মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন :

আইইউসিএন’র প্রতিবেদন বিশ্বের ১৩টি দেশে এশীয় হাতি টিকে রয়েছে। যার সংখ্যা ৩৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার

হাতির আবাসস্থল-খাদ্য কমে যাওয়া, চলাচলের পথে (করিডোর) বাধাগ্রস্ত, সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া ও ফাঁদ পেতে হাতি হত্যাসহ নয় কারণে বার বার লোকালয়ে নেমে আসে বন্য হাতি। বন্যপ্রাণী নিয়ে আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে তা ওঠে এসেছে। ২০০৪ সালের আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, হাতির চলাচলের পথে অধিক মানুষের বসবাস, সড়ক ও নানা নানা স্থাপনা নির্মাণের কারণে হাতি লোকালয়ে নেমে আসে।

গত শনিবার ভোরে বোয়ালখালীতে লোকালয়ে নেমে আসে একদল বন্য হাতি। পাহাড় থেকে প্রায় ১০ কি.মি দূরে ঘন লোকালয়ে নেমে তাণ্ডব চালায় হাতির পাল। হাতির আক্রমণে প্রাণ হারান তিন ব্যক্তি।

স্থানীয়রা জানায়, বোয়ালখালীর পূর্বাঞ্চল পাহাড়ি জনপদে দীর্ঘদিন ধরে হাতির আক্রমণ ও তাণ্ডব চলে আসছে। বিশেষ করে ধানের মৌসুমে পাহাড়ি জনপদ এলাকায় ধানক্ষেতে তা-ব চালিয়ে ফিরে যায় হাতির পাল। খাবারের খোঁজে লোকালয়ে আসে বলে জানান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয়রাও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

হাতি নিয়ে গবেষণা সংস্থা আইইউসিএন’র ২০০৪ সালের গবেষণায় চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হওয়ার উপর জোর দিয়েছে।
গবেষণার সূত্র ধরে দেখা যায়, বোয়ালখালীর জ্যৈষ্ঠপুরা থেকে রাঙ্গুনিয়ার কোদলা এলাকা পর্যন্ত ঘন বন ও পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। যা বোয়ালখালী ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করবে। পর্যটনেরও অপার সম্ভাবনা তৈরি করবে। কিন্তু ওই পথে হাতির চলাচল বা বিচরণক্ষেত্র ছিল বলে জানায় এলাকাবাসী। হাতির চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত ও পাহাড়-বন-জঙ্গল কাটার কারণে হাতির খাবারের সংকট সৃষ্টি হয়। এসব কারণে হাতির পাল বার বার লোকালয়ে নেমে আসছে দাবি স্থানীয়দের। যা আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনেও ওঠে এসেছে।

২০০৬ সালে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বাংলাদেশে হাতি নিয়ে গবেষণা করে।
গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে দু-আড়াইশ স্থায়ী হাতি রয়েছে। ৮০-১০০টি অস্থায়ী বা ভ্রমণকারী হাতি রয়েছে। ভারতের আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্য এবং মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শত বছর আগে বাংলাদেশের মধূপুর থেকে শুরু করে গারো পাহাড়, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ঘেরা সবুজ অঞ্চলে হাতির বিচরণক্ষেত্র ছিল। পাহাড়ে হাতির খাবার উপযোগী উদ্ভিদের অভাব ছিল না। তাই পাহাড়ি অঞ্চলে নিরাপদে বিচরণ করত। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় পাহাড়ি ও বনাঞ্চল থাকায় হাতির বিচরণক্ষেত্র বাড়তে থাকে। চুনতি, টেকনাফ, ফাসিয়াখালী ও পাবলাখালী অভয়াণ্য, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান, বাঁকখালী, রেজু, ফুলছড়ি, ঈদগড়, মরিচ্যা এলাকায় হাতি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।

এছাড়াও অস্থায়ীভাবে কিছু হাতি ভারতের মিজোরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় রাজ্য থেকে বাংলাদেশের জামালপুরের ঝিনাইগাতি, ময়মনসিংহের হালুয়া ঘাট, দুর্গাপুর, সিলেটের কুলাউড়া এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় নেমে আসে। মাসখানেক বাংলাদেশে থাকে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৩টি দেশে এখনো এশীয় হাতি টিকে রয়েছে। যার সংখ্যা ৩৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার। যার ৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ ভারতীয় উপমহাদেশে অবস্থান করছে। বাংলাদেশে বসবাস করে দু-তিনশ হাতি।
আইইউসিএন’র গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ১১টি বন বিভাগে হাতির বিচরণ রয়েছে। যার সংখ্যা ২৭৯-৩২৭টি। এদের অধিকাংশই আবাসিক। অন্যগুলো হচ্ছে অনাবাসিক।

২০১৬ সালে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় হাতি নিয়ে আরেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বন বিভাগ, আইইউসিএন, এসআরসিডব্লিউপি। ‘হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম ও সঠিক পদ্ধতি শনাক্তকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পে মানুষ এবং হাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং নিরসনের পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। চুনতি, জলদি, রাঙ্গুনিয়া, খুরুশিয়া, দোহাজারী রেঞ্চ, বান্দরবান সদর এলাকায় হাতির গতিবিধি নিয়ে গবেষণা করা হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। চুনতি, রাঙ্গুনিয়া ও বান্দরবানে ৯৪৯ বার শস্যক্ষেত্রে আক্রমণ চালিয়েছে হাতি। ১২৪টি বসতি ও ১৭টি বাণিজ্যিক বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাতির আক্রমণে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মানুষের আক্রমণে ৩টি হাতি মারা গিয়েছিল।

বন ছেড়ে লোকালয়ে না আসার জন্য কয়েকটি প্রস্তাবনা বাস্তবায়নও করা হয়েছিল ওই প্রকল্পে। তা ছিল, হাতি চলাচল সংলগ্ন পাহাড়ি ও পাদদেশ এলাকায় হাতির অপছন্দের খাদ্যশস্য চাষাবাদ করা। অপছন্দের খাবারে রয়েছে মরিচ, কাকরোল, করলা, ঢেড়শ ও কচুর চাষ। সোলার কারেন্টের বেড়া, মরিচের চাষ, বাগান, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, বৈদ্যুতিক ঘণ্টা লাগানো।

এর ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, হাতির অপছন্দের খাবারের বাগানের ৪১৬টির মধ্যে ২৫টি বাগানের ক্ষতি করেছে বন্য হাতি। যা হচ্ছে ৩ শতাংশ। অপরদিকে, ৯৬টি হাতির পছন্দের খাবারের বাগানের মধ্যে ২৩ শতাংশ ফসল ক্ষতি করা হয়েছে। এছাড়াও ট্রিপ এলার্মের ১৩ বার হাতির আক্রমণ থেকে প্রতিহত করা হয়েছে। হাতি চলাচলের পথ : দক্ষিণ চট্টগ্রামের দুধপুকুরিয়া, সুখবিলাস, খুরুশিয়া, কমলছড়ি, পদুয়া, ভেন্ডালছড়ি, রাঙ্গুনীয়া, দোহাজারী এলাকায় চলাচল করে একদল বন্য হাতি। আরেক দল হাতি জলদি, চুনতি লামা অঞ্চলে চলাচল করে। রাঙ্গুনিয়া ও রাজস্থলী এবং চুনতি নাইক্ষ্যংছড়ি অঞ্চলে দুইটি পথে চলাচল করে হাতির পাল। সারা বছর চলাচল থাকে হাতির পালে। কিন্তু সড়ক নির্মাণ, জনবসতি নির্মাণের কারণে হাতির আবাসস্থল অনেকটা পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। পার্বত্য দক্ষিণ চট্টগ্রামের কাপ্তাই মুখবিট, আরাছড়ি, ভাঙামুড়া, রাজস্থলী, পাতাছড়ি, মুকনাছড়ি, শুভলং, সাংরাছড়ি এলাকায় চলাচল করে তিনটি হাতির পাল।

হাতির জন্য হুমকিস্বরূপ নয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে আইইউসিএন। কারণগুলো হলো : হাতির আবাসস্থল খণ্ডিত ও কমে যাওয়া। খাদ্য উপযোগী উদ্ভিদের অভাব। চলাচলের পথ বা করিডোর বাধাগ্রস্ত হওয়া। হাতির পছন্দের চাষাবাদ। একক প্রজাতির উদ্ভিদের চাষ। জুম চাষ। হাতির চলাচলের পথে মানব বসতি বা স্থাপনা নির্মাণ। সীমান্ত এলাকায় কাঁটা তারের বেড়া স্থাপন। দাঁত ও মাংসের জন্য হাতি হত্যা করা। এসব কারণে হাতি চলাচলের পথ হারিয়ে লোকালয়ে ছুটে আসে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here