসঙ্গিনী পুষ্পকুন্তলা-
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ার ঐতিহ্যবাহী দত্ত পরিবারের কন্যা পুষ্পকুন্তলা। পিতা নগেন্দ্রনাথ দত্ত।
পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ থাকায় শুধুমাত্র লোক দেখানো ১৯১৯ সালে ১৬ বছরের তরুণী পুষ্পকুন্তলাকে বিয়ে করেন মাষ্টারদা সূর্যসেন। বিয়ে হলেও বাসর রাত হয়ে উঠলো বিচ্ছেদের রাত। কারন বিপ্লবী তাঁর দলের কাছে সন্ন্যাসব্রত অর্থাৎ মৈথুনবর্জিত জীবনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। সূর্য সেন তাঁর বাসররাতে পুষ্পকুন্তলাকে বললেন, তাঁর বিপ্লবী দলের নিয়ম অনুযায়ী তাঁর জীবন স্ত্রীসঙ্গ-বর্জিত। চরম হতাশা গ্রাস করে এই তরুণীকে। বাসর রাতের দু-একদিন পরই চলে যান সূর্য সেন;
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সন্দেহে জেলে যান। তারপর পুষ্পকুন্তলার শুধুই স্বামীর প্রতীক্ষা। ৯ বছরের বিবাহিত জীবনে মাত্র তিনবার স্বামীর দেখা পান পুষ্পকুন্তলা, তিনবারই ব্যর্থ হন স্বামীর গভীর সাহচর্য থেকে। তারপরও স্বামীর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড তাঁকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করেছিল তাঁর সহযাত্রী হতে। টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বামীর কোলে মাথা রেখে পুষ্পকুন্তলার মৃত্যু হয়।
(লেখাটি ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত অংশমাত্র, নিম্নে মাষ্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম জেল থেকে তাঁর বৌদির কাছে হস্ত লিখিত দুটি চিঠি সংযোজন হল)।

বিপ্লবের মহানায়ক মাস্টার দা সূর্য সেনের শেষ কথা এবং শেষ বাণী –
১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী শুক্রবার রাত ৯টা ৩০ মিনিট পটিয়া ধলঘাট গৈড়ালা গ্রামে আত্মীয় বৃদ্ধা ক্ষীরোদ প্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় ১০ হাজার টাকার লোভে বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেন (পরে বিপ্লবীরা তাকে হত্যা করে) ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে মাস্টার দা সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেন। ধরা পরার আগে সহযোদ্ধাদের আলাপ চারিতাই মাস্টার দার শেষ কথা বিপ্লবী মণি দত্তের বক্তব্যে থেকে –
মাস্টার দা বিভিন্ন সময়ে মনের বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রকাশ করতেন বিভিন্ন কবি,সাহিত্যিক বা নিজের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে সেদিন ও ঘটেছিল তাই…তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁর মৃত্যু কিভাবে হওয়া উচিত? কাগজে লিখলেন – Suicide, Surrender,Hanging with bold statement.
প্রথম দুটি শব্দ তিনি বারে বারে কাটলেন, বললেন “এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়,Escape করার সম্ভাবনা নিশ্চয় গুলি ছুঁড়ে পথ করে নেওয়ার চেষ্টা করব। সামনাসামনি গুলি বিনিময় করে আমাকে হত্যা করার সুযোগ আমি দেব না। এভাবে ব্রিটিশের বেতনভুক্ত পুলিশের হাতে গুলি খেয়ে মরার চেয়ে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার জয়গান করে যাওয়ায় শ্রেয়। এতে যদিও সহ্য করতে হয় শারীরিক ও মানসিক হিংস্র নিপীড়ন,তবুও যাওয়ার আগে শুনিয়ে যাওয়া যায় বিপ্লবের মর্মবাণী;ছড়িয়ে দেওয়া যায় অন্তরের আগুন ;দেশের লোকেরা পায় এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা আর শাসকদের হয় রাজ্য হারাবার ভয়ে মানসিক যন্ত্রণা”।


চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ১৮ই এপ্রিল ১৯৩০ সাল রাত ১০টা থেকে ২২ই এপ্রিল মধ্যরাত।
“সি আর বি হবে মাস্টার দা সূর্য সেন চত্বর “(প্রস্তাব)
আমরা চট্টগ্রামবাসী গর্বিত এবং সৌভাগ্যবান ১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধে যে স্বাধীনতা তারই সাথে ১৯৩০ সালে ১৮ এপ্রিল রাত ১০ টা থেকে ২২ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত মাস্টার দার নেতৃত্বে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে যুব বিদ্রোহ প্রায় ৫ দিন তৎকালীন ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রাম শাখা প্রথম স্বাধীন অস্থায়ী জাতীয় সরকারের অধীনে চট্টগ্রাম স্বাধীন ছিল, এই বিশেষ ৫ দিন স্বাধীনতা অর্জনকারী হিসেবে দীর্ঘদিন পরে হলেও তারই স্বীকৃতি স্বরূপ যেহেতু চট্টগ্রাম শহরে বিপ্লবীদের নামে বড় কোন স্থাপনার নামকরণ হয়নি,তাই আগামী প্রজন্ম ইতিহাস লিখতে বর্তমান প্রজন্মকে যাতে দায়ী না করে তা থেকে মুক্তি পেতে “সি আর বি” তে সামান্য একটি ফলকে মাস্টার দা সূর্য সেন চত্বর লিখে এই দায় এড়াতে পারি।

কেন আমরা ভুলতে বসেছি, বিপ্লবের চারণভূমি সিআরবি! বিপ্লবের মহানায়ক মাস্টার দার নেতৃত্বে অস্ত্র কেনার জন্য রেল কর্মচারীদের বেতনের ১৭ হাজার টাকা লুন্ঠন করে কলকাতা পাঠিয়েছিল। বীরকন্যা প্রীতিলতার নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমনের ঘটনা, টাইগারপাস থেকে ছদ্মবেশধারী কল্পনা দত্ত ধরা পরা, সে অগ্নিযুগে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল রেল। এই রেলে বিপ্লবীরা ছদ্মবেশে কত গোপন আক্রমণ শাণিত করেছেন। সিআরবির রাস্তা, পাহাড়ে বিপ্লবীদের কতশত পদচিহ্ন বিরাজমান, তা ইতিহাসবিদরা কান পাতলেই এখনো পায়ের আওয়াজ শুনতে পাই। এসব বিপ্লবীদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ সংরক্ষণ তো দুরে থাক, মুছে ফেলার প্রতিযোগীতায় নেমেছি আমরা। তাই বর্তমান চলমান আন্দোলন থেকে দাবি উঠুক, সিআরবি হবে বিপ্লবের মহানায়ক “মাস্টার দা সূর্যসেন চত্বর”।

