মো. তাজুল ইসলাম রাজু : সম্পাদক, আলোকিত বোয়ালখালী
মো. তাজুল ইসলাম রাজু : সম্পাদক, আলোকিত বোয়ালখালী

মো. তাজুল ইসলাম রাজু

মানচিত্রে বোয়ালখালী
মানচিত্রে বোয়ালখালী

প্রবাহমানকালের গতিশীল প্রেক্ষায় ইতিহাসের মনিজ্যেতিদীপ্ত পৃষ্ঠায় রচিত পবিত্র ধূলা এবং অনুপম সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উজ্জ্বল পরিচয় বহন করে চলেছে বীর চট্টগ্রামের রত্নগর্ভা বোয়ালখালী অঞ্চল। দু’দুটো স্বাধীনতা সংগ্রামে রক্ত রঙ্গীন সময়গুলোর ধারাহিকতায় এ অঞ্চলের অতুলনীয় অবদান সর্বত্র সুবিদিত। বীরদের বাঁধন ছেঁড়ার সংগ্রামের আত্মদান, উপাধি ভূষিত রতœগর্ভাদের মেধার মহিমা, কবি ভাস্করদের মোহনীয় কাব্য সংরচন, ধর্মানুরাগীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সমাজপতিদের স্বদেশ হিতৈষণা এবং সমাজ তথা দেশ সেবার মহান আদর্শে উজ্জ্বীবিত অসংখ্য সন্তানের সু-কৃতি ও সু-কর্মে এ অঞ্চল আলোকিত হয়ে আছে।

হযরত শাহ বুঁ আলী কলন্দার
হযরত শাহ বুঁ আলী কলন্দার

হযরত শাহ বুঁ আলী কলন্দার। পুরো নাম শেখ শরফুদ্দীন। পবিত্র ইসলাম প্রচারক এবং সুফি সাধক হিসেবে সারা বিশ্বে একজন বরেন্য আউলিয়া হিসেবে খ্যাতি রয়েছে।
জেনে নিই তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি- শেখ শরফুদ্দিন বু আলী কাল্ন্দার পানিপতি (১২০৯-১৩২৪খ্রিষ্টাব্দ বা ৬০৬ হিজরি) চিশতিয়া তরিকার একজন সূফি সাধক যিনি ভারতে বাস করতেন। পানিপথের শহরে তাঁর দরগাহ (মাজার) অবস্থিত যা একটি ধর্মীয় তীর্থস্থান। তাঁর আসল নাম ছিল শেখ শরফুদ্দিন কিন্তু তিনি বু আলী শাহ নামেই অধিক পরিচিত। তিনি খুব অল্প বয়সে পড়াশোনা শেষ করেন এবং পরবর্তীকালে প্রায় বিশ বছর দিল্লির কুতুব মিনারের নিকটে পড়াশোনা করেন।

দিওয়ানে হযরত শরফুদ্দিন বু আলী কালান্দার নামে তিনি ফার্সি কবিতার একটি সংকলন প্রকাশিত করেন যা পরবর্তকালে খাজা শাহাউদ্দিন কর্তৃক পাঞ্জাবী ভাষায় অনূদিত হয়।

ভারতের পানিপথে -এর মাজার শরীফ
ভারতের পানিপথে -হযরত শাহ বু আলী কলন্দার-এর মাজার শরীফ

সূত্রে জানা যায় তিনি ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে ভারতের পানিপথে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দরগাহের সমাধিফলকে ফার্সি ভাষায় লেখা আছে, তাঁর জন্মস্থান গাঞ্জায় যা বর্তমানে আজারবাইজান। এ থেকে বুঝা যায় তাঁর বংশ নুমান ইবনে থাবিত হযরত আবু হানিফা থেকে এসেছে। পিতার নাম শেখ ফখর উদ্দিন, যিনি তার সময়ের মহান প-িত এবং দরবেশ ছিলেন। মাতা বিবি হাফিজা, মৌলানা সৈয়দ নিমাত উল্লাহ হামদানির কন্যা। ৬০০ হিজরীতে তাঁর পিতা ইরাক থেকে ভারতে আসেন এবং পানিপথে বসতি স্থাপন করেন।

চার বছর বয়স থেকেই শাহ বু আলী কালান্দার মায়ের কাছ থেকে পবিত্র কুরআন পাঠ করতে শিখেন এবং পন্ডিত রাম সানাহি থেকে হিন্দু শাস্ত্রের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। তরুণ বয়সে তিনি তিনটি তরিকার (সোহারার্দিয়া, কাদেরিয়া এবং নকশাবন্দিয়া) জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর উনিশ জন আধ্যাত্মিক পীর বা দীক্ষাগুরু রয়েছে, যাদের মধ্যে এগারজন মুসলমান এবং আটজন হিন্দু।

 বোয়ালখালীতে কড়লডেঙ্গা পাহাড়ে হযরত শাহ বু আলী কলন্দার- এর আস্তানা শরীফ
বোয়ালখালীতে কড়লডেঙ্গা পাহাড়ে হযরত শাহ বু আলী কলন্দার- এর আস্তানা শরীফ

উপাখ্যনে আছে, এই মহান সাধকের অনেক উপাখ্যান লোক মুখে প্রচলিত রয়েছে। একটি উপখ্যান এমন রয়েছে যে, প্রায় ৩৬ বছর কার্নাল নদীর পানিতে দাড়িঁয়ে থেকে সাধনা করার ফল স্বরূপ মুহাম্মাদ তাঁকে বু আলী (আলীর সুবাস) উপাধি দান করেন। এই মর্যাদাপ্রাপ্ত হওয়ার পর অনেক মহান সুফি সাধক তাঁর সাক্ষাত লাভ করার জন্য আসেন। অন্য আরেকটি উপাখ্যানে উল্লেখ আছে, একদিন মুহাম্মাদ তার বেশারতে (স্বপ্ন) আসেন এবং তাকে একটি ইচ্ছা পূরণের আশ্বাস দেন। কালান্দার নবুওয়াতের আবেদন করল এবং তাকে বলা হল নবুওয়তের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে এবং মুহাম্মাদ হচ্ছেন শেষ নবী। তারপর তিনি আলী হতে চাইলেন এবং বলা হল ঐ মর্যাদাটিও আগেই পূর্ণ হয়েছে। এরপর তিনি আলীর অন্তত সুবাস পাওয়ার জন্য আবেদন করলেন এবং তার এই ইচ্ছা পূর্ণ করা হল। তাঁর নামের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হল এই যে, বু আলী কুন্যিয়াত আবু আলী এর অন্যরূপ।

উপমহাদেশে তিনি ইসলাম প্রচারে সফরকালীন সময়ে একাধিক আস্তানার তথ্য বিভিন্ন ভাবে প্রকাশ রয়েছে। আমাদের চট্টগ্রামেও একাধিক আস্তানা আছে মর্মে নিশ্চিত রয়েছে। তেমনি একটি আস্তানা আমাদের বোয়ালখালীতেও আছে। বোয়ালখালীর কড়লডেঙ্গা পাহাড়ে এটি অবস্থিত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, হযরত শাহ বু’আলী কলন্দারের নামের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বোয়ালখালী’ নামটি। অন্তত ৭০০ বছর আগে এই আসনটি আবিষ্কার হয়েছে বলে বুদ্ধমহলের ধারণা।

ফালগুন মাসে ওরশ অনুষ্ঠানে আস্তানার আশে পাশের গাছগুলোর শিরমনি থেকে ধোঁয়া উঠার দৃশ্য দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের মিলন মেলা
ফালগুন মাসে ওরশ অনুষ্ঠানে আস্তানার আশে পাশের গাছগুলোর শিরমনি থেকে ধোঁয়া উঠার দৃশ্য দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের মিলন মেলা

খলিফায়ে গাউসুল আজম মাইজভা-ারী (ক.) আহলা দরবার শরীফের আধ্যাত্মিক শরাফতের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবে জামান, কুতুবুল আকতাব, সাহেবে ক্বাশফুল কুবুর হযরত মাওলানা জনাব কাজী আসাদ আলী সাহেব ক্বেবলা (রহঃ) জানান, প্রায় সময় হযরত শাহ বুঁ আলী কলন্দার (রহ.) কড়লডেঙ্গা পাহাড়ের চূড়ায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় অবস্থান করতেন। সে সুত্র ধরে তিনি আস্তানা (আসন শরীফ) সনাক্ত, মাজার শরীফ নির্মাণ, তা’জীম, জিয়ারত, ওরশ, ফাতেহা করার নির্দেশ দেন।

ফালগুন মাসে ওরশ অনুষ্ঠানে আস্তানার আশে পাশের গাছগুলোর শিরমনি থেকে ধোঁয়া উঠার দৃশ্য দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের মিলন মেলা
ফালগুন মাসে ওরশ অনুষ্ঠানে আস্তানার আশে পাশের গাছগুলোর শিরমনি থেকে ধোঁয়া উঠার দৃশ্য দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের মিলন মেলা
ফালগুন মাসে ওরশ অনুষ্ঠানে আস্তানার আশে পাশের গাছগুলোর শিরমনি থেকে ধোঁয়া উঠার দৃশ্য দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের মিলন মেলা
ফালগুন মাসে ওরশ অনুষ্ঠানে আস্তানার আশে পাশের গাছগুলোর শিরমনি থেকে ধোঁয়া উঠার দৃশ্য দেখার জন্য উৎসুক ভক্তদের মিলন মেলা

এখানে মাজারের আশে পাশে যে গাছগুলো রয়েছে এই গাছগুলোর শিরমণি থেকে অর্থাৎ গাছের পাতাগুলো হতে এই মাজারের যে দিন ওরশ অনুষ্ঠানের দিন অর্থাৎ ফাল্গুন মাসে ২ ও ৫ তারিখে সন্ধ্যা বেলা ওরশ উপলক্ষে আনিত হাদিয়া (গরু বা মহিষ) জবেহ করার সময় এক ধরনের শির শির ধোয়া (!) উঠতে থাকে। এগুলো অনেকে বলে আলৌকিক ধোয়া, আবার অনেকে বলে এক ধরনের পোকা। যাই থেকে হোক না কেন- আমরা সেটাকে অবশ্যই আলৌকিক ধরে নেবো। এই আলোকিক দৃশ্য দেখার জন্য ওরশ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার নারী ও পুরুষ ভক্ত জড়ো হয় মাজার এলাকায়। যা ধর্মানুরাগীদের উৎসাহ আর উদ্দীপনায় আবেগ মিশ্রিত পরিবেশ সৃষ্টি করে।

No description available.ফালগুন মাসে ওরশ অনুষ্ঠানে আস্তানার আশে পাশের গাছগুলোর শিরমনি থেকে ধোঁয়া উঠার দৃশ্য
ফালগুন মাসে ওরশ অনুষ্ঠানে আস্তানার আশে পাশের গাছগুলোর শিরমনি থেকে ধোঁয়া উঠার দৃশ্য

বোয়ালখালীর ইতিহাসে রয়েছে ঐতিহ্য আর গৌরবে পরিপূর্ণ। পাহাড়, নদী, সমভূমি প্রকৃতির এ অপরূপ সৃষ্টি বোয়ালখালী নামক অঞ্চলটির জন্ম। ভূমির গঠন, রূপ নির্দ্ধিধায় বলে দেয় সে পৌরনিক প্রাগৈতিহাসিককালে বোয়ালখালী নামক অঞ্চলটির জন্ম। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের “মান্ডেয় পুরাণ” গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ আছে এতদঞ্চলের কথা। হযরত শাহসুফি বুঁ-আলী কালন্দর (রহ:) খিষ্ট্রিয় একাদশ/ দ্বাদশ শতাব্দীতে বোয়ালখালী দ্বীনি ইসলাম প্রচার করার জন্য আসেন। হাজার বছরের বোয়ালখালী এটাতেও প্রমাণ মেলে। সরকারি নতি মোতাবেক বোয়ালখালীর সৃষ্টি হয়েছে হযরত বুঁ-আলী কালান্দর শাহ (রহ:) এর নামানুসারে। থানা সৃষ্টি হয় ২৯ আগষ্ট ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ। এর পূর্বে এটি পটিয়া মহকুমার অন্তর্গত ছিল। তবে লোকেমুখে এটি প্রচার আছে যে, বোয়ালখালী নামক খাল (কর্ণফুলির উপনদী) থেকে “বোয়ালখালী” শব্দটির উৎপত্তি। তবে একথা সত্য যে, বোয়ালখালীর ইতিহাস অন্যান্য যে কোন উপজেলা থেকে সমৃদ্ধ এবং হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রকৃতি এবং মানবীয় গুণাবলীর বর্তমান বিশেষণে বিশেষিত “রতœগর্ভা বোয়ালখালী”।

এই বিরল প্রজাতির সাপটি প্রায় সময় আস্তানার অভ্যন্তরে দেখেছেন অনেক আশেক ভক্ত
এই বিরল প্রজাতির সাপটি প্রায় সময় আস্তানার অভ্যন্তরে দেখেছেন অনেক আশেক ভক্ত

বর্তমান শাকপুরা ইউনিয়নের বোয়ালখালী খালের তীরে ঘোষখিল গ্রামে পটিয়া থানার অধীনে একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। ১৯১০ সালের ২৯ আগষ্ট ঐ পুলিশ ফাঁড়িকে নামকরণ করা হয় “বোয়ালখালী” হিসেবে। ১৯৮৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঘোষখিল গ্রাম থেকে অস্থায়ী থানাকে পূর্ব গোমদন্ডী ইউনিয়নে নিজস্ব স্থায়ী ভবনে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৩ সালের ২ জুলাই বোয়ালখালী থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। ৪ অক্টোবর ২০১২ স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বোয়ালখালী পৌরসভার গেজেট প্রকাশ করে। বর্তমানে ইউনিয়ন ৯টি, পৌরসভা ১টি। গ্রাম ঃ ৩৮টি। মৌজা ৩৫টি।

আরো পড়ুন:

বোয়ালখালীর জন্মকথা

আহলা দরবার শরীফ এর ইতিহাস

কালের স্বাক্ষী বোয়ালখালী-এর স্থিরচিত্র : পর্ব- এক

কালের স্বাক্ষী বোয়ালখালী-এর স্থিরচিত্র : পর্ব- দুই

কালের স্বাক্ষী বোয়ালখালী-এর স্থিরচিত্র পর্ব- তিন

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here