সোহেল মারমা : চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল এলাকায় রোগী বহনে নিয়োজিত ১৩৫টি অ্যাম্বুলেন্সের অর্ধেকেই ঝুঁকিপূর্ণ। ওইসব অ্যাম্বুলেন্সের গ্যাস সিলিন্ডারের মেয়াদ শেষ হয়েছে বহু বছর হচ্ছে। এরপর নতুন করে সিলিন্ডারগুলো আর পুনঃপরীক্ষা হয়নি। এরমধ্যে কিছু আছে মানহীন সিলিন্ডার। ওই অবস্থায় বছরের পর বছর ধরে ঝুঁকি নিয়ে রোগী পরিবহন করে আসছে অ্যাম্বুল্যান্সগুলো। এতে বারবার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে প্রাণহানির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে।

গত ১৭ অক্টোবর চমেক হাসপাতালে ৮দিন চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে অ্যাম্বুলেন্সের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা যান বৃদ্ধ মো. মফিজ উদ্দিন (৭০)। এসময় তার দুই পুত্রবধূও মারা যান। আনোয়ারায় চাতরী চৌমুহনী বাজারের কাছে মর্মান্তিক এই বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত আরো তিনজন। ওই দুর্ঘটনার পর অ্যাম্বুল্যান্সে থাকা সিলিন্ডার পরীক্ষার বিষয়টি আলোচনায় উঠে।

জানা গেছে, প্রতি ৫ বছর অন্তর অন্তর যানবাহনের সিলিন্ডার রিটেস্ট বা পুনঃপরীক্ষণ করার বাধ্যতামূলক রয়েছে। কিন্তু এসব মানছে না অধিকাংশ মালিকেরা। গ্যাস চালিত রোগী ও মরদেহ পরিবহনের অ্যাম্বুল্যান্সের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চমেকে রোগী পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে ১৩৫টি’র মতো অ্যাম্বুলেন্স। সম্প্রতি চমেক কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স পরিবহন ব্যবস্থাপনায় ৮৪টি’র মতো অ্যাম্বুলেন্সকে রোগী পরিবহনে অনুমতি দিয়েছে। বিআরটিএ থেকে ফিটনেস সনদ পাওয়ার পরই ওইসব অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে চমেক কর্তৃপক্ষ রোগী পরিবহনের জন্য অনুমতি দেয়া হয়।

তবে বাকী ৫১টি অ্যাম্বুলেন্সের ফিটনেস, গ্যাস সিলিন্ডার রিটেস্টিং সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার কারণে ওইসব যানবাহনগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে রোগী পরিবহনে অনুমতি পায়নি। এর মধ্যে ৩০টি অ্যাম্বুলেন্সের সিলিন্ডার বছরের পর বছর সিলিন্ডার রিটেস্ট করা হয়নি বলে জানা যায়। এরপরও ওইসব অ্যাম্বুলেন্সগুলো হাসপাতাল থেকে নগরীসহ বিভিন্ন জেলায় রোগী পরিবহন করে চলছে।

বিআরটিএ চট্টগ্রামের পরিদর্শক পলাশ খীসা আজাদীকে বলেন, বর্তমানে গ্যাস চালিত গাড়িগুলোর ফিটনেস সনদ প্রদানকালে বিভিন্ন পরীক্ষার পাশাপাশি ওইসব গাড়ির সিলিন্ডারের রিটেস্টিং করা হয়েছে কিনা সেটার কাগজপত্র যাচাই করা হচ্ছে। সিলিন্ডার রিটেস্টের কাগজ যদি না থাকে তখন ওই মুহূর্তে গাড়িগুলোর ফিটনেস সনদ বাতিল করে দেয়া হচ্ছে বা তাদেরকে সময় দেয়া হচ্ছে।
তাদের পরিদর্শনে সিলিন্ডার রিটেস্টের কাগজ না থাকা এই ধরণের অনেক অ্যাম্বুলেন্স গাড়িকে ফিটনেস সনদ না দিয়ে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন বিআরটিএ’র এই কর্মকর্তা।

যেগুলোর কাগজপত্র ঠিক থাকছে সেগুলোর ফিটনেস দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। বিআরটিএ কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, নগরীতে ফিটনেস সনদ নেয়নি এমন অনেক অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। সাধারণত প্রতি বছর অন্তর অন্তর যানবাহগুলোর ফিটনেস পরীক্ষা করার বাধ্যতামূলক থাকে।

এদিকে মেয়াদহীন সিলিন্ডার দিয়ে রোগী পরিবহনের বিষয়টি অস্বীকার করছে না বিভিন্ন অ্যাম্বুলেন্স মালিকও। ওইসব অ্যাম্বুলেন্সগুলো মালিকদের নিয়ে হাসপাতাল এলাকায় একটি সমিতি রয়েছে। সম্প্রতি নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দলের কারণে ওই সমিতির নির্বাহী কমিটি ভেঙে যায়। নতুন একটি কমিটি গঠনের চেষ্টা চলছে।

বর্তমানে অ্যাম্বুলেন্সগুলোর দেখভালকারী হিসেবে ভারপ্রাপ্তের দায়িত্বে থাকা নুর মোহাম্মদ নুরু নামে একজন নেতা আজাদীকে বলেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, আমাদের অনেক অ্যাম্বুলেন্সেরই সিলিন্ডার রিটেস্ট করা হয়নি। এগুলোর সিলিন্ডারের মেয়াদ বহু বছর আগেই শেষ হয়েছে। এরপরও রিটেস্ট ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে গাড়িগুলো চলে আসছে।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে বারবার বলা হচ্ছে। অনেকেই সিলিন্ডার রিটেস্ট করেছেন। কিন্তু কিছু পুরনো মালিক রয়েছে তারা কথা শুনছেন না। তাদের মধ্যে আগ্রহ নেই। তারা টাকা খরচ করতে চায় না। ওইসব মালিকদের দাবি, তারা আয় করেন কত? সেখানে টেস্টিং এর জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা দিবে। এমন কখা বলছে। এমনকি কোনো কোনো মালিক ৪/৫ বছর ধরে গাড়ির কাগজপত্র হালনাগাদ করছে না। তবে সমিতির নতুন কমিটি গঠনের পর আমাদের মধ্যে থাকা বিভিন্ন ক্রটিগুলো সংশোধনের বিষয়ে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান নূর মোহাম্মদ।

নুর মোহাম্মদ বলেন, যেসব গাড়ির সিলিন্ডার রিটেস্টিং করাসহ বিআরটিএ’র কাছ থেকে ফিটনেস ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হালনাগাদ করেছে সেসব গাড়িগুলোকে রোগী পরিবহনের জন্য চমেক কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী তাদের ৩০টি মতো গাড়ি সিলিন্ডার রিটেস্ট ছাড়াই চলছে। ৮৪টি মতো অ্যাম্বুলেন্স চমেক কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে। এই সংখ্যা এক-দুইটা এদিক সেদিক হতে পারে।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অভ্যন্তরে গাড়ি পার্কিং করে থাকা লিটন নামে এক অ্যাম্বুলেন্স চালক বলেন, দশ বছর আগে ওই চালক গাড়ি নেওয়ার সময় সেখানে সরকারের অনুমোদিত একটি কোম্পানির গ্যাস সিলিন্ডার সংযোজন করেন। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি তখন থেকে এখনো তার গাড়িতে থাকা সিল্ডিন্ডার রিটেস্টিং করার প্রয়োজন মনে করেনি।

লিটন দাবি করেন, আমার গাড়িতে এক নম্বর কোম্পানির সিলিন্ডার রয়েছে। এসব সিলিন্ডারে কোনো সমস্যা নেই। কোম্পানি থেকে নেওয়ার সময় ২০২৩ সাল পর্যন্ত এর মেয়াদ দিয়েছে। ওই মেয়াদ শেষ হলে রিটেস্ট করাবেন বলে জানান তিনি। লিটন বলেন, যেসব গাড়িতে বাংলা সিলিন্ডার লাগানো হচ্ছে ওইসব গাড়িতে ঝুঁকি রয়েছে। সাধারণত নরমাল অ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে এসব বাংলা সিলিন্ডার লাগানো হয়ে থাকে। এ সময় তিনি হাসপাতাল এলাকায় পার্কিং করা বাংলা সিলিন্ডার লাগানো কয়েকটি গাড়ি দেখিয়ে দেন।

তার মতে, গাড়ির মালিকেরা আয় করেই বা কত? সিলিন্ডার টেস্টের জন্য ৩৫শ’ টাকা কিভাবে দেবে। এ কারণে অনেক গাড়ির মালিক সময়মতো সিলিন্ডার রিটেস্ট করেন না। ওই চালকের গাড়িতে তিনটি গ্যাস সিলিন্ডার সংযোজিত থাকতে দেখা গেছে। চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণ বাংলা সিলিন্ডারগুলো বাজারে পাওয়া যাচ্ছে ৭/৮ হাজার টাকার মধ্যে। কিন্তু সরকারের অনুমোদিত বড় বড় কোম্পানির সিলিন্ডারের মূল্য ১৮ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকার মধ্যে। এতে অনেকেই তাদের গাড়িতে কম মূল্য দিয়ে বাংলা সিলিন্ডার লাগিয়ে থাকছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর মুরাদপুর, আরাকান রোড, বাদুরতলাসহ আরও কয়েকটি জায়গায় এসব বাংলা সিলিন্ডার বিক্রি করে থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামে হাতেগোনা কয়েকটি বড় গ্যাস কোম্পানি সিলিন্ডার বাজারজাতের পাশাপাশি ওইসব সিলিন্ডারে রিটেস্টিং করার সুযোগ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে নাভানা ও ইন্ট্রাকো সিএনজি। তবে বাংলা সিলিন্ডারগুলোতে রিটেস্টিং করার কোনো সুযোগ নেই।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here