রাজু দে : চট্টগ্রামের মুকুটহীন আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষ। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান যেন আর জমে না এ শিল্পীকে হারানোর পর থেকে। গভীর শূন্যতা আজো ভর করে আছে এ শিল্পীর মৃত্যুতে।
২০০৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর রবিবার সন্ধ্যায় জীবনের সকল মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে সকল ভক্ত অনুরক্তদের শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন কিংবদন্তী শিল্পী শেফালী ঘোষ । আজ এ গুণী শিল্পীর ১৩ম মৃত্যুবার্ষিকী।
চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামে ১৯৪১ সালে জন্ম হয় শেফালি ঘোষের। শিক্ষা সংস্কৃতিতে উদ্ভাসিত এ কানুনগোপাড়া গ্রামের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস সারাদেশে বিস্তৃত। তাঁর পিতার নাম কৃষ্ণ গোপাল ঘোষ মাতার নাম শ্রীমতি আশালতা ঘোষ।
যিনি ১০বছর বয়স থেকে মাঠে-ময়দানে ঘরোয়া অনুষ্টান কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্টানে বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে মন জয় করতে পেরেছিলেন অগনিত মানুষের। ১৫৫৯ সালে নভেম্বর মাসে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজের নবীন বরণ উৎসবে স্টেজ প্রোগ্রাম করেন তিনি। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রাচীন এবং স্বনামধন্য এ শিক্ষা প্রতিষ্টান কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ মাঠে তার ফারফর্মেন্স এর মাধ্যমে এলাকার মানুষ তাকে শিল্পী হিসেবে নুতনভাবে চিনতে শুরু করে।
কানুনগোপাড়া গ্রামে কীর্তণ ও পটুয়া গানের আসর বসত। সে সব পটুয়া গান কীর্তণ গান শুনতে শুনতে সুরের মায়ায় জড়িয়ে যান শেফালি ঘোষ। তাঁর উৎসাহ দেখে বাবা-মা তাকে সমর্পণ করেন ওস্তাদ তেজেন সেনের কাছে। শুরুতেই রবিন্দ্র-নজরুল-আধুনিক গানের তালিম নেন।
পরে চট্টগামের ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিষদের অধ্যক্ষ ওস্তাদ শিবশংকর মিত্রের কাছে ১৯৬৩ সালে শাস্ত্রীয় সংগীতের উপর তালিম নেন। পরবর্তীতে তিনি ওস্তাদ নিরোদ বরণ বড়ুয়া, জগদানন্দ বড়ুয়া মিহির নন্দী ও গোপাল কৃষ্ণ চৌধুরীর কাছে নিয়মিত তালিম নিতে থাকেন। রপ্ত করেন শাস্ত্রীয় সংগীত।
চট্টগ্রামের জাম্বুরি মাঠে এক অনুষ্টানে গান পরিবেশন করে হাজার হাজার দর্শকের মন জয় করতে সক্ষম হয় শেফালি ঘোষ। এরপর থেকে তিনি বৃহত্তর সংগীত জগতে পদার্পণ করেন।
১৯৬৪ সালে অডিশন দিয়ে তৎকালিন রেডিও পাকিস্তান চট্টগ্রাম কেন্দ্রের তালিকাভুক্ত হন এ শিল্পী। নজরুল গীতির শিল্পী হিসেবে বেতারে যাত্রা শুরু করলেও পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন আঞ্চলিক গানের এক অনন্য কন্ঠস্বর। বেতারে পরিবেশিত তার প্রথম আঞ্চলিক গান ‘সূর্য উডের লে ভাই লাল মারি’ এর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে লোকসংগীত শিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে থাকেন শেফালি ঘোষ।
আঞ্চলিক ভাবধারায় লোকসংগীতকে বৃহত্তর পরিসরে ফুটিয়ে তুলতে তালিম গ্রহণ করেন, এম এন আকতার, আব্দুল গফুর হালী, এম এ কাশেম ও সৈয়দ মহিউদ্দিনের কাছে। এভাবে গানে গানে হয়ে ওঠেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তী শেফালি ঘোষ। শেফালি ঘোষ আর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান যেন অবিচ্ছেদ্য নাম।
মলয় ঘোষ দস্তিদারের লেখা ও সুরে দ্বৈত কন্ঠে ‘নাইঅর গেলে বাপর বাড়িত আইস্য তড়াতড়ি’ গানটিতে জুটি বাঁধেন সহশিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সাথে তৎকালিন বেতারের এডিআর আশরাফুজ্জামানের অনুরোধে। দেশে বিদেশে বহু অনুষ্টানে অংশ গ্রহণ করে তাদের এ জুটি ব্যাপক পরিচিত লাভ করে এবং চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান তথা বাংলাদেশের লোক সংগীতকে ভিন্নতর এক মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন।
গ্রামে গঞ্জে- পাড়া-মহল্লায় ছেলে-বুড়ো-যুবক, সবার মুখে মুখে যখন শেফালী ঘোষের গান ছড়িয়ে পরছিল,তখন তার জন্য গান লিখলেন, উপমহাদেশ খ্যাত কবিয়াল স¤্রাট রমেশশীল, কবিয়াল এয়াকুব আলী, সৈয়দ মহিউদ্দিন, অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তী, চিরঞ্জিত দাশ, মো নাসির ও মোহন লাল দাশেরা। তাদের লেখা সেই সব গানগুলো তার জাদুকরি কন্ঠে পরিবেশন করে মানুষের হৃদয় কেড়ে নিল শেফালিী ঘোষ। মানুষ কি ভুলবে সেই সব কথাগুলো— আধার ঘরত রাইত কাডাইয়ুম কারে লই’ “ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দেওয়ানা” “পালে কি রঙ লাগাইলিরে মাঝি, সাম্পানে কি রঙ ল্গাাইলি” ‘নাতিন বড়ই খা বড়ই খা হাতে লইয়া নুন, ঠেইল ভাঙিয়া পইজ্জে নাতিন বড়ই গাছত্তুন।
আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো রয়ে যাবে শেফালির গানে।
১৯৭০ সালে শেফালি ঘোষ যুক্ত হন টেলিভিশনের সাথে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কণ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন শেফালি ঘোষ। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে বিভিন্ন শরনার্থী শিবিরে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গান গেয়ে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। প্রখ্যাত শিল্পী কলিম শরাফির তত্বাবধানে স্বাধীনতা পূর্বকালেই তৎকালিন পাকিস্তানের বিখ্যাত ইএমআই গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে শেফালি ঘোষের গান প্রকাশিত হয়।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজারের অধিক গানে কন্ঠ দিয়েছেন শিল্পী শেফালি ঘোষ। বাংলাদেশের গন্ডি পেড়িয়ে ভারত উপমহাদেশ, এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গান পরিবেশন করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন এ শিল্পী। তৎমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, কাতার, ওমান, কুয়েত,বাহারাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মায়ানমার, ভারত সহ প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন।
১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝর পরবর্তী মৃত্যু উপত্যকায় দেশ যখন উপদ্রুত হয় তখন তিনি গেয়ে উঠলেন,তার বিখ্যাত গান — ভাঙ্গা গাছত নয়া ঠেইল/ পাতা মেলি দেহার খেইল, পঙ্খী আবার উড়ের ফিড়ের/ চুপতে প্রেমের হথা হঅর”। এমন প্রেরণাদায়ী গান গেয়ে মানুষকে ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে এসে আবার জীবনের হাল ধরে ঘুড়ে দাড়ানোর উৎসাহ দিয়েছিলেন শেফালী ঘোষ।
তাঁর গান নিয়ে দু’শতাধিক এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন চলচ্চিত্রেও তিনি কন্ঠ দিয়েছেন। মালকাবানু, মধুমিতা, বসুন্ধরা, মাটির মানুষ, স্বামী, মনের মানুষ, বর্গী এলো দেশে উল্লেখ যোগ্য। শুধু সংগীত শিল্পী হিসেবে নন, সংগঠক হিসেবেও অসামান্য অবদান রেখেছেন শেফালি ঘোষ। চট্টগ্রাম শিল্পী কল্যাণ সংস্থার সভাপতি হিসেবে নিষ্টার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
মৃত্যুর পর গণমানুষের দাবির মুখে এ শিল্পীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় সরকার। ২০০৮ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।
সংগীত ভুবনে তাঁর অনুপস্থিতি অপুরণীয়, তাঁর সুর গান কথা আমাদেরকে শিকড় সন্ধানে প্রেরণা যোগাবে যুগ যুগ ধরে। হৃদয়ের কথা বলার প্রধান মাধ্যম তার গানের মাঝে তিনি চিরঞ্জিব থাকবেন।
বোয়ালখালীতে জেলা পরিষদের অর্থায়নে এ গুণি শিল্পীর সমাধিতে আবক্ষ মূর্তি স্থাপন ছাড়া তেমন একটা উল্লেখ্য কর্মকান্ড নেই। সরকারের কাছে একটি সড়ক এ গুণির শিল্পীর নামে নামকরণ করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিল এলাকাবাসী।
লেখক: সাংবাদিক