লিটন দাশ গুপ্ত

মানে দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে তো দাগই ভালো! যেমন ধরুন শিউলি নামের মেয়েটির কথা। শিউলি একটি গবেষণা ইনস্টিটিউটে উচ্চপদে কর্মরত অবিবাহিত মেয়ে। সারা বছর শিক্ষা আর গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিজের পোশাক সচেতনতা শব্দটি ভুলেই গেছেন। মানে স্টাইলিশ, স্মার্টনেস, মেকআপ ইত্যাদি শব্দগুলো তাঁর ব্যক্তি অভিধানে বা দৈনন্দিন রুটিনে নেই। তাই পরিধেয় জামাটি বিভিন্ন কারণে কিছুটা মলিন হয়ে গেলেও খবর নেই সেই দিকে। সময়ের অভাবে বা আলসেমিতে বা অন্য কোন কারণে ভালো করে ধুয়ে ঠিকমত পরিষ্কার করাও হয়না। অনেক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দুষ্টুমীর ছলে বলেই ফেলছে, জামার কারণে জামাইও জুটবেনা! এইদিকে অনেকেই পোশাক নিয়ে সমালোচনা করলেও শিউলি’র কোন অনুভূতি নেই, ভাবার অবকাশও নেই। কারণ প্রয়োজনও বা কি, কোন রকমে চলছে তো! জীবনতো আর পোশাক আশাকের বাহাদুরী নয়, জীবন মানে বহুমুখী জ্ঞানের সমষ্টি। মনেপড়ে যায় পারস্যের কবি শেখ সাদীর ‘পোশাকের গুন’ গল্পটি, কিংবা বরেণ্য ব্যক্তিদের পোশাক আশাকের প্রতি অনীহা বা অসচেতনের কথা।
এই দিকে একদিন অফিসে যেতে গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করছিল। এমন সময় হঠাৎ সামনে দিয়ে যাওয়া অন্য একটি গাড়ির চাকা, রাস্তায় সৃষ্ট ময়লার গর্তে পড়লে, পুরো জামা নষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর এই জামা আর কোন রকমে চলেনা। শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে সার্ফএক্সেল এনে ধুয়ে পরিষ্কার করে আয়রন করে ফেলল। এই অবস্থায় একদিন এই জামা পড়ে অফিসে যাবার সময় কোথাও কোন দাগ আছে কিনা আয়নাতে দেখতে যায়। কিন্তু নতুনরূপে আয়নার সামনে নিজেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল। এবার ভাবল, জীবনে পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই দিকে বান্ধবীদের কথা সত্যি হল, কারণ এখন অনেক উচ্চপদস্থ দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব বর হিসাবে প্রস্তাব আসছে। তার মানে সেই ময়লার দাগ থেকে হয়ে গেল দারুণ কিছু। এই দাগ না হলে শিউলি’র জীবনে নিশ্চয় এমন দারুন কিছু হতনা।
বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন তাঁর তৃতীয় সূত্রে বলেছেন, ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ আমরা দেখছি শুধু ক্রিয়াই নয়, প্রত্যেক ঘটনার পিছনে যেমন পুরাতন ঘটনা থাকে, তেমনই নতুন নতুন ঘটনার সৃষ্টি হয়। কিংবা অনেক সময় প্রচলিত ‘হিতে বিপরীত’ কথাটিও বিপরীতে হিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই অবস্থার প্রেক্ষাপটে ‘বদলে যাও বদলে দাও’ এই শ্লোগানে স্বভাব চরিত্র বদল না হলে, নিজেই সঠিকভাবে বদলে গিয়ে, অন্যকে বদলাতে বা পরিবর্তনে বাধ্য করতে হবে।
যাই হোক, এবার মূলবিষয়ে আসি। গৌরচন্দ্রিকায় কথা বেশী হয়ে গেলে পত্রিকার সীমিত পরিসরে মূলবিষয়বস্তু বিশ্লেষণে সুযোগ থাকেনা। ভূমিকায় এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে করোনার কারণে তিনমাস তালাবদ্ধ ছিল পৃথিবী। এতে করে অর্থনৈতিক কর্মকাÐ বিধ্বস্ত, স্বাভাবিক জনজীবন বিপর্যস্ত, সাধারণ মানুষ বিপদগ্রস্ত। এককথায় বলতে গেলে চরম হুতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে মানবসভ্যতা। ধনী-দরিদ্র ছোট-বড় শিক্ষিত-অশিক্ষিত জাতি-ধর্ম সবারই একই অবস্থা; মানে সবাইকে প্রতিকূল বা বিপরীত পরিবেশ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই ‘বিপরীত’ যদি কোন একসময় ‘হিত’ হয়ে যায়, তাহলে সাময়িক দুঃখ কষ্ট আর সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি হবার সত্তে¡ও সেই বিপরীত দিক বা প্রতিকূল পরিবেশই ভালো। অর্থাৎ ‘দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে দাগই ভালো।’
আজকের পৃথিবীতে শতকোটি মানুষ ঘরে বন্দী, লক্ষ লক্ষ শিল্প কারখানা বন্ধ, বিভিন্ন পথে কোটি কোটি যানবাহন বন্ধ। এতে করে অর্থনৈতিক ও মানবিক কিছুটা ক্ষতি হলেও, প্রকৃতি তার স্বকীয় পরিবেশ ফিরে পাচ্ছে। বায়ুমন্ডলে কমে আসছে নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা। আজ নির্মল আকাশ, পরিষ্কার বাতাস আর প্রকৃতিতে সবুজে সবুজে বৃক্ষরাজির সমারোহ। বেড়ে গেল পাখপাখালীর কলকাকলী, নৌ-জাহাজ বিহীন শান্ত সমুদ্র, যা বিভিন্ন মিডিয়া থেকে খবর পাচ্ছি। পৃথিবীর অনেক অনেক জায়গায় দেখা মিলছে অসংখ্য বিরল ও প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণী। সাগর পাড়ে বা সমুদ্র সৈকতে অবাধে ভেসে বেড়াচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণী। পত্রিকায় দেখলাম, বিশ্বের বিভিন্ন জনমানবহীন শহরে, সৃষ্ট হয়েছে সবুজ সমারোহ, পাশাপাশি নেমে এসেছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এখন দেখা যাচ্ছে দীর্ঘসময় মানুষ প্রকৃতির উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল, অবাধে বিচরণ করেছিল। এতে করে বিভিন্ন প্রাণী ভয়ে লুকিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, বিলুপ্ত হয়েছিল বিভিন্ন প্রজাতির জীব। এখন প্রকৃতিতে বিচরণ করছে অনুজীব। যার নাম নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯। যার প্রেক্ষিতে এখন মানুষ ভয়ে লুকিয়ে গেল ঘরের ভিতর। বিপরীতে বাইরে বেরিয়ে এল বিভিন্ন বণ্য ও বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণি; আর তাদের পাহারা দিচ্ছে নভেল করোনা নামক অনুজীব!
সত্যি কথা হচ্ছে, প্রকৃতিতে এখন সাজ সাজ রব। এখন এই শহরেও ভোরে দোয়েলের শিষ আর অন্যান্য পাখির কলতানে আমার ঘুম ভাঙ্গে। আমি বাসায় অবরুদ্ধ থেকে জানালা দিয়ে দেখতে পায় বিভিন্ন উদ্ভিদের হাসি। ভাবনা আমাকে নিয়ে যায় তিনযুগ আগের পল্লী পরিবেশে, তখন স্বপ্নের মত আনন্দ পাই। এইতো গেলো আমার ব্যক্তিগত বাস্তব অনুভুতির কথা। এবার আসি বিজ্ঞানীদের বাস্তব অভীজ্ঞতা ও অনুভবের কথা।
আমাদের এই পৃথিবী ৪.৫৪ বিলিয়ন বছরের পুরানো; যার ওজন ছয় বিলিয়ন ট্রিলিয়ন টন। এমন দীর্ঘ পুরানো ও বিশালভর বিশিষ্ট পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য এক পরিবর্তন এসেছে। গত শতাধিক বছরের মধ্যে এমন পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। উন্নত দেশের বিজ্ঞানীগণ স্যাটেলাইট থেকে মহাকাশ সম্পর্কীয় যে সিগন্যাল পাচ্ছেন, তা কোলাহলমুক্ত সুষ্পষ্ট নিঃসন্দেহে পরিমাপযোগ্য; যা কিছুকাল আগেও অস্পষ্ট ছিল। এই সব সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে আরো দেখা যাচ্ছে, আগে পৃথিবীতে অস্বাভাবিক অতিমৃদু একধরণের ঝাঁকুনি বা কম্পন ছিল; যা এখন প্রায় নাই বললেই চলে। পৃথিবীর এই ধরণের কাঁপুনি বা ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়েছে গত একশ বছর আগে থেকে। যা নাকি বিশ্বজুড়ে ১-২০ হার্টস ফ্রিকোয়েন্সির আওয়াজের কারণে সৃষ্টি হয়েছিল। চলমান অবরুদ্ধ পৃথিবীর এমন নাটকীয় পরিবর্তনে, বিভিন্ন দেশের ভূকম্পবিদ গবেষক বিজ্ঞানী উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন।
এই হচ্ছে বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণের কথা। এখন আমরা সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে কি দেখতে পাচ্ছি? বাস্তবে আমাদের দেখার কথাও অস্বীকার করা যাবে না। যেমন- দৈনন্দীন জীবন কোলাহল মুক্ত, নিরব নিঃশব্দ পথঘাট, কোথাও নেই দূর্নীতি, নেই ঘুষ দেয়া নেয়া। ছোটদের উপর বড়দের নেই খবরদারী, নেই যোগ্য ব্যক্তির উপর অযোগ্য ব্যক্তির প্রভাব, নেই অন্যায় অবিচার অনিয়ম বিশৃঙ্খল পরিবেশ। অনেকক্ষেত্রে ঘরের ভিতর অবরুদ্ধ থেকেও আজ মুক্ত স্বাধীন মনে হচ্ছে। আর এভাবে যদি এক বছর অবরুদ্ধ থেকে পৃথিবী একশ বছর পিছিয়ে গিয়ে, একদিন মানুষ যদি হয়ে উঠে সত্যিকার মানুষ, যেমন- ভদ্র ন¤্র ন্যায়পরায়ন বুদ্ধিদীপ্ত সৎ চরিত্রবান সত্যবাদী; মানুষ যদি হয়ে উঠে সহজ সরল আন্তরিক নির্মল সমাজ হিতৈষী পরোপকারী; আর যদি সকল মানুষের মধ্যে জেগে উঠে বিবেক আবেগ নৈতিকতা নিয়মানুবর্তিতা সময়ানুবর্তিতা, শিষ্টাচার দেশপ্রেম গণতান্ত্রিকতা, তাহলে ক্ষতি কি! আমরা যদি সেই মুক্ত জীবন ফিরে পায়, যেখানে থাকবেনা কোন প্রকার দুঃখ কষ্ট ভেদাভেদ বিশৃঙ্খলা হানাহানি খুনাখুনি, যেখানে থাকবে শুধু সুখ হাসি খুশী মায়ামমতা আন্তরিকতা আর ভালোবাসার বন্ধন। আর পরিবর্তিত পৃথিবী যদি তা-ই হয়, তবে সাময়িক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ক্ষতি কি? এই অবস্থায় প্রত্যশা রইল, আবার ফিরে আসবে পুরাতন পৃথিবী নতুন রূপে, আমরাও ‘নতুন ছন্দে লিখবো জীবন।’

লেখক: লিটন দাশ গুপ্ত (সাহিত্যিক ও শিক্ষক)

প্রধান শিক্ষক, পশ্চিম গোমদন্ডি বশরত নগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here