কল্পতরু সেনগুপ্ত

বাংলার লােক কবি কবিয়াল রাইগােপাল দাশ একজন প্রথম সারির কবিয়াল । তার জন্ম চট্টগ্রাম জেলার ধােরলা গ্রামে ১৯১৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী । তিনি গরীব কৃষক সন্তান। বাল্যকালে স্কুলে পড়ার সময় কবিগানের দিকে আকৃষ্ট হন। তার আগে দুই বছর মাতলের যাত্রা দলে ছিলেন। যাত্রাদল ছেড়ে এসে গৌড়ীর মাঠের বৈষ্ণবদের কাছে কীর্তন গান শেখেন। এক সময় কবিয়াল করিম বক্সের কবিগান শুনে নিজে নিজে গান রচনায় মনােযােগ দেন এবং। কবিয়াল হবার বাসনা জাগে। তার গ্রামের নিকটে রমেশ শীলের বাড়ির গ্রাম । সুতরাং রমেশ শীলের সঙ্গে যােগাযােগ বহু দিনের। রমেশ শীলের প্রভাবে নিজের কৃষি কাজ দেখাশােনার সঙ্গে সঙ্গে কবিগানে মেতে উঠেন । রমেশ শীলকে আনুষ্ঠানিকভাবে গুরু বরণ করেন। সেকালে চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের কারণে তাদের গ্রামেও পুলিশ-মিলিটারীর অত্যাচার ছিল। কবিয়াল বলে তিনি পুলিশের নজরের বাইরে ছিলেন। ১৯৩৭ সালের দিকে একে একে মুক্তি পেয়ে গ্রামে ফিরতে থাকেন। তাঁদের কাছে তিনি নতুন জীবন দর্শন মার্কসবাদের কথা জানেন। বিপ্লবের নতুন ব্যাখ্যা শােনেন। বিপ্লবী সারদা শীল, বিজয় সেন প্রমুখের সঙ্গে আলােচনায় তাঁর রাজনৈতিক পড়াশােনায় আগ্রহ জাগে। তিনি কৃষক সমিতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। পরবর্তীতে তিনি বােয়ালখালী উপজেলা কৃষক সমিতির সভাপতি হন।
কবিগানকে উন্নত করার জন্য রমেশ শীলকে সভাপতি ও ধীরেন্দ্র সেনকে সম্পাদক করে ১৯৩৮ সালে “রমেশ উদ্বোধন-কবি সমিতি” নামে কবিয়ালদের সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতিতে রাইগােপাল দাশ কবিয়াল হিসেবে যােগ দেন এবং সেই সময় থেকে পেশাদার কবিয়াল। কবিগানের সঙ্গে কৃষক সমিতির কাজ করতে থাকেন। ১৯৪৩ সালে চট্টগ্রাম জেলা কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় রাউজান থানার বাগােয়ান গ্রামে । এই সম্মেলনে রমেশ শীল এবং জেলার কবিয়ালরা উপস্থিত ছিলেন। এখানেই জেলার প্রথম কবি সম্মেলন এবং রমেশ শীলকে সভাপতি ও ফণী বড়ুয়াকে সম্পাদক করে চট্টগ্রাম জেলা কবিয়াল সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন রাইগােপাল দাশ, বরদাচরণ দে, সারদা বড়ুয়া, তারাচরণ দাশ, শৈলেন সেন, গােবিন্দ দে। সহ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন হেদায়েত ইসলাম খাঁ । এই সম্মেলনে কবিগান হয়েছিল ‘কষক ও মজুতদার’। দেশভাগের পরে কবিয়ালরা বিপদ আপদের মধ্যেও দেশে থেকে যান। ১৯৪৮ সালে জেলা কবিয়াল সমিতির সম্পাদক হন কবিয়াল রাহাগােপাল দাশ। কিন্তু রাজনৈতিক মতভেদের কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। কবিয়াল সমিতিতে ভাঙন ধরে। ১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনায় সারা ভারত কৃষক সম্মেলনে, বর্ধমান জেলার হাটগােবিন্দপরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনে, কলকাতার মুহম্মদ আলী পার্কে ফ্যাসিস্ট বিরােধী লেখক ও শিল্পী সংঘের তৃতীয় সম্মেলনে, ১৯৪৬ সালে কলকাতায় ভয়ঙ্কও দাঙ্গার পরে সাম্প্রদায়িকতা বিরােধী অভিযানে সুবােধ মল্লিক স্কোয়ারে এবং পার্ক সার্কাসে রমেশ শীলের সঙ্গে কবিয়াল রাইপােগাল দাশ ও ফণীবড়য়া কবিগান গেয়েছিলেন।

আমুচিয়াই কবিয়ালের বাস্তু ভিটায় স্মারক ভাস্কর্য

বাংলাদেশে কাগমারীতে ভাসানী মৌলানার আওয়ামী লীগের সম্মেলনে, রাইগােপাল দাশ ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামে ছাত্র ফেডারেশনের প্রাদেশিক সম্মেলন এবং ১৯৪৩ সালে “চট্টগ্রাম রক্ষা কর”। প্রদর্শনী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক মেলায় রমেশ শীলের সঙ্গে রাইগােপাল দাশ, ফণী বড়ুয়া, হেদায়েত ইসলাম খাঁ এবং আরাে অনেকে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে শ্রদ্ধানন্দ পার্কে কবিগানে রমেশ শীল ও রাইগােপাল দাশ অংশগ্রহণ করেছিলেন। এদের কবিগান শুনে কলকাতার মানুষ মুগ্ধ হয়েছিল, তকালীন পত্রিকায় অভিনন্দন জানিয়ে সংবাদ ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল। সুতরাং রাইগােপাল দাশ পশ্চিমবঙ্গেও পরিচিত।
রমেশ শীলের জীবনাবসানের পরে কবিয়াল রাইগােপাল দাশ ও ফণী বড়য়া কলকাতা এসেছিলেন ১৯৭৮ সালে এবং মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে ক্যাথেডার রােডের মাঠে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিগান গেয়েছিলেন। গানের বিষয় ছিল ‘ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র’। ১৯৮১ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষ্যে রণজি-স্টেডিয়ামে রাইগােপাল দাশ এবং রমেশ শীলের পুত্র যজ্ঞেশ্বর শীল কবিগানে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭৮ সালে বামফ্রন্টের সরকার বাংলার কবিয়াল’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। উদ্দেশ্য ছিল কবিগানের সমাজচেতনা সম্পন্ন এই ধারার গান ফিল্ম করে রাখা। সুতরাং রাইগোপাল দাশ, ফণী বডয়ার এবং শেখ গােমানী দেওয়ানের কয়েকজন শিষ্যের গান দুই রীলে ফিল্ম করা হয়েছে। এই তথ্য চিত্রে রমেশ শীল ও শেখ গােমানী দেওয়ানের সংক্ষিপ্ত জীবনী দেখানাে হয়েছে। এই দলিলচিত্রের নির্মাতা শান্তি চৌধুরী। ছবিটি একটি মূল্যবান দলিল। চিত্র হিসাবে গণ্য হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং প্রগতিশীল কবিগানের জন্য রাইগােপালকে বারেবারে শাসকদলের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ১৯৫৬ এবং ১৯৭১ সালে তাঁর গৃহে অগ্নিসংযােগ করা হয়েছিল, ১৯৫৪ সালে গ্রেপ্তারী পরােয়ানা জারি হয়েছিল, তাকে বাড়িতে না পেয়ে ঘর তল্লাশীর অছিলায় তছনছ করা হয়েছিল । এইরূপ পরিস্থিতির মধ্যে তিনি গান রচনা করেছেন, নাম গােপন করে দুরাঞ্চলে গিয়ে কবিগান গেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশে একজন সম্মানিত গণশিল্পী। দূরদর্শন’-এ নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সমর্থনে রমেশ শীলের সঙ্গে কবিয়াল রাইগােপাল দাশ শহর গ্রাম-গঞ্জে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নির্ভীক কণ্ঠে গান গেয়েছেন। এই মহান ব্যক্তি ১৯৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ।
পরিবার পরিচিতি- কবিয়াল রাইগােপাল দাশ মৃত্যুকালে তিনপুত্র ও চার কন্যা রেখে গেছেন। তারা বর্তমানে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে অরূপ দাশ (পেইন্টার), মেঝ ছেলে এডভােকেট তপন কান্তি দাশ, (বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা), ছােট ছেলে সুমন কুমার দাশ, (প্রধান শিক্ষক, কানুনগােপাড়া অখিল সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়, বােয়ালখালী), বড় মেয়ে প্রীতি দাশ (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা, কুতুবদিয়া সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়), মেঝ মেয়ে দীপ্তি দাশ (সহকারী শিক্ষিকা, শামসুদ্দীন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, কাপ্তাই), সেজ মেয়ে শুভ্রা দাশ, (সহকারী শিক্ষিকা, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল), ছােট মেয়ে শুক্লা দাশ, (সরকারী শিক্ষিকা, পশ্চিম গােমদণ্ডী সঃ প্রাঃ বিদ্যালয়)।
সূত্র : ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সম্পাদক কল্পতরু সেনগুপ্তের সম্পাদনায় ১৯৮৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত “কবিগান” বই হতে সংগৃহীত।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here