সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
بسم الله الرحمن الرحيم. الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على سيد المرسلين وعلى آله وصحبه أجمعين, أما بعد!
আল্লাহ তা’লা এরশাদ করেন:
هُوَ الَّذي جَعَلَ الشَّمسَ ضِياءً وَالقَمَرَ نورًا وَقَدَّرَهُ مَنازِلَ لِتَعلَموا عَدَدَ السِّنينَ وَالحِسابَ ما خَلَقَ اللَّـهُ ذلِكَ إِلّا بِالحَقِّ يُفَصِّلُ الآياتِ لِقَومٍ يَعلَمونَ ﴿ يونس-৫﴾
“তিনিই সে মহান সত্তা, যিনি বানিয়েছেন সুর্যকে উজ্জল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনযিলসমূহ, যাতে করে তোমরা চিনতে পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ এই সমস্ত কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি, কিন্তু যথার্থতার সাথে। তিনি প্রকাশ করেন লক্ষণসমূহ সে সমস্ত লোকের জন্য যাদের জ্ঞান আছে।” (সূরা ইউনূস: আয়াত- ৫)।
আল্লাহ তা’লা আরো এরশাদ করেন:
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهورِ عِندَ اللَّـهِ اثنا عَشَرَ شَهرًا في كِتابِ اللَّـهِ يَومَ خَلَقَ السَّماواتِ وَالأَرضَ مِنها أَربَعَةٌ حُرُمٌ ذلِكَ الدّينُ القَيِّمُ فَلا تَظلِموا فيهِنَّ أَنفُسَكُم وَقاتِلُوا المُشرِكينَ كافَّةً كَما يُقاتِلونَكُم كافَّةً وَاعلَموا أَنَّ اللَّـهَ مَعَ المُتَّقينَ ﴿التوبة-৩৬﴾
“নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গননায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছেন। (সূরা আল-তাওবাহঃ ৩৬)
সাহাবি হযরত আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي بَكْرٍ , عَنْ أَبِيهِ , رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ , عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” أَلَا إِنَّ الزَّمَانَ قَدِ اسْتَدَارَ كَهَيْئَتِهِ يَوْمَ خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ , السَّنَةَ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا , مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ , ثَلاثٌ مُتَوَالِيَاتٌ ؛ ذُو الْقَعْدَةِ وَذُو الْحِجَّةِ وَالْمُحَرَّمُ ، وَرَجَبٌ شَهْرُ مُضَرَ بَيْنَ جُمَادَى وَشَعْبَانَ( 1) “
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বারো মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক: যিলক্বদ, যিলহজ্ব, মহররম আর চতুর্থটি হল রজব মুদার, যা জুমাদা আল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।’( 2)
মুসলিম হিসেবে হিজরী নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলিমদের গৌরবের দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি। আমরা অনেকেই জানি না যে, মুসলিমদের নববর্ষ কোন মাসে হয়? আবার কেউ হয়ত বা হিজরীবর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাস জানেন না। হিজরী সনের তারিখের খবরও রাখেন না, এর প্রতি মানুষ আকর্ষণও অনুভব করেন না, তা খুব দুঃখজনক। হিজরীর প্রথম দিনে বাংলাদেশের কোন পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখেনা এবং অধিকাংশ পত্র-পত্রিকায় কোন নিউজও আসেনা, এমনকি কোন টিভি চ্যানেল এ সম্পর্কে বিশেষ কোন অনুষ্ঠান রাখেনা। এতেই প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের মুসলমানগণ ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে কতটা উদাসীন।
চান্দ্রমাসের প্রভাব ও গুরুত্ব:
হিজরী ক্যালেন্ডারের গননা নির্ভর করে চাঁদের আবর্তন-বিবর্তনের উপর। চাঁদের আবর্তন ও বিবর্তনে সদা সচেতনতা ও গূড় পর্যবেক্ষনের প্রয়োজন হয়। নিছক সূর্যের মতো উদিত হওয়া ও অস্ত যাওয়ার মধ্যেই চাঁদ সীমীত নয়। শুধু তাই নয়, চাঁদের উপরেই নির্ভর করে পৃথিবীর অনেক প্রাকৃতিক গতি বিধি, যেমন সাগরের জোয়ার ভাটা, মানুষ, পশু-পাখি, উদ্ভিদরাজী ইত্যাদি অনেক কিছুই লুনার সাইকেলে অবর্তিত হয়ে থাকে।
চান্দ্রমাসের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে ব্যাপক। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষত: ইবাদতের তারিখ, ক্ষণ ও মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিজরী সনের প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। একারণে হিজরী সনের হিসাব স্মরণ রাখা মুসলমানদের জন্য জরুরি।
মুসলমানগণ হিজরী সনকে ভিত্তি করে বিভিন্ন ধর্মীয় বিধি-বিধান যথাঃ রমযানের রোযা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আয্হা, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হজ্ব, যাকাত, শবে-বরাত, শবে-ক্বদর, শবে-মি’রাজ, আ’শুরা এবং বিভিন্ন মাসের নফল রোযা ইত্যাদি পালন করে থাকেন। রোযা রাখতে হয় চাঁদ দেখে, ঈদ করতে হয় চাঁদ দেখে। এমনকি স্বামীর মৃত্যুর পর মহিলাদের ইদ্দতের ক্ষেত্রগুলোতেও চন্দ্রবর্ষের হিসাব গণনা করতে হয়। অর্থাৎ মুসলমানদের ধর্মীয় কতগুলো দিন-তারিখের হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলোতে চাঁদের হিসাবে দিন, তারিখ, মাস ও বছর হিসাব করা আবশ্যকীয়। তাইতো মহান আল্লাহ এরশাদ করেন:
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ وَلَيْسَ الْبِرُّ بِأَن تَأْتُوا الْبُيُوتَ مِن ظُهُورِهَا وَلَـٰكِنَّ الْبِرَّ مَنِ اتَّقَىٰ وَأْتُوا الْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَابِهَا وَاتَّقُوا اللَّـهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ﴿البقرة-١٨٩﴾
“হে হাবীব! আপনার নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। আপনি বলে দিন, এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম। আর পেছনের দিক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার মধ্যে কোন নেকী বা কল্যাণ নেই। অবশ্য নেকী হল আল্লাহকে ভয় করার মধ্যে। আর তোমরা ঘরে প্রবেশ কর দরজা দিয়ে এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাক যাতে তোমরা নিজেদের বাসনায় কৃতকার্য হতে পার। (বাক্বরাহ-১৮৯)
হিজরী সনের ইতিহাস:
ইসলামের পূর্বে দিন – তারিখ গণনার জন্য আরবদের এমন কোন ঐতিহাসিক উৎস ছিল না যাকে কেন্দ্র করে তারা কয়েক দশক বা শতাব্দীকে চিহ্নিত করতে পারত। অবশ্য তারা তারিখ গণনার জন্য এক দশক বা কয়েক দশকের মধ্যে ঘটমান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহকে উৎস করে তা কেন্দ্রিক সাময়িক তারিখ গণনা করত। যেমন আবরাহার হাতি বাহিনীর মাধ্যমে মক্কা শহরে হামলা ও কাবা ঘর সংস্কারের বছর যা “আমুল ফী-ল বা হাতির বছর” নামে খ্যাত, কয়েক যুগ পর্যন্ত তারিখ গণনার উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের প্রচারের সময় যখন তিনি দারুল আরক্বাম বা আরকামের বাসায় যান, তা তারিখ গণনার উৎস হিসেবে পরিণত হল।
পরবর্তীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা মুকাররমা থেকে মদিনা মুনাও্ওরায় হিজরতের পর মদিনায় ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কোরানের দৃষ্টিতে হিজরতের গুরুত্ব ও ইসলামের উন্নয়ন -সম্প্রসারণে হিজরতের মূল পটভূমিকার জন্য পরবর্তীতে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিণত হয়। আর মদিনায় হিজরতের ঘটনাকে আমরা দু’টি দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করতে পারি।
প্রথমত: রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ ও দ্বিতীয়ত: শরিয়তগত ও এলাহী দৃষ্টিকোণ।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিজরতের পর মদিনায় ইসলামের একটি শক্তিশালী – নিরাপদ ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী সমাজে এক নতুন জীবনের সূচনা হওয়ার কারণে হিজরত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং শরীয়তগত ও এলাহী দৃষ্টিকোণ থেকে যেহেতু হিজরতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ হয়েছিল, তাই এটি একটি শরীয়তী আবশ্যকীয় দায়িত্ব ছিল, আর যদি কেউ বিনা কারণে মক্কায় অবস্থান করতো তাহলে বিনা কারণে এই অবস্থান তার জন্য গোনাহ বিবেচিত হত, তাই শরীয়তী দিক থেকেও হিজরত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। আর উপরোক্ত কারণসমূহ হিজরতের বিষয়টিকে ইসলামী বর্ষ পঞ্জিকার সূচনা হওয়ার বিষয়টিকে যথাযথভাবে অনুমোদন করে।
৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই সেপ্টেম্বর আল্লাহর নির্দেশে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা হতে মদীনায় হিজরত করেন। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ বা ১৫ জুলাইয়ের সূর্যাস্তের সময়কে হিজরী সন শুরুর সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
হিজরী সন হল মুসলিমদের সন। কিন্তু সঠিক কখন থেকে হিজরত ইসলামী বর্ষপঞ্জির উৎস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে তা সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকের মতে প্রায় হিজরতের ১৭’তম বর্ষে (৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বিভিন্ন কারণে ইসলামী ইতিহাসের সূচনা নির্ধারণের জন্য ইসলামী বর্ষপঞ্জি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।
مَا أخْرَجَهُ أَبُو نُعَيْم الْفَضْل بْن دُكَيْن فِي تَارِيخه وَمِنْ طَرِيقه الْحَاكِم مِنْ طَرِيق الشَّعْبِيّ ” أَنَّ أَبَا مُوسَى كَتَبَ إِلَى عُمَر : إِنَّهُ يَأْتِينَا مِنْك كُتُب لَيْسَ لَهَا تَارِيخ ، فَجَمَعَ عُمَر النَّاس ، فَقَالَ بَعْضهمْ : أَرِّخْ بِالْمَبْعَثِ ، وَبَعْضهمْ أَرِّخْ بِالْهِجْرَةِ ، فَقَالَ عُمَر : الْهِجْرَة فَرَّقَتْ بَيْن الْحَقّ وَالْبَاطِل فَأَرِّخُوا بِهَا ، وَذَلِكَ سَنَة سَبْع عَشْرَة . فَلَمَّا اِتَّفَقُوا قَالَ بَعْضهمْ اِبْدَءُوا بِرَمَضَان فَقَالَ عُمَر : بَلْ بِالْمُحَرَّمِ فَإِنَّهُ مُنْصَرَف النَّاس مِنْ حَجّهمْ ، فَاتَّفَقُوا عَلَيْهِ .”( 3)
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর কাছে ইরাক ও কুফার প্রশাসক আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এক চিঠিতে লেখেন, “আমিরুল মুমিনীন! আপনার পক্ষ হতে আসা শাসন কার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোন সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার সাথে পার্থক্য করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে যেয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
এ গুরুত্বপূর্ণ পত্র পাওয়ার পর হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। এ বিষয়টি যখন বিভিন্ন লোকের মাঝে উত্থাপন করা হল তখন প্রত্যেকেই এ বিষয়ে নিজ নিজ মতামত উপস্থাপন করে। এক দল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম দিবসকে, কিছু লোক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত প্রকাশের দিবসকে, আবার কেউ কেউ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাত দিবসকে বর্ষপঞ্জির সূচনা হিসেবে প্রস্তাব করেন। এরই মাঝে আমিরুল মোমিনীন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দিনটিকে ইসলামী ইতিহাস ও বর্ষপঞ্জির সূচনা হিসেবে প্রস্তাব করেন এবং এই প্রস্তাবটিই গৃহীত হয়। ফলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় হিজরত করার ঐতিহাসিক দিন থেকে নতুন একটি সন তৈরী করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (4 )
হিজরী সনের তাৎপর্য:
মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে হিজরী সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরী সন শুরু করার কারণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মুসলিমদের শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
হিজরী সন মুসলিম উম্মাহ্কে মনে করিয়ে দেয় প্রিয় নবী রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে সুদর মদীনায় হিজরতের ঘটনাকে।
বস্তুতঃ রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করার সেই ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপর্ণ ঘটনার স্মৃতিবাহী হচ্ছে হিজরী সন। এ হিজরতের মধ্য দিয়েই ইসলাম এক নবশক্তি লাভ করেছিল। এতদিন পর্যন্ত মুসলমানরা কেবল আত্বরক্ষাই করে এসেছে, মুখবুজে জুলুম অত্যাচার সহ্য করে এসেছে। অবশেষে হিজরতের মধ্য দিয়ে এতসব জুলুম-অত্যাচারের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষমতা তাঁদের অর্জিত হয় এবং রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে ইসলাম আতœপ্রকাশ করে। হিজরত পরবর্তী সময়ে মুসলমানরা ক্রমেই সুসংহত ও সম্প্রসারিত হয়েছে। ইসলাম বিশ্বজনীন রূপে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। ইসলামের অবদানে বিশ্ব সভ্যতা সমৃদ্ধশালী হয়েছে। এক সময়ে মুসলমানরা বিশ্বের এক অজেয় শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখাকে অবিস্মরণীয় অবদানে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। তার শুভ সূচনা এই হিজরত থেকেই।
তাছাড়া আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতের কথা গুরুত্বের সাথে কুরআনে উল্লেখ করেছেন। নবীজীর এই ঐতিহাসিক হিজরতের ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল। ফলে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর গুরুত্ব বিবেচনায় নবীজির জন্ম বা ওহী নাজিলের সময়কে হিজরী বর্ষপঞ্জি না করে হিজরতকেই হিজরী সাল রূপে গণ্য করেন। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে বানানো হয়েছে বলে এ সনকে হিজরী সন বলা হয়। এ সময় থেকেই ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শগত ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে মুসলিমরা মুহাররম মাস দ্বারা বর্ষ গণনা শুরু করেন।
মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি কালচারে হিজরী সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরী সন গণনার সূচনা হয়েছিল ঐতিহাসিক এক অবিস্মরণীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে। রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তদীয় সাথীবর্গের মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণীয় রাখার জন্যই আরবী মুহাররম মাসকে হিজরী সনের প্রথম মাস ধরে সাল গণনা শুরু হয়। দ্বীনের স্বার্থে মক্কা থেকে মদীনায় রাসলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কিরামের হিজরত থেকেই হিজরী সনের সূচনা।
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক দিন বা ঘটনা ভিত্তিক বহু সনই বিশ্বে প্রচলিত হয়ে আসছে। উদাহরণতঃ খ্রীস্টীয় স্মারক সন খ্রীস্টান ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত। জাতিগতভাবে কোন জাতির পক্ষেই আপন ঐতিহ্য ত্যাগ করা সম্ভব নয়। তেমনিভাবে মুসলিম পরিবারগুলোও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত অন্যান্য সন তারিখ অনুসরণ করা সত্ত্বেও সূচনালগ্ন থেকেই হিজরী সনকে পাশাপাশি গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ্ হিজরী সনের অনুসারী। খ্রীস্টীয় সন, বাংলা সনসহ অন্যান্য সনের প্রচলন সত্ত্বেও আরবী সনের দিন মাসের হিসাব চর্চা একটুুও ম্লান হয়নি।
হিজরত পর্ব প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের ন্যায় বর্তমানেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানগণ ইহুদী-খ্রীস্টানদের হাতে নিপীড়িত, নিগৃহিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সে সময়কার মুসলমানদের ন্যায় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং ক্রমান্বয়ে সুসংহত হয়ে নিজ পায়ে ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে দাঁড়াতে হবে।
বাংলাদেশে হিজরি সনের আবির্ভাব:
ইসলাম প্রচারের সাথে সাথেই বাংলাদেশে হিজরী সনের প্রচলন ঘটেছে। আমাদের এদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খিলাফত কাল থেকেই। তখনকার ইসলাম প্রচারকগণই এদেশে হিজরী সনের প্রচলন করেন। হিজরী সনের বিভিন্ন মাসে ইসলামী বিধি-বিধান থাকার কারণে এদেশের জন-সমাজে হিজরী সনের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যার প্রতিফলন ঘটেছে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ও ভারতে প্রচলিত বাংলা সন সম্পর্কে বলা যায়, হিজরী সনেরই চলমান পথে এক পর্যায়ে সৌরকরণের মাধ্যমে বাংলা সনের জন্ম। আর হিজরী সনই বাংলাদেশে প্রচলিত একমাত্র সন, যা প্রায় জন্মকাল থেকেই এখানে প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশে ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দ হতে সর্বক্ষেত্রে হিজরী সন ব্যবহার শুরু হয় ( 5)। উপমহাদেশে প্রায় ৫৫০ বৎসর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই হিজরী সন স্বীকৃত ছিল। ইংরেজ শাসনকালে আমাদের দেশে অমুসলিমদের রাষ্ট্রীয় সনের প্রচলন হয় (১৭৯০ সাল হতে) যা আজও আমরা অন্ধের মতো ব্যবহার করছি।
এই পৃথিবীতে মুসলমানদের সংস্কৃতির পাশাপাশি আর যত সংস্কৃতি বর্তমানে রয়েছে সেগুলোর ভিত্তি স্ব-স্ব স্থানের অধিবাসীদের অনুসৃত ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকেই গড়া (এর মধ্যে অনেকেরই ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের মনগড়া, আর অনেকেরটি আল্লাহ কর্তৃক অবলুপ্ত/বাতিল করে দেওয়া তাঁরই প্রেরিত বিভিন্ন ধর্মীয় আদর্শের বিকৃত রূপ)। কাজেই মুসলমান জাতি তাদের জন্যে আল্লাহর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশে তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত সংস্কৃতি ছাড়া আর কোনো সংস্কৃতির অনুসরণের এখতিয়ার রাখে না।
এতদসত্ত্বেও দুঃখজনক সত্য যে, আমরা অনেকেই অবগত নই যে, মুহাররম মাস ইসলামী নববর্ষ -আনন্দের দিন। কেননা ইসলামের ঘটনাবহুল ইতিহাসের একটি অতি তাৎপর্যমন্ডিত ঘটনাকে স্মরণীয রাখার দিনটি হচ্ছে মুহররম মাস। বিশ্বের মুসলিমদের কাছে ইসলামী সন হিসেবে হিজরী সন অতি পবিত্র ও অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। শুধুমাত্র এই একটি সালেই সমগ্র বিশ্বে সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। মুসলিমদের কাছে হিজরি সন বিশেষ তাৎপর্যমন্ডিত সন।
হিজরী সন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ত্যাগ এর ঐতিহাসিক স্মারক। হিজরী সন আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিভাবে অবিশ্বাসীরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবী হতে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তিনি আজো জাগরূক হয়ে আছেন মুসলিম বিশ্বে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের এই প্রেক্ষাপট ও পটভূমি যদি হিজরী নববর্ষে স্মরণ করা হয় তাহলে মুসলিম ভাই-বোনেরা ইসলামী সাংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারবে। তখনই কেবল ইসলামি সাংস্কৃতি বিমুখ হৃদয় পরিবর্তিত হয়ে ইসলামী হৃদয়ে পরিণত হবে। তাই আমাদের উচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর হিজরতের তাৎপর্য স্পষ্টভাবে জনসম্মুখে তুলে ধরা। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।
وصلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه اجمعين.
========================================================সূত্র:
1- أخرجه البخاري في بدء الخلق (৩১৯৭)، ومسلم في القسامة (১৬৭৯) من حديث أبي بكرة رضي الله عنه.
2 – সহীহ বুখারী ২/৬৭২, হা-৩১৯৭, মুসলিম-১৬৭৯।
3- الكتب গ্ধ صحيح البخاري গ্ধ كتاب مناقب الأنصار গ্ধ باب التاريخ من أين أرخوا التاريخ. حدثنا عبد الله بن مسلمة حدثنا عبد العزيز عن أبيه عن سهل بن سعد قال ما عدوا من مبعث النبي صلى الله عليه وسلم ولا من وفاته ما عدوا إلا من مقدمه المدينة رقم الحديث-৩৭১৯. فتح الباري شرح صحيح البخاري. وجاء في “الكامل في التاريخ” لعز الدين أبو الحسن علي المعروف بابن الأثير”وسبب ذلك أن أبا موسى الأشعري كتب إلى عمر : إنه يأتينا منك كتب ليس لها تاريخ . فجمع الناس للمشورة ، فقال بعضهم : أرخ لمبعث النبي – صلى الله عليه وسلم – . وقال بعضهم : أرخ لمهاجرة رسول الله – صلى الله عليه وسلم – فقال عمر : بل نؤرخ لمهاجرة رسول الله – صلى الله عليه وسلم – فإن مهاجرته فرق بين الحق والباطل ، قاله الشعبي . الكامل في التاريخ গ্ধ ذكر الوقت الذي ابتدئ فيه بعمل التاريخ في الإسلام. صـ১২
4 – ফতহুল বারী, শরহে বুখারী, ৩৭১৯ হাদীসের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য, ইবনুল আসীর:আল কামেল, পৃ-১৪
5- তবাকাতে নাসিরী ১/৫৪
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ.
খতীব, মুসাফির খানা জামে মসজিদ, নন্দন কানন, চট্টগ্রাম। ০১৭১৯১৯৭৯৭৮