করোনা ভাইরাসের আশঙ্কার দিক তুলে ধরে যে চিকিৎসক প্রথম সহকর্মীদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, সেই লি ওয়েনল্যাংও মারা গেলেন প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে। লির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে গভীর রাতে চীনা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক বিভ্রান্তি শেষে উহান সেন্ট্রাল হসপিটাল কর্তৃপক্ষ জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ২টা ৫৮ মিনিটে তার মৃত্যু হয়েছে। এদিকে বীর চিকিৎসক লি ওয়েনল্যাংয়ের মৃত্যুতে চীনে নজিরবিহীন শোকের পাশাপাশি ক্ষোভে ফুঁসছে জনগণ। লি ওয়েনল্যাং হাসপাতালে কাজ করার সময় রোগীদের কাছ থেকে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে পড়ে মারা যান। খবর ওয়েবসাইট ও বিবিসির।
বিবিসি জানায়, বৃহস্পতিবার লি’র মৃত্যুর খবরে চীনের স্যোশাল মিডিয়া সাইট ওয়েইবো ভরে গেছে শোক বার্তায়। আর রাতারাতি সেই শোক রূপ নিয়েছে ক্ষোভে। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করেছে জনগণ। সরকার ভাইরাসটির প্রকোপকে খাটো করে দেখেছে এবং প্রাথমিকভাবে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি গোপন রাখার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাছাড়া, লি এর মৃত্যুতে বাক-স্বাধীনতা নিয়ে ক্ষোভ আরো বেড়েছে। চীনে বাকস্বাধীনতার অভাব নিয়ে জোর আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে।
চীনের স্যোশাল মিডিয়াগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষোভের আগুন। সম্প্রতি কয়েক বছরে দেশটিতে এতবেশি ক্ষোভ, শোক এবং সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের এতটা অবিশ্বাস আর দেখা যায়নি।
ওয়েবসাইটে দুটো হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং দেখা যাচ্ছে। যার একটিতে চিকিৎসক লি ওয়েনল্যাংয়ের কাছে ‘উহান সরকারের ক্ষমা প্রার্থনা করা’ এবং অপরটিতে ‘বাক স্বাধীনতার দাবি’ জানানো হয়েছে।
ওয়েইবো সাইটে লি’র মৃত্যু নিয়ে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘এটি একজন হুইসেলব্লোয়ারের মৃত্যু নয়, একজন বীরের মৃত্যু’। অনেকেই আবার লি’র মুচলেকা নেয়া সেই চিঠি যাতে তার বিরুদ্ধে সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ করা হয়েছিল সেটি উল্লেখ করে মন্তব্য করেছেন, ‘ব্যাপারটা কি বুঝেছেন?’ ‘আবার একই ঘটনা আমাদের ঘটতে দেয়া উচিত হবে না’, বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। ‘সত্যকে আর কতদিন গুজব বলে উড়িয়ে দেয়া হবে? আর কতদিন মিথ্যার বেসাতি চলবে? আর কি কি লুকোছাপা করা হবে?’ এমন সব প্রশ্নও করেছেন অনেকে। আরেকজন লিখেছেন, ‘যা চলছে তা দেখে আপনি ক্ষুব্ধ হলে উঠে দাঁড়ান। এ প্রজন্মের তরুণরা, পরিবর্তন আনার শক্তি আপনাদের হাতেই।’ চীনের দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, চিকিৎসক লি এর বিষয়টি নিয়ে তারা একটি তদন্ত শুরু করবে। চীন সরকারও এর আগে ভাইরাসটি নিয়ে তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা স্বীকার করেছে।
উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন লি। হাসপাতালে কাজ করার সময় রোগীদের মাধ্যমে তিনি করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হন। লি বলেছিলেন, সুস্থ হয়ে ওঠার পর তিনি আবারও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামনের কাতারে থাকতে চান। ৩৪ বছর বয়সী লি গত ৩০ ডিসেম্বর এক বার্তায় তার সহকর্মীদের বলেছিলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে সতর্ক হওয়া জরুরী। আর সে জন্য চীনা কর্তৃপক্ষ তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল মুচলেকা আদায় করে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাণ সংহারী করোনা ভাইরাসে সেখানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৩৬ জনে। চীনের বাইরে মারা গেছে আরও দুজন।
কেবল চীনের মূল ভূখণ্ডই করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ১৬১। চীনের বাইরে আরও অন্তত ২৫টি দেশ ও অঞ্চলে অনেকে এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে নিউমোনিয়ার মতো উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন কয়েকজন রোগী। উহান সেন্ট্রাল হসপিটালে কাজ করার সময় এ ভাইরাসে সংক্রমণের সাতটি ঘটনা পান লি। তার কাছে এই ভাইরাসটিকে দেখতে সার্সের মতোই মনে হয়, যেটা ২০০৩ সালে বিশ্বজুড়ে মহামারীর রূপ নিয়েছিল। ভাইরাসটি নিয়ে সতর্ক করে সংক্রমণ এড়াতে গত ৩০ ডিসেম্বর সহকর্মী চিকিৎসকদের ‘প্রতিরক্ষামূলক পোশাক’ পরার পরামর্শ দিয়ে একটি চ্যাট গ্রুপে পোস্ট দিয়েছিলেন লি। তখন তিনি জানতেন না যে, এ রোগটির কারণ সম্পূর্ণ নতুন এক ভাইরাস, যাকে এখন বলা হচ্ছে নভেল করোনা ভাইরাস বা ২০১৯-এনসিওভি। চার দিন পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা তার কাছে ছুটে যান। একটি মুচলেকায় তার স্বাক্ষর নেন, যেখানে তার বিরুদ্ধে সামাজিক শৃঙ্খলায় মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টিকারী মিথ্যা মন্তব্য করার অভিযোগ আনা হয়।