‘এখন সবচেয়ে গতিশীল বস্তু হচ্ছে ৫০০ টাকার নোট, ভাঙানোর সঙ্গে সঙ্গেই নাই’

অর্থ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা এত কিছু বুঝি না, শুধু বুঝি টাকার দাম কমে যাচ্ছে। আগে ২০০ টাকায় যা কিনতাম, এখন ৫০০ টাকাতেও তা কিনতে পারছি না।

উপরের এই কথাটি কিন্তু এখন আর কোন জোক বা মজা নয়, বাস্তবতা। নীচের তথ্যগুলো এই বাস্তবতাকেই প্রমাণ করে। করোনাকালীন সময়ে নাসিমার পরিবারে প্রায় সবাই কাজ হারিয়েছিল। ঢাকাতেই একটি বস্তিতে তিনবেলার বদলে একবেলা খেয়ে কোনভাবে টিকে ছিল। মনে আশা ছিল করোনা শেষ হলে কাজ ফিরে পাবে এবং তাদের খাওয়ার কষ্ট মিটে যাবে। কিন্তু করোনার পরে কাজ ফিরে পাওয়ার পরও নাসিমা আর তার পরিবারের আশা পূরণ হলো না। কারণ চাল, ডাল, তেল, আলুর মতো দ্রব্যের দাম কমেনি, বরং বেড়েছে এবং বাড়ছেই। দুইবেলা দেড় কেজি চাল, একটু শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে হলেও দেড় থেকে দুইশো টাকা লাগে। ঘর ভাড়া করোনাকালে না বাড়লেও এখন বেড়েছে।

আর মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থা আরো সঙ্গীন। অনেকেরই চাকরি আছে কিন্তু বেতন কমেছে, অন্যদিকে খরচ বেড়েছে। ৩০ হাজার টাকা বেতনে একটি প্রাইভেট অফিসে চাকরি করেন আলমগীর সাহেব। পুরো করোনাকালে খুব ভয়ে ভয়ে ছিলেন যে চাকরিটা থাকবে কিনা। চাকরিটা তার টিকে গেছে সত্য কিন্তু বেতন কমে হয়েছে ২৭ হাজার টাকা। অথচ পরিবারে ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। চারটি মানুষের জন্য ডাল, ভাত, সবজি খেতে গিয়েও ব্যয় বেড়েছে কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ। বাড়িভাড়া বেড়েছে, বেড়েছে বাস ভাড়া এবং এমনকি যারা নিজেদের স্বচ্ছল বলে মনে করেন, তাদেরও ভাবতে হচ্ছে সংসারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে। ৭০ টাকার চাল হয়েছে ৮৫ টাকা, মোটা চাল হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। চালের দাম বাড়া মানে বাজারে অন্য সব কিছুর দাম তরতরিয়ে বাড়া। এক কথায় বলা যায় জীবনযাত্রার ব্যয় করোনাকালের চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে। যারা সেইসময়ে কাজ হারিয়েছেন, তাদের সিংহভাগ এখনো যুতসই কাজ ফিরে পাননি। ফলে জীবনযুদ্ধের এই টানাপোড়েন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। এই ছবিগুলোর সাথে আমরা সকলেই কম বেশি পরিচিত।

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী টিসিবির ২০২০ সালের ১ মার্চ ও নভেম্বর ২০২১ বাজারদরের তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সে সময়ের তুলনায় এখন মোটা চালের গড় দাম সাড়ে ৩১ শতাংশ, খোলা আটা ২০, খোলা ময়দা ৩৩, এক লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল ৪৩, চিনি ১৯, মোটা দানার মসুর ডাল ৩০ ও গুঁড়া দুধের গড় দাম ১৩ শতাংশ বেশি। এই চিত্র স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে বাজার ব্যবস্থাকে তুলে ধরেছে।

তাহলে কি এর সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের আয়ও বেড়েছে? আয়-ব্যয় জরিপটি সর্বশেষ ২০১৬ সালে করেছে বিবিএস। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে উচ্চ আয়ের পরিবারে আয় বেড়েছে। তাদের মাসিক গড় আয় ৯ হাজার ৪৭৭ টাকা বেড়ে ৪৫ হাজার ১৭২ টাকা দাঁড়িয়েছে। আর হতভাগা দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের আয় কমেছে। আয়ের দিক দিয়ে সবচেয়ে নিজের স্তরে থাকা ৫ শতাংশ পরিবারের মাসিক গড় আয় ছিল ৪ হাজার ৬১০ টাকা, যা ২০১০ সালের তুলনায় ৫৩৯ টাকা কম। অবশ্য এ জরিপে সবচেয়ে ধনীদের প্রকৃত হিসাব আসে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। সার্বিকভাবে বিবিএসের হিসাবে, আয় বৈষম্য অনেকটাই বেড়েছে।

বাজারে চালের দাম বেড়েছে। বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য। লাগামছাড়া দামে শহুরে থাকা খেটে খাওয়া মানুষ এবং মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস অবস্থা। বাজার ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যতোটা অস্থির হয়ে উঠছি, সরকার ততোটাই নীরব ভূমিকা পালন করছে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে। বোঝা যাচ্ছেনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কোন ভূমিকা আছে কিনা।

সেই ৩০ বছর আগে ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী আলু খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং ভাতের উপর চাপ কমাতে বলেছিলেন। সেদিন আমাদের খাদ্যমন্ত্রী মহোদয়ও কম খেতে পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু মুশকিলটা হলো ভেতো বাঙালির মন ও মানসিকতা নিয়ে। মোটামুটি তিনবেলা ভাত না খেলে অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে শ্রমজীবি মানুষের মনে হয় কিছুই খাওয়া হলো না। এমনকি আকালের দিনেও নুন, মরিচ দিয়ে হলেও ভাত খেতেই হয় বাঙালিকে। স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য শহুরে মানুষের একটা অংশ ভাত না খেলেও, দেশের সিংহ ভাগ মানুষ গরম ভাত-ডাল খাবেন বলে স্বপ্ন দেখেন। সেই চালের দাম এখন উর্ধ্বমুখী।

আমাদের দেশে এইটাই রেওয়াজ। কোনকিছুর দাম একবার বাড়লে, আর কমেনা। করোনার পরে বিশ্বে তেলের দাম বেড়েছিল ঠিকই, কিন্তু আবার তা কমেও গেছে। বাংলাদেশে তা হয়নি। গত ৪৫ বছর ধরে বাংলাদেশ তেল পায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অনেক কম দামে। অথচ এই কম মূল্যের সুবিধাটা থেকে যে টাকা আয় হচ্ছে, সেটা কিন্তু জনগণের সেবায় লাগছে না। জনগণ সেই বেশি টাকাতেই জিনিস কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আমাদের বাজারে যা কিছুর দাম বাড়ছে, তা আর কমছে না।

করোনাকালে প্রথমে বাড়ানো হলো গ্যাস-বিদ্যুতের দাম। আবারও হাত পড়েছে ডিজেল, গ্যাস-বিদ্যুতের উপর। এগুলোর দাম বাড়া মানেই গাড়ির ভাড়া, সারের দাম, সেচের খরচ, পণ্য পরিবহণ ও কৃষকের ফসল উৎপাদনের খরচ সব বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধি কৃষক ও শহরের নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলেছে যে, দম আটকে আসছে।

বিভিন্ন বেসরকারি রিপোর্ট বলছে বাংলাদেশে এখন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫ কোটি। এদের মধ্যে যারা কাজ হারিয়েছেন, তারা ভবিষ্যতে আরো কঠিন বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছেন বলে আশংকা করছেন অর্থ বিশেষজ্ঞরা। সবচেয়ে দু:খজনক বিষয় হলো এই বিষয়ে সরকারের কোন নজরদারি নেই, নেই বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ।

যদিও সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিছু জরুরি দ্রব্যের উপর থেকে শুল্ক কমানোর অনুরোধ জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে। খুচরা বিক্রেতারা দুষছে আড়তদারকে, আড়তদার দুষছে বাজার ব্যবস্থাকে। এদিকে বাজার চড়া হয়েই যাচ্ছে। অর্থ বিশেষজ্ঞরা বলছেন পণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা এত কিছু বুঝি না, শুধু বুঝি টাকার দাম কমে যাচ্ছে। আগে ২০০ টাকায় যা কিনতাম, এখন ৫০০ টাকাতেও তা কিনতে পারছি না।

নগরীর মালিবাগ এলাকার আব্দুর রহমান ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। করোনার পরে কিছুতেই আগের অবস্থা ফিরে আসছে না আর। এখন সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের অপেক্ষায় থাকেন। কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে তেল-চিনি কিনে বাসায় ফেরেন। কিন্তু বাকি জিনিসগুলো কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।

সরকার উদ্যোগী হয়ে টিসিবি এর মাধ্যমে কয়েক মাস ধরে বেশ কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। চাল, তেলও আছে কিছু পরিমাণে। তবে রোদের মধ্যে লাইন দিয়ে এই পণ্য কেনা সবার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। এই বাজার আরো বাড়ানো দরকার। কিন্তু সরকার বাড়াচ্ছে না। জানিনা, হয়তো রোজার জন্য বাকিটা মজুদ করে রেখেছে। কারণ রোজাতে আরেকটা ধাক্কা এসে লাগবে পণ্য বাজারে।

মোসাদ্দেক হোসেন ব্যাংকে চাকরি করেন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাবা-মাসহ ৬ জন। বললেন করোনার আগে দুই মাসে একদিন গরুর মাংশ খেতাম। করোনাকালে কক মুরগি না কিনে ব্রয়লার ধরলাম। ছোট মাছ মূল আমিষ ছিল। আলু দিয়ে রান্না করলে সবার হয়ে যেতো। ছেলে মেয়ে দুটি মুরগি খেতে চাইতো বলে ডিম দেয়া হতো মাঝেমধ্যে। আর এখনতো ব্রয়লার কেনারও অবস্থা নাই। আলু আর পেপের জীবন। ১০০০ টাকা ভাঙালেও হাতে কিচ্ছু থাকেনা, এটাই বাস্তবতা। শুধু যে খাবারের দাম বেড়েছে তাতো নয়। বেড়েছে সাবান, ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, নারকেল তেল, টিস্যুসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম।

করোনাকালে দারিদ্র্য পরিস্থিতি কী দাঁড়াল, তা নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কোনো জরিপ নেই। বেসরকারি সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানিয়েছে, দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে (৪২ শতাংশ)। যদিও সরকার তা মেনে নেয়নি, আর নিজেরাও কোনো জরিপ করেনি। এই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে আমরা বলতে চাই সরকার মানুষের দারিদ্রতার বাস্তবতাকে মেনে নিক এবং সেইভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। তবে হয়তো সাধারণ মানুষ কিছুটা ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবেন। সমস্যাকে অগ্রাহ্য করার মধ্যে কোন সাফল্য নেই।

  • লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here